সালেহা চৌধুরী

জুবাইদা শামিমা করিম একজন ডাকসাইটে বস। যদিও বয়স তার সাতাশ। আগুনের মতো রং আর রূপ এবং গনগনে দুপুরের রোদের মতো প্রখর ব্যক্তিত্ব। শামিমার বাবা ‘দি গ্লোবাল ইকোনমি অ্যান্ড পাওয়ার অফ থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির’ প্রধান ছিলেন। শামিমার বাবা রেজউল করিম একজন উজ্জ্বল বিসনেস ম্যাগনেট। তাঁরও ছিল একেবারে গনগনে সূূর্যের মতো ব্যক্তিত্ব। সস্তা শ্রমিক, সস্তা শ্রমিক জাত নানা জিনিস, এবং শ্রমিক সরবরাহ এইসব নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই ব্যাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ছেলে মশিউল রেজা করিম এসবে গুডবাই জানিয়ে সুইজারল্যান্ডে চলে গেছেন, সুইস মেয়েকে বিয়ে করে এই পৃথিবীকেই স্বর্গ করে তুলছেন। দুই পাহাড়ের মাঝখানে তার ভিলা। চমৎকার আছে। —বাবার মতো রোগে ধরেনি আমাকে। মানুষ বাঁচে তো একবার। এইসব ঝুটঝামেলায় জীবন নষ্ট করবার মতো সময় নেই আমার হাতে। তাহলে বাবার এই বিশাল বিজনেস এম্পায়ারের দায়িত্ব কে নেবে? মেয়ে? যে মেয়ে বড় হয়েছে বিদেশের বোর্ডিং স্কুলে। পড়েছে অনেক কিছু। জার্মানিতে দুই বছর বিজনেস স্টাডিস শেষ করে ফিরে এসেছে। বললো স্বাভাবিক গলায়— তাহলে আমাকেই তো দায়িত্ব নিতে হবে।
এবং একদিন এসে বসে বাবার চেয়ারে। অফিসের সমস্ত কর্মচারীকে সচকিত করে। একজন ছত্রিশের তরুণ সেক্রেটারিকে নিয়োগ করেন। যিনি এখনো বিয়ে করেননি। এবং সবকাজেই অসাধারণ। তাঁর ইন্টারভিউ নিজেই নিয়েছিল শামিমা। বাবার ষাট বছরের ‘ভালো’ সেক্রেটারিকে বাদ দিয়ে।
আপনি এমন কী দিতে পারবেন যা অন্যরা পারবে না।
অন্যদের চাইতে আমি কতটা ব্যতিক্রম জানি না। তবে অফিস ও ব্যবসার ‘সিকরেট’ রক্ষা করাই আমার প্রধান কাজ হবে। আমি কাজে ফাঁকি দেই না। আমার সংসার বলতে একটা কাজের ছেলে। এ ছাড়া আর কেউ নেই। প্রয়োজনে আমি অনেকবেশি সময় দিতে পারি।
আপনি তো কখনো এ কাজ করেননি। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিজনেস স্টাডিস’ পড়াতেন। অভিজ্ঞতা নেই সেক্রেটারির কাজের।
তা নেই। সুবিধা এই আগে এই কাজ আগে করিনি বলে সে কাজকে ভুলবার ব্যাপার নেই। মানে আগেরটা ভুলে পরেরটা নতুন করে শেখা। এখানে আমি নতুন এবং ফ্রেশ। আমার শুভবুদ্ধি আমাকে সাহায্য করবে।
মনে করেন আমরা দুজন নদীতে। একটি নৌকা। দুজনের ভারে ডুবে যাবে বলে একজনকে নামতে হবে। আপনি তখন কী করবেন?
নামবো। আমি সাঁতার জানি।
নদীতে কুমির আছে।
একটু থেমে বলে— তখন আমি আর আপনি একটা বুদ্ধি বের করে ফেলবো। যেন দুজনেই বাঁচতে পারি। আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমতি আমিও নির্বোধ নই।
ভালোকথা। আপনার নাম অপার কাজল কেন?
অপার আমার নাম। কাজল আমার মায়ের ডাকনাম। আমরা সবসময় বাবার নামটাকে নিজের নামের সঙ্গে দেখতে পাই। আমার নাম ছিল অপার মাহমুদ। বাবার নামের মাহমুদ যুক্ত ছিল আমার নামের সঙ্গে। পরে আমি বদলে অপার কাজল করি।
হবি কী?
অনেক কিছু। টবের বাগান, টিকিট সংগ্রহ, গান শোনা, রান্না আর বইপড়া।
রান্না? এ দেশের ছেলেরা তো রাঁধে না।
আমি রাঁধতে ভালোবাসি।
এরপর আরো কিছু প্রশ্ন করে শামিমা তাকে যেতে বললেন। বললেন— কী হলো জানতে পারবেন। তবে আগের চাকরি ছেড়ে এটা কেন নিতে চান বলেননি?
ভালো বেতন। চাকরিটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিতে চাই। এ টাকায় আমি বাগান ও জীবনকে আরো একটু সুন্দর করতে পারবো।
আপনি কী একা? এতদিন বিয়ে করেননি কেন?
একজনকে ভালোবাসতাম। ও ফট করে আর একজনকে বিয়ে করে ফেলে। তারপর দেখলাম আমার নিজের সংজ্ঞটাই বা মন্দ কী। বেশ আছি।
অপার কাজল চলে যান।
সাতদিন পর চিঠি পান চাকরিটা হয়ে যাবার। তাঁকে গুলশানের হেডঅফিসে কাজ করতে হবে। জুবাইদা শামিম আরা করিম তাঁর বস। গুলশান আর বাবিধারার শেষ প্রান্তে থাকেন অপার কাজল। যেখানে ছোট একটা বাড়ি আর বাগান। বাবার কেনা। বাবা মারা গেছেন। মাও নেই। তিনবোন ইউরোপ আর আমেরিকায়। তাঁকে নিয়ে ভাবনা করবার কেউ নেই। তাঁর ভাষায় তিনি বেশ আছেন।
কড়া বস। কখনো তাঁকে হাসতে দেখা যায় না। কেবল হঠাৎ ঠোঁটে মুহূর্তের জন্য একটুখানি হাসি জেগে উঠে মিলিয়ে যায়। তিনি ঘড়ি ধরে কাজে আসলেও চলে যান। তবে কোনো কোনো দিন দেরিতে যান। তার গাড়িতে ও টেবিলে বই। কাজের ফাঁকে পড়তে ভালোবাসেন। বাবার ব্যবসা এখন দিন দিন বড় হতে হতে এই পৃথিবীর সমস্ত গ্লোবকে দখল করে ফেলছে। তিনি অপার কাজলের কাজে খুশী। সেটা মুখে বলেন না। তবে যে কয়েকজনকে আসার পর ছাঁটাই করছেন তাদের মধ্যে অপার কাজল নেই। নতুন লোক তিনি নিজে নেন। একা ইন্টারভিউ করেন। কেমন করে বাজান বা বিচার করেন সে টা কাউকে দেখতে দেন না। কাজল সেক্রেটারি হয়েও সে ব্যাপারে কোন কিছু জানতে পারে না। বুঝতে পারে শামিমা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো উদ্বেগ পছন্দ করে না। একদিন যখন রাত আটটা পর্যন্ত তিনি কাজ করছিলেন অপার বলেছিল— ম্যাডাম আপনার জন্য কী কোন খাবার অর্ডার করবো?
না।
আপনি দুপুরে কেবল একটা আপেল খেয়েছিলেন।
খাবার দরকার হলে আমি নিজে বলবো। আপনি আপনার কাজ করে যান। এই মাসে কয়দিন ওভারটাইম করলেন সেটা বেতনের কেরাণিকে জানিয়ে দেবেন।
শামিমার প্রখর ব্যক্তিত্বে তেমন করে কেউ কাছে যেতে পারে না। অপার কাজলও নন। একদিন একটি ঘটনা ঘটলো। ওদের গার্মেন্টস কারখানায় বিদ্যুতের কারণে আগুন লেগে কয়েকজন মারা গেলেন। কয়েকজন আহত হলেন। শামিমা এই ঘটনায় খুবই দুঃখিত। তাঁর গর্ব ছিল তার কয়েকটি কারখানা দুর্ঘটনা মুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কিছু এখনো দুঘর্টনা মুক্ত নয়। শামিমা ভাবছেন কী করে এই পরিবারগুলোকে সাহায্য করতে হবে তখনই একদল হুল্লোড়ে লোক তার গুলশানের অফিসে ঢুকে পড়ে তাণ্ডব শুরু করতে শুরু করেছে। —এই সব কারখানা মালিক নিপাত যাও। ইত্যাদি। অপার কাজল শামিমার ঘরে ঢুকে বলেন —এখুনি আমার মোটর সাইকেলে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে চলে যাওয়া ভালো। ওদের সঙ্গে এই মুহূর্তে কথা না বলতে চাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
শামিমাকে মোটর সাইকেলে তুলে নিয়ে অপার কাজল এ রাস্তা সে রাস্তা ঘুরে শামিমাকে তার বাড়িতে নয়, তাঁর একটি অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দেন। বলেন শামিমা— আজ এখানেই থাকি। বলা তো যায় না, ওরা যদি বাড়ি পর্যন্ত চলে আসে। অপার কাজলকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি উপরে চলে যান।
পরদিন কাগজে এইসব পরিবারকে সাহায্য করবার কথা ওঠে। শামিমা এদের সকলকেই কিছু সাহায্য দেবেন ঘোষণা করেন।
এরপর অপার কাজল খানিকটা কাছে আসেন। দু একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
লোকটি নিজের পরিচয় দেয় একজন বিজনেস ম্যাগনেট হিসাবে। যিনি আমেরিকায় একটি বড় ‘সুপার স্টোর’ দিয়েছেন। ঢাকা আমেরিকা তাঁর ব্যবসা চলে। তিনি একদিন অপার কাজলকে ডাকেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
কারণ কী?
এলেই বলবো। বলেন সেই ভদ্রলোক। নাম বলেন বাশার মুর্তজা।
ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা বড় হোটেলে দেখা করতে যান। ভদ্রলোক তার সঙ্গে চা পান করতে করতে যে কথা বলেন সে এই— জুবাইদা শামিমা করিমকে তাঁর খুব পছন্দ। তিনি তাঁকে বিয়ে করতে চান। এবং ঘটকালির কাজটা তিনি অপার কাজলকেই করতে বলেন। অপার কাজল বিষম খায়। কী সাংঘাতিক এমন বিয়ে-টিয়ের কথা তিনি কিভাবে শামিমাকে বলবেন। যার খাওয়া নিয়ে উদ্বেগও পছন্দ নয় তাকে বলবেন বিয়ের কথা? বাশার মূর্তজা নাছোড়বান্দা। বলেন— আমার পরিচয় দেবেন। বলবেন আমি কেমন মানুষ। আমার ব্যবসা, চেহারা ছবি সবকিছুই তাকে বলবেন।
স্যার আপনি একদিন নিজে একটা অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে কথাটা তাঁকে নিজে বলুন না। আমি এসব বলতে পারবো না। কিন্তু বাশার মূর্তজা ‘না’ শুনতে রাজি নন। বলেন— আপনি বললে কী আপনাকে খেয়ে ফেলবে।
ঠিক তা নয় তবে আমরা এসব আলোচনা করি না।
করেন না করবেন। উনিতো একদিন বিয়েথা করবেন নাকি করবেন না?
সেটা তো আমার জানার কথা নয় স্যার।
ঠিক আছে। একটু চেষ্টা করতে দোষ কী?
অপার কাজল ঠিক কথা দেন না বলেন— ঠিক আছে স্যার আমি চেষ্টা করবো।
সেদিন কাজে আটকে পড়েছেন শামিমা। তিনি প্রায়ই আটকে পড়েন। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি। মনে হয় এসব থেমে গেলে তিনি বাড়ি যাবেন।
অপার ঘরে ঢোকেন। তাঁর হাতে মূর্তজা বশীরের নেম কার্ড। গ্রিন টি আর আদার কেক শামিমার সামনে। হাত দুটো পেছনে রেখে শামিমা কী ভাবছেন। তিনি অপার কাজলের দিকে একটু স্মিত হাসিতে তাকান। তখনি অপারের মনে হয় হয়তো কথাটা এখন বলা যায়। কিন্তু ঠিক কী ভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারেন না।
কিছু কী বলতে চান? গলার স্বরটা সূর্যের মতো প্রখর নয়। একটু মেদুর।
আমি ভয়ে বলবো না নির্ভয়ে বলবো। অপার কাজল প্রশ্ন করেন।
বেতন বাড়ানোর ব্যাপার নাকি? এবার আপনার বেতন বাড়বে। দুই বছর আপনি যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করেছেন।
সে নিয়ে ভাবছি না। বেতন যা পাই তাতে আমি সন্তুষ্ট। নিয়মিত পাওয়াটাই আজকের দিনের খবর।
বলেন— আচ্ছা ম্যাডাম আপনি কী বাশার মূর্তজা বলে কাউকে চেনেন?
নাম শুনেছি। পরিচয় নেই।
ও আপনার সঙ্গে একদিন দেখা করতে চান। অপার কাজল বিজনেস কার্ডটি টেবিলে রাখেন। শামিমা কার্ডটি উল্টেপাল্টে দেখেন। বলেন— কারণ বলতে পারেন কেন?
একটু চুপ করে থেকে অপার বলেন— পারি ম্যাডাম।
তাহলে দেরি করছেন কেন বলে ফেলেন কারণ কী?
অপার কাজল বলেন— উনি আপনাকে ভীষণ পছন্দ করেন। যাকে বলা যায় আপনার জন্য ওঁর অনেক ভালোবাসা আছে।
আচ্ছা! এরপর?
মানে ম্যাডাম উনি বলেছেন— আপনি যে শর্ত দেবেন সেটা মেনে নিয়ে উনি আপনাকে বিয়ে করতে চান। যদি বলেন উনি আমেরিকার ব্যবসা গুটিয়ে ঢাকায় এসে থাকবেন, আরো যদি কিছু—
শোনেন এসব ঘটকালি আপনাকে মানায় না। এসব আর বলবেন না।
অপার কাজল মাথা নিচু করে থাকে। তারপর বলেন— ওঁর খুব ইচ্ছা একদিন আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
তিনি রাগতে গিয়ে থেমে যান। বলেন— ঠিক আছে আমি ভেবে দেখব।
অপার কাজলের মনে হয় একটা বিরাট কিছু করে ফেললেন। বলেন— ম্যাডাম উনি আমাকে ভীষণ ভাবে অনুরোধ করেছিলেন কথাটা আপনাকে বলতে। সরি ম্যাডাম আমি যদি কিছু অসংলগ্ন কথা বলে থাকি।
এবার আসুন।
এরপর কিছুদিন চলে যায়। শামিমা এই প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু বলেন না। একদিন আবার কাজে আটকে পড়েছেন। অপার কাজল ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে যায়। ঠিক এমন দৃশ্য তিনি দেখবেন ভাবেননি। শামিমা টিস্যু দিয়ে চোখ মুছছেন। এবার একটু তাঁকে দাঁড়াতে হয়। খানিকপর ঘরে ঢুকে আবার আগের শামিমাকে দেখতে পান। কিন্তু গলাটা ভেজা, তেমন প্রখর নয়।
মে আই গেট ইউ সামথিং ম্যাডাম?
নো। আই ডু নট নিড এনিথিং। তবে কাল যে প্রেস কনফারেন্স হবে আমার ‘ম্যানপাওয়ারের’ নতুন পরিকল্পনার সে ব্যাপারে সব ঠিক ঠাক আছে তো?
জ্বি ম্যাডাম। সব ঠিকঠাক।
আমি আজ কিছু টাকা ডোনেট করেছি। কালও করবো। আজ আমার মায়ের মৃত্যুদিন। অপার কাজলের মনে পড়ে তিনি দেখেছেন টিসুতে ভেজা চোখ মুছছেন শামিমা। বলেন তিনি— দুঃখিত ম্যাডাম।
জানেন অপার কাজল আমার মা বড় দুঃখী একজন। বাবা ব্যবসা ব্যবসা করে তাঁকে সময় দিতে পারেননি। যিনি দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন তাঁকে কয়দিন দেখতে গেছেন আমার বাবা? অপার কাজল এমন করে শামিমাকে অস্থির হতে দেখেননি। শামিমা বলছেন— বাবা মনে করতেন আমার মাকে ফাইভ স্টার হাসপাতালে রাখা আর বাড়িতে চব্বিশ ঘন্টার নার্সের সেবা, এই আমার নির্বিরোধী মায়ের জন্য যথেষ্ট।
সামনের চেয়ারে বসে টিস্যুর বাক্স এগিয়ে দেন অপার কাজল। শামিমা আবার টিস্যুতে চোখ মোছেন। একসময় সাহস করে বলেন— আমি মনে করি একজন মানুষের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সংসারকে ভালো রাখা বা খুশীতে রাখা। এই কথাই বলছিলেন বাশার মূর্তজা। বলছিলেন— ওঁকে বলবেন আমি তেমন ব্যবসায়ী নই বাড়ি এবং সংসার ভুলে যাব। আমার প্রথম কথা বাড়ি, সংসার, পরিবার।
শামিমা টিস্যুতে চোখ মুছে এবার অপার কাজলের দিকে তাকান। বলেন— কবে বললেন এসব কথা?
কবে ঠিক মনে নেই। তবে উনি অল্প দিনের ভেতর আমেরিকা চলে যাবেন। একবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
তিনি কী ভাবেন। তারপর বলেন— আচ্ছা তিনদিন পর কত তারিখ দেখেন।
ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি।
এই বছর বোধকরি লিপইয়ার?
ঠিক এমনি করেই কথা বলেন শামিমা। জানলেও বলেন— বোধকরি। বা আই থিংক। আই গেস। সাপোস সো। বিদেশে থাকার ফল এমন করে ঘুরিয়ে কথা বলা। স্কুল, ইউনিভার্সিটি সবটাই বিদেশে। শানিত, পরিশিলীত একজন।
ওঁকে আসতে বলুন। দেখি আপনার মনোনিত একজনকে। সেদিন কিন্তু আর কারো সঙ্গে কোনো সাক্ষাৎকার রাখবেন না। আমি কথা বলতে চাই। বয়স বাড়ছে। আপনারা তো আমাকে নিয়ে ভাবতেই পারেন। একটু হাসির আভা। একটি দুর্লভ-ক্ষণ।
বাটনহোলে গোলাপ নয় তবে একটি চমৎকার মুক্তো বসানো টাই পিন গেঁথে নিয়েছেন তিনি। মূর্তজা বশিরকে লাগছে কোনো এক সিনেমার হিরোর মতো। তার স্যূট হালকা নীল। শার্টটি উজ্জ্বল। হাসি সাবানধোওয়া পরিচ্ছন্ন। জুতো টোলহীন চোটহীন। দীর্ঘ একজন মানুষ শানিত ইস্পাতের মতো শামিমার সামনে বসেন। অপার কাজল বা আর কেউ সেখানে নেই। দুজনের কী কথা হয় সে কথা কেউ জানে না। লোকটি কেন এসেছে সে কথা আর কেউ না-জানলেও অপার কাজল জানে। মনে মনে বোধকরি অপার দোওয়া পড়ছেন যেন ম্যাডামের পছন্দ হয়ে যায়। বেচারি যতই বলুক না তাঁর কাউকে দরকার নেই তবু একা একজন। ব্যক্তিত্ব হয়তো প্রখর হোক তবু তিনি কী সারাজীবন একা থাকবেন? যখন এসেছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল সাতাশ। এখন উনত্রিশ। তিরিশ পেরিয়ে গেলে একজন নারীর বিয়ের বয়স থাকে না। মনে মনে এইসব ভাবছেন। ভাবছেন বাড়ি যাবার পথে কয়েকটি ফুলগাছ কিনবেন নার্সারি থেকে। তাঁর একার জীবন পছন্দ। এখনো ভাবছেন না সেই বাগানে দুইজন বসবেন। বিকালে কিম্বা ঠিক সন্ধ্যার আগে। না তিনি তাঁর নিজের সংজ্ঞ পছন্দ করেন।
ও ঘরের ঘন্টা বাজে। এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। তিনি দেখতে পান বসে আছেন বাশার মূর্তজা। উনি এখন যাবেন। বলেন শামিমা— দেখুন ওঁকে গাড়ি পর্যন্ত তুলে দিয়ে আসুন।
কয়েকটি উপহারের প্যাকেট টেবিলে। বলেন বাশার মূর্তজা— নাইস মিটিং ইউ মিস করিম।
মি টু। বলে একটু হাসেন। তারপর একটা ফাইলের উপর ঝুঁকে কী যেন দেখতে থাকেন।
বাই! শামিমা টেবিলে মুখ নামিয়ে বলেন— বাই।
কিছু বুঝতে পারা যায় না তিনি কী বাশার মূর্তজাকে পছন্দ করেছেন না করেননি। মাঝখানে দুই দিন চলে যায়। উনত্রিশ তারিখে সকালে অফিসে ঢোকার আগেই বাশার মূর্তজার ফোন পান।—উনি আমার সন্বন্ধে আপনাকে কী বলেছেন।
কিছু না স্যার। কিছু বলেননি।
ও। আমাকেও কিছু বলেননি।
পরে বলবেন। এই ডিসিসন তো সারা জীবনের ব্যাপার। ভাবছেন।
আপনি কী একটু মনে করিয়ে দেবেন ওর ডিসিশন আমার জানা দরকার।
আপনাকে কী উনি ফোন করতে নিষেধ করেছেন।
বলেছেন— উনি ফোন করে জানাবেন।
তাহলে অপেক্ষা করতে হবে স্যার।
উনি কী তেমন একজন শিকার ধরবার আগে তাঁকে নিয়ে একটু খেলেন। যেমন খেলা করে কখনো কখনো ইঁদুর আর বেড়াল।
না স্যার উনি খুব স্ট্রেটফরোয়ার্ড কথা বলেন। ডিসিসনও নিজে নেন। কোন উপদেষ্টার পরামর্শ বিশ্বাস করেন না। আর আপনি নিজেকে শিকার বা ইঁদুর ভাবছেন কেন? এসব বলবেন না।
ইউ আর এ লয়াল অ্যান্ড ফেথফুল সারভেন্ট আই গেস।
আই সাপোজ সো।
অ্যাজ ফেইথফুল অ্যাজ এ ডগ?
ইউ ক্যান কল মি দ্যাট স্যার। বাই স্যার।
ওপারে ফোন রাখার শব্দ।
সন্ধ্যার আগে যখন শামিমা বাড়ি যাবেন বলে ঠিক করেছেন অপার হঠাৎ বলে ফেলেন —বাশার মূর্তজা ফোন করেছিলেন।
কেন?
জানতে চান আপনার কথা। মানে ওঁকে পছন্দ হয়েছে কিনা সে কথা। তিনি বলেন —এখনো বুঝতে পারছেন না। আমি বলেছিলাম ফোন করবো। এখনো ফোন করিনি। তিনি তাকিয়ে আছেন টেবিল ক্যালেন্ডারের দিকে। লোকটার কেবল টাকা আছে। টাকার গর্ব আছে। আর কিছু নেই। কালচারড বা সংস্কৃত নয়। শিক্ষার আলো ছোঁয়নি ওকে। আমাকে একটা মুক্তোর সেট আর শাড়ি উপহার দিয়ে বলতে চেয়েছে কেবল ওর টাকার কথা। ওগুলো ফেরত পাঠাব।
অপার কাজল চুপ করে বসে শুনছে। তিনি আপনমনে বলছেন— লোকজন আমি বিয়ে কেন করছি না সে নিয়ে চিন্তিত। ভাইয়াও সেদিন এমন কিছু বললেন। চাচা-চাচিরা, খালারা। একটু থেমে বলেন আজ ‘লিপইয়ার’। এইদিন পশ্চিমে ছেলেমেয়েরা একজন আর একজনকে প্রোপজ করে। দিনটা তো প্রায় ফুরিয়ে এলো। তিনি তাকান অপার কাজলের দিকে। বলেন— একজনকে ভালো করে জানবার জন্য দুই বছর অনেক সময়। তারপর হাসছেন— অন্যের ঘটকালি না করে নিজের কথাওতো বলতে পারতেন।
আমি? মানে আমি ম্যাডাম।
এখন থেকে শামিমা বলে ডাকবেন। আমরা কেউ কারো স্বাধীনতায় বাধা দেব না, ঠিক আছে? তাঁর মুখে এমন একটা হাসি যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অপার কাজল একসময় মিষ্টি করে হেসে ওঠেন। খোলস খুলে বেরিয়ে এসেছেন একজন সপ্রতিভ তরুণ। —তাই হবে শামিমা। দূরে কোথায় যেন একটা মেলোডিয়াস সুর বাজছে।