রুমা মোদক
টিকেট কেটে বিরতিহীন বাসে ওঠা গন্তব্যের মতোই প্রায়শই আমার গল্পের শেষটা আমি জানি। এমন খুব কমই হয়েছে যে আমি শুরুটা দেখেছি আর শেষটা কোথায় নিয়ে যাবে আমি জানিনা। কিন্তু আজ নিজ চোখে দেখা এই শুরুটা দিয়েই গল্পটা শুরু করলাম। দেখি শুরুর লাগামহীন নৌকা আমাকে কোন পাড়ে কোন উপসংহারে নিয়ে পৌঁছে দেয়।
একে আমি চিনি,এই এখন যাকে পরিচয় করিয়ে দেব আপনাদের সাথে। সে আপাতত দীর্ঘকাল ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত কেরানির মতো সিলিং ফ্যানটার নিচে ঘুমায় তার নিজস্ব স্বপ্ন নিয়ে। ঘুমিয়েও সে এই স্বপ্নটা দেখতে চায়, জেগেও।
আমি দেখতে পাই, একরাতে বাইরে শেষ শ্রাবণের বৃষ্টির অঝর বর্ষণে চারপাশ ডুবে গেছে ইলেক্ট্রিসিটি হীন ভূতুড়ে অন্ধকারে। চাপা শুটকি ভর্তা আর মুসুরের ডাল দিয়ে ভাত খেতে ছেলেটি তার মায়ের কাছে উজ্জ্বল উৎসাহে আশার আলো জ্বালাতে চায়, সে জানায় তার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে কাল। প্যালেস ফাইভ স্টার রিসোর্টে ইউনিভার্সেলের নতুন প্রোডাক্ট “গ্লো এণ্ড লাভলির” রিলঞ্চ প্রোগ্রামে তাকে কনসার্ট করতে হবে। মিউজিক হ্যাণ্ডস বাদে ঠিক কতো নিজের পকেটে থাকে লাভের গুড়ে পিঠা হয় সে হিসাবটাও একই সাথে মাকে জানাতে চায় সে বিশ্বাসযোগ্য করে। পঁচিশ হাজার, ত্রিশ হাজার। ঠিক কতো হলে দুনিয়াদারি উদাসীন মাকে বিশ্বাস করানো যায়!
আমরা অপ্রত্যাশিতভাবে ছেলেটির স্বপ্নটার অন্তরালের একটা সত্য উন্মোচন করি কর্পুরের মতো মিলিয়ে যাওয়া লকডাউনের সময়টায়। এক ঝিমমারা দুপুরে,তখন ঘরের বাইরে অতর্কিত অদৃশ্য আতঙ্ক। অপরিচিত, অনাকাঙ্ক্ষিত। দরকারেও বাইরে যায় না কেউ, রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতার পুলিশের লাঠির ভয়তো বটেই,ঘর থেকে বের হলেই মনে হতো এক অচেনা ঘাতক ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে ধারালো ছুরি হাতে।
ঘরের ভিতরেও ওৎ পেতে থাকা আতঙ্ক আর অবিশ্বাসের জাল মাকড়শার মতো ঘরের দেয়ালে, দরজার হাতলে, যে কোন আগন্তুকের জুতায় অশ্বস্তি বুনে যায়। সেই অপ্রস্তুত অবসরে এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ছেলের কাছে হঠাৎ এক অজানা অবরুদ্ধ গল্পের ঝাঁপির ঢাকনা খুলে যায় ঘরের মাচাঙের টিনের ট্রাঙ্ক থেকে। সেই অবরুদ্ধ গল্পটিও এখন আপনারা জেনে যাবেন প্রাসঙ্গিক ভাবে এই গল্পের প্রয়োজনেই।
এখন যখন আপনাদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি তখন এই জীবন তার কাছে হররোজ রোজার মতো। সময়টাই এমন নির্দয় যে,উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ সবার জীবন কমবেশি হররোজ রোজার এমন কাছাকাছি সংকটে পৌঁছে গেছে যে কারো সময় নেই কারো সংকটে দুএকটা সমবেদনার বাক্য বুলিয়ে দেয়।বাসা ভাড়ার টাকার জন্য এর ওর কাছে হাত পাতা,ত্রানের জন্য লাইনে দাঁড়ানো, লাজ শরমের মাথা খেয়ে সব সাহায্যের উৎসে দুস্থ শিল্পী হিসাবে নাম লেখানো কি না করেছে সে! খুব সুবিধা করতে পারেনি কোথাও। নায়ক না হোক,গায়ক সুলভ হাবভাবে কেউ তাকে অভাবী হিসাবে গোনায় ধরে না। আর শিল্পী! তায় আবার দুস্থ! মাত্রই গায়ে হলুদ জাতীয় মঞ্চে একটু আধটু গাইবার সুযোগ হয়েছিল তার, এই লকডাউনের আগে আগে। শিল্পীর মর্যাদায় কিংবা দুস্থ শিল্পীর অভিধায় কেউ তাকে কোথাও তালিকাভুক্ত করেনি। এমন
সংবেদনহীন সমবেদনাহীন সময়ে ডুবন্ত নৌকাযাত্রীর মতো তার ভেসে উঠার আশা বাঁচিয়ে রেখেছে এই স্বপ্ন।
এই স্বপ্ন ছেলেটিকে কৈশোর থেকে তাড়া করে ফিরলেও স্বপ্নটির উত্তরাধিকার সম্প্রতি ঘরের প্রায় পরিত্যক্ত ট্রাঙ্কে আবিষ্কৃত হয়েছে এক মলিন মলাটের খাতায়। যার কথা আমি আপনাদের বলেছি, বলেছি এই গল্পটি আপনারা প্রাসঙ্গিক ভাবেই জেনে যাবেন। পাঠক আমি দেখি, দীর্ঘ অব্যবহারের মরিচায় প্রায় অচল তালাটি ভেঙে ছেলেটি যে খাতাটি আবিষ্কার করে, তাতে রুল করা কাগজে গুটি গুটি যুবতী লাজুক লেখা। কিছু চেনা কিছু অচেনা গানের কলি, কলির পর কলি।
তুমি চোখের আড়াল হও,কাছে কিবা দূরে রও….
আমার বুকের মধ্যখানে, মন যেখান হৃদয় সেখানে…..
সন্ধ্যার ছায়া নামে এলোমেলো হাওয়া….
গানের প্রতি অবাধ্য আকর্ষণ বলেই ছেলেটি জানে গানগুলো সেই আশি নব্বই দশকের।ইউটিউবে সার্চ দিলেই পাওয়া যায়। দু একটা নতুন করে রিমিক্সও করছে কেউ কেউ।
সবগুলো গানের অক্ষরে অক্ষরে প্রমত্তা প্রেমের জোয়ার।আর খাতার আর শেষ পৃষ্ঠায় দু লাইন ইংরেজি, উই লাভ ওয়ান এনাদার অর ডাই…একটা অজানা গল্পের সন্ধান দেয়। এই ঘরে,এই ট্রাঙ্কে একটি খাতার লালচে বাদামি পাতাগুলোতে অভিমানে ঘুমিয়ে থাকা একটা গল্প আছে হয়তো জানাই হতোনা এই লকডাউন না এলে। পাঠক আপনাদের তো নয়ই ছেলেটিরও নয়।
অন্তর্জালে গানের লাইভ আর উপস্থাপকের কচকচানি ঘাঁটতে ঘাঁটতে এখন প্রায়শই তার ঘুমাতে ঘুমাতে রাতের অর্ধেক পার হয়ে যায়। ভাগ্যিস এই মহামারী, লকডাউন এসেছিল। নইলে রক্তে প্রবাহিত স্রোতের অন্তর্গত টানটা যেমন জানা হতোনা তেমনই ইউটিউবের বাইরে এই কালের ট্রেন্ডদের লাইভও তার কখনো দেখা হতো না। এই অন্তর্গত স্রোতই হয়তো রক্তে ঢোকে তার নতুন টানাপোড়নের জীবনকে
স্বপ্নের রঙ দিয়েছে। নইলে কল্পনাকে হার মানানো এমন খাওয়া না খাওয়া অচেনা আতঙ্কের দিনে বেঁচে থাকাই তো মুশকিল ছিলো।
রাস্তার পাশে জমে থাকা পানি ছিটিয়ে যেভাবে ভিজিয়ে যায় বড়লোকের দামি গাড়ি, ভ্যাপসা গরমে তেমনি ভেজা গায়ে নিজেকে বিছানায় হাঁটুভাঙা দয়ের মতো নিজেকে আবিষ্কার করে তবু শুয়েই থাকে সে। ইলেক্ট্রিসিটি নেই, গরমে গা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে ভাদ্রের আগাম আঁচ। নিজের কপালকে দোষারোপ করে মায়ের বিড়বিড় চলতে থাকে অনুচ্চস্বরে। পৌরসভার বারোয়ারি কলের জল না আনতে পারার আকাশ মাথায় ভেঙে পড়লেই মা এমন বিড়বিড় করে। নইলে ঘরে চাল নেই, ডাল নেই, বাসা ভাড়ার টাকা নেই ইত্যাদি সমস্যা মায়ের কাছে বেঁচে থাকার মতোই স্বাভাবিক। নির্বিকার মেনে নেয়। খাওয়া, ঘুম,সঙ্গমের মতোই স্বাভাবিক।
আমরা দেখি সেই দুপুরে এই নির্বিকার, নিরুত্তাপ মা হঠাৎই কেমন বিনামেঘে বজ্রের মতো চমকে ওঠেন।ছেলের হাত থেকে ছোঁ মেরে খাতাটা নিয়ে নেন। এমন ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেন যেনো খুব আদুরে কোন দুরন্ত প্রেমিক।সে পুরুষ হয়েছে বটে, নারীর বুকে সে শিশুই কেবল।মায়ের খাতায় সেই আদুর যুবক, মাতাল প্রেমের গল্প অভিমানের আফিমের ঘোরে ঘুমাচ্ছে স্পষ্ট বুঝা যায়। মায়ের চোখে কি অজানা গল্পের অশ্রু হঠাৎ ঝিনুকের কষ্ট নিয়ে মুক্তোদানার মতো চিকচিক করে? গল্পটা যাই হোক, ছেলের কৌতুহলের উনুন নিয়ন্ত্রণহীন হয় গানের খাতা ঘিরে। তার মা গান করতো। তার রক্তে গান। যেনো একান্ত সাম্রাজ্যের যুবরাজে অভিষিক্ত করেন ছেলেকে, তুই যে মোবাইলে সারাদিন গান শুনছ, এই গানকয়টা আছে? গেয়ে শুনাইবি একদিন?
ধরুন তার নাম রুবেল। নামটা গল্পের খাতিরে আমার দেয়া। তার নাম সুমন, শোভন, ফাহিম ইত্যাদি যে কোন একটা কিছু হতে পারতো। সাধারণত এ ধরনের ছেলেদের যা নাম হয়, চিন্তা ভাবনার গভীরতাহীন সময়ের স্রোতে যে নামগুলো ভেসে বেড়ায়। তার একটা টুপ করে তুলে নিয়ে ছেলের উপর বসিয়ে দেয় ঘরভরতি স্বজনেরা। প্রসববেদনা ক্লান্ত মায়ের কোন আগ্রহই থাকেনা নামের প্রতি, আর জীবিকা ক্লান্ত বাবা ছেলে হয়েছে শুনেই দৌড়ায় ভুষিমালের দোকানে, দেরি হয়ে গেছে।মালিকের খ্যাকরি শুনতে শুনতে যদিও অভ্যাস হয়ে গেছে কিন্তু ব্যাটা কমিন কমজাত বেতন কেটে রেখে দেয়। ছেলের নাম নিয়ে ভাবার আদিখ্যেতা তার দেখালে চলে না। কিংবা দেখানোর চিন্তা মাথায়ও আসে না। যেমন ভার্সিটি পড়ুয়া যুগল নামের চিন্তায় রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটায়।
অপ্রাসঙ্গিক নাম নিয়ে কথা বেশি হয়ে যাচ্ছে। গল্পের জন্য যা একটু আধটু প্রয়োজন বটে, কিন্তু খুব বেশি নয়। এরকম নামকরণের ইতিহাসটার সাথে কান টানলে মাথা আসার মতো পারিবারিক পরিস্থিতিটাও প্রকাশ্য হয় আর ভবিতব্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ওর জেগে থাকার সম্ভাবনা আঁচ করে মায়ের মুড বদলে যায়। মায়ের বয়স পঞ্চাশের ধারেকাছে। মায়ের এখন মেনোপজ আর মুড সুইংয়ের সময়। মা অবশ্য এসব জানেনা। রুবেল জানে অন্তর্জালের কারণে। মাকে সে দেখে গভীর অভিনিবেশে, মায়ের হাতে অন্তর্জাল নেই, তাই হয়তো মায়ের মাঝে মুড সুইংয়ের ব্যাপারও নেই। রুবেল জেগে আছে টের পেয়েই মায়ের বিড়বিড় থেমে যায়। প্রবল উৎসাহে মা গায়ে বিশ্বাসের হাত রাখে, আব্বা কাইল যে কইলি ঘটনা সত্য?
রুবেল একলাফে উঠে বসে। নিজের স্বপ্নের উপর তার যতোটা ভরসা, তার চেয়ে অনেক বেশি ভরসা তার মায়ের। মায়ের ভরসাতেই ভরসা দিতে চায় সে। ঘরের নিত্য সমস্যায় বিপর্যস্ত মাকে একটু স্বস্তি দিতেই রুবেলের এই অতিউৎসাহী ভূমিকা, হ মা সইত্য।একদম সইত্য। সইত্য সইত্যঈ তোমার পোলা শিল্পী হইছে। আই সি ইউ থেকে বের হওয়া ডাক্তারের মতো নকল উচ্ছ্বাস দেখায় রুবেল। আকৈশোর স্বপ্ন দেখেছে সে, একদিন বড় শিল্পী হবে। অনেক টাকা বায়না করে লোকে তাকে নিয়ে যাবে গানের আসরে। তার সুরে উন্মাতাল হবে সম্মিলিত জনতা । মাকেই একমাত্র নির্দ্বিধায় শোনানো যায় এই স্বপ্নের কথা। পৃথিবীতে একমাত্র মাই ছেলের আকাশ কুসুম স্বপ্ন বিশ্বাস করে।
মায়ের চোখদুটো কেরোসিন শেষ হয়ে আসা কুপিবাতির মতো নিভে যাওয়ার আগে দপ করে জ্বলে ওঠে যেনো। কোন এক অজানা কারণে মা বিশ্বাস করে রুবেলের স্বপ্ন সত্যি হবে।হবেই। মাকে নিরাশ করতে গেলে নিজেরও নিরাশ হতে হয়। মিথ্যা বলার ভাণ সে লুকিয়ে রাখে স্বপ্নের অতলে। অথৈজলে ডুবে গেলে মানুষ খড়কুটা আঁকড়ে ধরে। মায়ের কাছে স্বপ্নটা হয়তো খড়কুটার মতোই। প্রবল নিরাশার অথৈজলে নিমজ্জিত হবার কালে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরেছে।
এখন বায়না পাওয়ার সময় নয়। পাড়ায় তিন তিনটা পরিবার চাকরি হারিয়ে ফিরে এসেছে ঢাকা থেকে। ঘরে ঘরে কর্মহীন যুবক যুবতী। অনুষ্ঠানাদির নামে জনসমাগম শুরু হয়নি এখনো। মা এসব জটিলতা টের পায়না, এই হঠাৎ মহামারীর আক্রমণ আর তদজাত বিপর্যস্ততায়ও অসম্ভবকে সম্ভব বলেই সরল বিশ্বাস করে।
রুবেল উপলব্ধি করে তার স্বপ্ন মাকে নয় বরং মায়ের স্বপ্নই আদতে বাতাসে ভেসে বেড়ানো অসংখ্য জলকণার মতো তার স্বপ্নকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই হারমোনিয়াম এই গিটার সব এই অভাবের কুটিরে প্রান ফিরে পেয়েছে, এতোদিন যা কেবলই গরীবের ঘোড়া রোগ হিসাবেই গণ্য হয়েছে।
ইলেক্ট্রিসিটি এলে বাবা গামছায় শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে টিভি ছাড়ে। এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেল, মহামারীতে বিশ্বে মৃত্যুর সংখ্যা নয় লাখ ছাড়িয়ে গেছে, বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ হাজার ছুঁয়েছে, পুনর্বার তৃতীয় দফা ট্রায়ালের অনুমতি পেয়েছে অক্সফোর্ডের ভ্যাক্সিন। রিমোট কন্ট্রোল টিপতে টিপতে বাবা বলে, ও রুবেল আইজ না শুক্কুরবার, জুম্মার পর হাজীর দোকানে টিসিবির মাল দেয়নের কথা। দ্রুত লাইন ধরতে না পারলে খালি হাতে ফিরন লাগবো।এই ত্রাণ – ত্রাণ, সাহায্য-সহায়তার হৈচৈ ফুরিয়ে এসেছে। সবাই পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে পড়েছে জীবিকার খোঁজে। রুবেলও বেরিয়েছে। লকডাউনে বন্ধ হয়ে যাওয়া ভুষিমালের দোকান থেকে এই সপ্তাহ খানেক পর খুলে যাবে ভেবে যে বাবা বাসায় এসেছিল, লকডাউন উঠে গিয়ে সব খুলে টুলে গেলেও বাবা দোকানে আর ফিরে যেতে পারেনি। ডাক না পেয়ে একদিন স্বউদ্যোগে গিয়ে তার খাতা লেখার টেবিলে অন্য লোক দেখে এক কাপ চা খেয়ে প্রায় পঁচিশ বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এসেছে। কোন পক্ষকেই মুখে কিছু বলতে হয়নি।
রুবেল যদিও বা দুটো টিউশনি ফিরে পেয়েছে। তাতেও সারাক্ষণ আতঙ্ক ঝুলে আছে ছাদের কার্নিশ ধরে হাঁটার মতো।হয়তো কোন পরীক্ষাই হবেনা এবছর। এক মাসেরও বেতন হয়নি,এরমাঝেই আবার হারানোর ভয় ক্ষরণের মতো নিত্যযাপনকে খুঁড়ে খুঁড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
টিসিবির মাল নিতে হাজীর দোকানের সামনে পৌঁছে দেখে ওর আগে প্রায় জনাবিশেক লোক এসে লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। পাওয়া কিংবা না পাওয়ার অনিশ্চিত লাইনে দাঁড়িয়ে যেনো সত্যি ফোনটা পেয়েছে এভাবে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়ায় সে। পরদিন কনসার্টে গানের তালিকা ঠিক করে মনেমনে , জলে যাইয়ো না গো রাই..রাধারমণের গান দিয়ে শুরু করবে অনুষ্ঠানটা, রোশনি বলে রাধারমণের গান একদম রাধার আকুতি হয়ে বাজে রুবেলের কণ্ঠে। আসলে এসব রোশনির মুগ্ধতা। রুবেল তো রাধারমণ গায় যুগের চাহিদায়। গ্রামের মিঠে সুর এখন গিটার, কীবোর্ডে শহুরে ফোক হয়ে ওঠেছে। এসব গানের এখন কদর খুব। গলা খুলে গাইতেও পারে রুবেল। গাইবে…..আজ কালিয়ার জলে যাওয়ার জাতের বিচার নাই…. তখনি কেউ কর্কশ সুরে ডেকে ভাবনার রঙিন সুতাটা ছিঁড়ে দেয়, মোঃ রুবেল মিয়া….।
দশ কেজি চাল, দুই কেজি ডাল আর দুই কেজি আলুর বস্তাটা টানতে টানতে সে পরের গানটার কথা ভাবে, সখিগো……সখিরে কই পাবো তুমি বলোনা, সখি আমার….এই মিউজিক,বেজ গিটারের টোনটা বেশি আসছে…পেছন থেকে ধাক্কা দেয় একজন। তাড়াতাড়ি সরেন। দ্যাখেন না বৃষ্টি আইতাছে।
ঘরে ভাত ছাড়া আজকাল কিছু থাকেনা আর। না খেয়েই ঘর থেকে বের হয় ইদানীং । আলুসিদ্ধ ভাত খেতে আর ইচ্ছে করে না। তাও তেল ছাড়া। বরং রোশনিদের বাড়িতে গেলে এক কাপ চায়ের সাথে দুটো বিস্কিট মিলে। বেশ কেটে যায় সকালটা। মাসখানেক ধরে আবার শুরু হয়েছে টিউশনি। মাস ফুরালে কিছু টাকা আসবে হাতে। আহা কি গেছে দুতিনটা মাস। একটা বিড়ি কিনে কালভার্টের উপরে বসে দুঃখী গান গাইবে সে সুযোগও ছিলো না। দুটাকাও পকেটে ছিলো না,এমন হয়নি বিড়ি ধরার পর থেকে। বাবার পকেট কাটতে হয়নি। প্রাইভেট টিউশনের সহজলভ্য উপায়টার সন্ধান পেতেই টানাপোড়েনের খালের উপর একটু নির্ভার থাকার বাঁশের সাঁকো পার হবার খুঁটিটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল। সেঈ স্কুলের গণ্ডি পার হবার পর থেকেই। রোশনির সাথে তো টিউশন বাড়িতেই পরিচয়।রবিনের বোন।লকডাউনে রবিনের বাড়ি দিয়েই আবার টিউশনি শুরু। টিং করে তখনই মোবাইলটা জানান দেয়,রোশনি যাবার তাড়া দিচ্ছে।
কলেজ ভার্সিটি খুলেনি বলে রোশনি এখনো বাড়িতে। রোশনির জন্যই টিউশনিটা আবার ফিরে পেয়েছে সে। রোশনি কলেজে ভর্তি হবার পরদিন প্রথম মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছিল রোশনি। তারপর পৃথিবীতে কতোকিছুই বদলে গেছে, রোশনি ডাক্তারি পড়তে গেছে, পৃথিবীতে একটি মহামারী এসেছে। কিন্তু রোশনির চোখের রঙিন চশমার রং বদলায়নি খুব একটা। মায়ের মতো সেও বিশ্বাস করে, রুবেল একদিন বড় শিল্পী হবে। রুবেল জানে, এই বড় শিল্পী হবার স্বপ্ন তার সঙ্গ না ছাড়লেও রোশনির রঙিন চশমায় লটকে থাকা মোহ ধূসর হতে সময় নেবে না। কিন্তু আপাতত রোশনির আগ্রহের মূল্য তাকে দিতেই হবে প্রচণ্ড অনাগ্রহ নিয়েও।
ঘর থেকে বের হতে হতে টিভির খবরটা কানে যায়। করোনার জন্য এবছর অনুষ্ঠিত হবে না পি ই সি ও জে এস সি পরীক্ষা। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। টিউশন বাড়িতে গিয়ে না শুনতে হয়, আর পড়াতে আসতে হবে না! দ্রুত পায়ে বাইরে আসে সে। মাকে বুঝতে দেয়না আতঙ্কের হাবুডুবু।
মায়ের শিল্পী হওয়ার শখ ছিলো। গানের স্কুলে সহশিল্পী আলমের সাথে এক মঞ্চে গান গাইতে গাইতে কখন যে
দুজনেরই বাঁকা নয়নে নেশা লেগে গেলো টের পায়নি কেউ। বাউলা, বাউন্ডুলে ছেলে আলম। গান ছাড়া আর কিছুই জানেনা। মেয়ে না অকূল সাগরে পড়ে! বাবা তাই গান ছাড়িয়ে তাড়াতাড়ি পাত্রস্থ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিল। মায়ের শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন হারিয়ে গিয়েছিলো দুবেলা দুমুঠো খাবারের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতিতে। পাঠক, ছেলের গানের বায়না এসেছে শুনে মা যখন গল্পটা ছেলের কাছে বলে, তখন আমাদেরও জানা হয়ে যায়। ছেলের শিল্পী হওয়ার স্বপ্নতে কেন মায়ের স্বপ্নরা চিকচিক করে। মা অন্তর্জালের খবর জানেনা। আলম আলীর মিউজিক ভিডিওর এখন লাখ লাখ ভিউয়ার্স। আলম আলী আজ লন্ডন তো কাল নিউইয়র্ক করে বেড়ায়। জনপ্রিয়তা আর প্রাজ্ঞতার সমন্বয়ে তাকে এখন দেশে বিদেশে সবাই একনামে চিনে।থাক এসব কথা মাকে বলে লাভ নেই। মায়ের স্বপ্ন থাকুক মায়ের কাছে।
ঘর থেকে বের হয়ে রুবেল দ্রুতপায়ে হাঁটে রবিনদের বাড়ির উদ্দেশ্যে । রবিনের মাকে বুঝাতে হবে, আন্টি স্কুলে নিশ্চয়ই মূল্যায়ন হবে। পড়তে হবে। মোটেই পড়া ছেড়ে দিলে হবে না। নইলে শুধু রোশনির কথায় টিউশনিটা বোধহয় টিকবে না। আহা গল্পটা স্বপ্ন থেকে এমন নির্দয় লড়াইয়ের দিকে হেঁটে যাবে আমি বুঝতে পারিনি।