শ্রুতি গোস্বামী

সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের প্রধান তফাতের জায়গাটা সবাই জানেন, উপাদানে। সাহিত্যের উপাদান ভাষা, শব্দ, আর চলচ্চিত্রের, মুখ্যত, দৃশ্য ও ধ্বনি। শুনতে সোজা, কিন্তু ব্যাপারটায় গোলমালও আছে। একটা ঘটনাকে আমি আমার ভাষায় মজুত শব্দের ভাঁড়ার থেকে শব্দ নিয়ে-টিয়ে প্রত্যক্ষভাবে বর্ণনা করলাম, আর সেটা পড়ে একজন দৃশ্য-নির্মাতা সেইরকম উপকরণগুলো কাজে লাগিয়ে ঘটনাটা দৃশ্যায়িত করলেম। কিন্তু একটা ভাবনা বা আইডিয়াকে তো এভাবে দৃশ্যরূপে গাঁথা সহজ নয়। মানে, ‘জাহাজের পালে বাতাস লাগল’— একে দৃশ্যায়িত করা সহজ, কিন্তু ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া’— একে কীভাবে সম্পূর্ণ রূপ দেওয়া যায়? অমল আর ধবল, অর্থাৎ ফটফটে বা ফুটফুটে সাদা একটি পাল দেখানো গেল, মন্দ, অর্থাৎ মৃদুগতি হাওয়াও মোটামুটি দেখানো গেল, কিন্তু ওই ‘মধুর’? ওখানে গিয়েই আটকে যেতে হবে। মধুর হাওয়া-র উপস্থিতি তো কেবলই বক্তার মনে, তা কি আদৌ কোনো বাস্তব দৃশ্য? নাকি দৃশ্যের মাধ্যমে সেই হাওয়ার মাধুর্য সরাসরি বোঝানো যায়? এখানেই ব্যাপারটা সাবজেক্টিভ হয়ে যায়, ফলে, জটিলও।

সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের আন্তঃসম্পর্ক প্রসঙ্গে ‘নষ্টনীড়’ আর ‘চারুলতা’-র সম্বন্ধ নিয়ে অগুনতি কথা হয়েছে। তবু আমি একটু কম চর্চিত একটা প্রসঙ্গের কথা বলি। চারু ও অমলের সম্পর্ককে সম্ভবত এখনও বাঙালি পাঠক বা দর্শক ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, বারবার অকারণে সরলীকৃত করে ফেলেছে। সত্যজিতের ছবি কিন্তু আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের তৈরি করা সেই রহস্যকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। প্রেম নয়, অবৈধ কাম নয়, অথচ তার গূঢ় সম্ভাবনা প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে সেই সম্পর্কের জটিল অন্ধকারের ভিতর, কিন্তু তাকে নগ্ন করে দিলে সেই রহস্যের সৌন্দর্যটিই ভেঙে যাবে, তাই দৃশ্যনির্মাতা সচেতনভাবে সেই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে বিরত। রবীন্দ্রনাথ গল্পে লিখেছেন, চারু আর তার দেওর অমলের একান্ত গোপন যৌথতার জায়গা ছিল সাহিত্যচর্চা। অন্তত চারু সেই নিভৃত অঞ্চলে কাউকে প্রবেশাধিকার দিত না। দুজনে একান্তে অকর্ষিত অবহেলিত বাগানে ‘সাহিত্যের রস’ পেতে আরম্ভ করে। দুজনের সান্নিধ্যের সেতুই হয়ে ওঠে লেখালেখি। এই অংশের বর্ণনায় কথক বা ন্যারেটর হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “সাকী ছিল নবীনা, রসনাও ছিল নবীন, আর অপরাহ্ণের আলোক দীর্ঘ ছায়াপাতে রহস্যময় হইয়া আসিয়াছিল।” এই বর্ণনা তো চূড়ান্ত আইডিয়াকেন্দ্রিক! শুধু আলো-ছায়ার shade দেখিয়ে তো একে দৃশ্যায়িত করা যাবে না! এই অপূর্ব কাব্যিক বর্ণনার মধ্যে desire-এর একটা তীব্র উপস্থিতি আছে। সিনেমায় দেখানো হলো, বাগানে মাদুরে শুয়ে লিখছে অমল, চারু অপেরা গ্লাস দিয়ে তার লেখা পড়ছে, তারপর ফুল-পাতা-পোকা ইত্যাদি দেখে দূরে একটি শিশুকে কোলে নিয়ে খেলা করা মা-কে দেখছে, তারপর আবার অমল, তবে অমলকে চারুর এবারের দেখা অন্যরকম। অমলের কথায় ঘোর ভাঙার আগের মুহূর্ত অব্দি চারুর চোখমুখে দেখা গেল ওই রহস্যময় ‘অপরাহ্ণের আলো-ছায়া’। সেই দৃষ্টিতে বিষাদ, সংরাগ, কামনা, উদ্দীপনা, আক্ষেপ, গ্লানি, সবকিছুই মুহূর্তের মধ্যে খেলা করে গেল। আশ্চর্য অভিব্যক্তি! তার চেয়েও আশ্চর্য এই দৃশ্যের পরিকল্পনা!

সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র করার ক্ষেত্রে narrative technique একটা অত্যন্ত জরুরি ভূমিকা নেয়। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে এতে ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের আশ্চর্য ছায়া রয়েছে। এই সম্বন্ধ প্রকটরকমের নয়। আসলে একটা গল্প তো একটা ন্যারেটিভ, সেখানে কে ন্যারেট করছে, বা কার চোখ দিয়ে আমি ঘটনাগুলো দেখছি, এটা খুব জরুরি বিষয়। তেলেনাপোতা আবিষ্কার-এর ক্ষেত্রে একজন অদৃশ্যরকমের ন্যারেটর আছেন, যিনি পাঠককে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন, সব ঘটনা তিনিই দেখান, কিন্তু নিজে কেমন ছায়ার মতো মিলিয়ে যান, ওই তেলেনাপোতা কিংবা মোহিনী গ্রামের মতো। কিংবা ধরুন, মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ সিনেমা রমাপদ চৌধুরীর যে উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি, তারও প্রধান বদলের জায়গা কিন্তু এই ন্যারেটিভ পয়েন্ট। খারিজ উপন্যাস আদ্যন্ত লেখা হয় উত্তমপুরুষে, মানে ‘আমি’-র বয়ানে। যে প্রধান চরিত্র, insider, জয়দীপ, সে-ই তার জীবনের কথা বলে নিজের মুখে। সিনেমায় তো জয়দীপের জীবন দেখাতে হবে, জয়দীপকে দেখাতে হবে। লাগবে ক্যামেরার চোখ। ক্যামেরা outsider হিসেবে কথা বলতে পারলো। ক্যামেরা দেখালো তিন তলা বাড়ি,- উপরতলায় বাড়িওয়ালা, দোতলায় ভাড়াটে জয়দীপ-অদিতি বা অঞ্জন-মমতা, আর নিচে, সিঁড়ির তলায় শুয়ে থাকা ‘কাজের ছেলে’ পালান আর হরিকে। সামাজিক হায়ারয়আর্কি বাড়ির রূপকের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেল। সিনেমার শেষ দৃশ্যে জয়দীপ-জাতীয় মধ্যবিত্ত নিরাপত্তাভোজী মানুষদের উদ্দেশে চূড়ান্ত বিদ্রুপটিও কষানো গেল ক্যামেরার ‘নিরপেক্ষ’ চোখের জন্যেই। শীতের রাতে বদ্ধ রান্নাঘরে শুয়ে কার্বন-মোনোক্সাইডের বিষে মৃত পালানকে দাহ করে তার প্রৌঢ় বাবা আর গাঁয়ের লোকজন যখন ফেরে ‘শ্মশানযাত্রী’ হিসেবে, তখন অপরাধবোধের প্রতিক্রিয়ায় বিব্রত সন্ত্রস্ত বিরক্ত অঞ্জন দাঁড়িয়ে থাকে সিঁড়ির মাঝখানে। এ তো তার মধ্যবিত্ত দ্বিধারই ছবি। আর পালানের বাবা হারান ক্রমশ উঠতে থাকে সিঁড়ির দিকে, অপরাধবোধতাড়িত অঞ্জন ভাবে এই বোধহয় তাকে আঘাত করলো হারান, কিন্তু না, হারান যাবার আগে তার শেষ নমস্কার জানিয়ে যায় মাথা ঝুঁকিয়ে। ‘ভদ্দরলোক’ অঞ্জন যেন আরোই ছোট হয়ে যায় ‘ছোটলোক’ হারানের কাছে, যাদের গায়ের গন্ধ, জামাকাপড়ের রং, মাটিতে বসার ধরণ, শোকের উচ্চকিত প্রকাশ, কোনোটাই ঠিক ‘নিতে’ পারে না বাবুরা।

শেষ যে কথাটা বলার, সাহিত্য আর সিনেমার মাঝখানের সময়-এর কথা। সাহিত্য যে সময় লেখা, আর সেই সাহিত্য নিয়েই তৈরি সিনেমা যে সময়ে তৈরি, দুয়ের প্রভেদ খুব জরুরি হয়ে ওঠে অনেকসময়। ঋত্বিক ঘটকের খুবই underrated, উপেক্ষিত সিনেমা ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’। ছোটদের ছবি তো, তাই ধর্তব্যে আনা হয় না যেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শিবরাম চক্রবর্তীর ১৯৩৭-এ লেখা উপন্যাস আর ঋত্বিকের ১৯৫৯-এর সিনেমা, দুয়ের মধ্যে যে দগদগে ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে, তা হলো ১৯৪৭-এর দেশভাগ। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ও আরো সমস্ত আনুষঙ্গিক কষ্ট পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে এই সিনেমায়। উপন্যাসের রংচঙে অ্যাডভেঞ্চার সিনেমায় একটা নতুন দর্শন পায়। রাস্তার মিছিলে লেখা থাকে ‘বাস্তুহারা’-দের কথা, গ্রামীণ প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার পার্টিশানে শহরে এসে বুলবুলভাজা বিক্রি করতে বাধ্য হয়, বাউলের কণ্ঠে শ্যামল মিত্র গেয়ে ওঠেন, ‘পদ্মাপারের চরে আমার ছিল রে ঘরবাড়ি’, আর কইলকাত্তা নামক আজব শহরের ঝাঁ-চকচকে বহুতল থেকে ক্যামেরা ঘুরতে থাকে ফুটপাথে, বস্তিতে, ঝুপড়িতে, খালপাড়ে। প্রতিটি গান, প্রতিটি নতুন-পুরনো চরিত্র, প্রতিটি সংলাপ ওই সময়ের ব্যবধানটাকে মনে পড়াতে থাকে। ছেলেমানুষ কাঞ্চনের রোমাঞ্চকর কাণ্ডকারখানার মধ্যে ঢুকে পড়ে সাতান্নর কলকাতা শহরের দুঃখ। রেসের মাঠ থেকে প্রচুর টাকার অংশীদার হয়ে আর ফেরে না সে, কিন্তু তার প্রাপ্তি হয় আরও অনেক বড় মাপের বস্তু— হরিদাসের ইয়াব্বড় ঝোলা আর নকল দাড়ি; যে প্রতীকী ভালোবাসাকে সম্বল করে সে আবার নতুন কোনো রাস্তায় হাঁটতে পারে। এই পরিবর্তনই এক শিল্পমাধ্যম থেকে আরেক শিল্পমাধ্যমে রূপান্তরের লক্ষ্য। শুধু প্রযুক্তিকৌশলগত প্রভেদ নয়, শুধু প্রকাশভঙ্গির তফাৎ নয়; শৈল্পিক সরণ, দার্শনিক উত্তরণ।