শফিক হাসান
কৌশল অবলম্বন ছাড়া যে কিছুই হয় না, প্রমাণ পেলাম নতুনভাবে। সংবাদ তরঙ্গ পত্রিকায় বারবার কবিতা পাঠিয়ে যখন নিজেরই তাল কেটে যাচ্ছিল, তখন মাথায় এল পেছনের দরজা দিয়ে হাঁটার চিন্তা। সাফল্যও এল অল্প সময়ে। অথচ সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে বেকারত্বের দিনগুলোতে কত জায়গায় আড্ডা দিয়েছি, গালগল্প করেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একটা শিঙ্গাড়া যেমন দুজনে ভাগ করে খেয়েছি, তেমনি বন্ধুবাৎসল্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে একটি সমুচার তিন কোনা ভাগ করে নিয়েছি তিন জন মিলে। কে জানত, পথের বন্ধুরাই একদিন বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হবে, অলঙ্কৃত করবে নামী কাগজের দামী সাহিত্য সম্পাদকের আসন। বুঝতে পারলে অবশ্যই সমঝে চলতাম। প্রয়োজনে নিজের হিস্যাটুকু বুঝে না দিয়ে আড়ালে দিয়ে পানি পানের মাধ্যমে করতাম উদরপূর্তি!
কুদ্দুস ঠাকুর ছন্নছাড়া দিনগুলোতে আমার নিত্যসঙ্গী ছিল। এখন অবশ্য ওইভাবে বললে লোকজন তেড়ে আসবে। বলতে হবে, কুদ্দুস ভাইয়া তার মূল্যবান সময় থেকে আমাকেও কিঞ্চিত সময় দিয়েছেন। এ সান্নিধ্য বড় প্রাপ্তি। তিনি কখনই আমার কাছে আসেননি, খোঁজও করেননি উল্টো উপযাচক হয়ে আমিই সুযোগ পেলেই তাঁর পিছু নিয়েছি। কবিতা লেখার ব্যারাম মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে একদিন কাগজে কিছু শব্দ নামিয়ে চলে গেলাম দৈনিক সংবাদ তরঙ্গ কার্যালয়ে। দুপুরে খেয়ে যাইনি। ভেবেছি, এতদিন পরে দেখা হবে, কুদ্দুস ভাই অফিস ক্যান্টিনে নিয়ে যাবেন। একসঙ্গে খেতে খেতে গল্পগুজব করা যাবে। গল্পের কোনো একফাঁকে হাতে গুঁজে দেব কবিতাখানি। নিশ্চয়ই আমাকে ফেরাবেন না। মানুষ ভাবে কী আর বাস্তবে হয় কী! দুপুর দুইটায় প্রবেশ করেছি। সালাম দিয়ে রিসেপশনে দায়িত্বরত সুন্দরীকে বলেছি, ‘কুদ্দুস ঠাকুরের কাছে যেতে চাই।’
সে ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘আপনি একা চাইলেই তো হবে না। তার চাওয়াও থাকতে হবে।’
নাম জেনে সে কল করল ইন্টারকমে, ‘স্যার মিজানুল হক নামে এক ভদ্রলোক… মানে এক লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
ভদ্রলোক থেকে শুধু লোকে নেমে যাওয়ার কারণ বুঝলাম না। ‘চায়’ সম্বোধনের মাধ্যমে পক্ষান্তরে তুই বলে বলেছে। যেচে পড়ে সম্মান চাইনি। নিজেকে ভদ্রলোকও দাবি করিনি কখনো। ফোন নামিয়ে অবজ্ঞার দৃষ্টি হানে রিসেপশন সুন্দরী, ‘স্যার, ব্যস্ত। আপনাকে বসতে বলেছেন।’
তা বসলাম, কিন্তু কতক্ষণ! সাড়ে পাঁচটা বাজার একটু আগে কুদ্দুস মণ্ডল এলেন। নিজেকে বড় কবি দাবি করার পর থেকে মণ্ডলের পরিবর্তে ঠাকুর ব্যবহার করছেন। অভ্যর্থনার ধরন দেখে থমকে যাই আবারও। কুদ্দুস বলেন, ‘তোমাদের আর সময়জ্ঞান হল না। আজ আমার পেস্টিংয়ের দিন…। যাক, এরা তোমাকে চা-পানি দিয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ। লাল চা দিয়েছে একবার। চিনি হয়নি ঠিকমতো। দুপুরে খাইনি। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে…।’
‘এ কথা জানানোর জন্যই এসেছ?’
‘না কুদ্দুস ভাই। কবিতা দিতে এসেছি।’
বীর পুরুষের ভঙ্গিতে প্যান্টের পকেটে ভাঁজ করা কবিতাটা হাতে তুলে দিলাম। তিনি অস্পৃশ্য বস্তু ধরার মতো হাতে নিয়ে বললেন, ‘তুমিও আজকাল কবিতা লিখতে শুরু করেছ! কম্পোজ করে দিতে পারলে না?’
‘আমার কম্পিউটার নেই।’
‘বাইরে থেকে কম্পোজ করিয়ে ইমেইল করতে!’
‘তাও তো পঞ্চাশ টাকার ধাক্কা…।’
‘পঞ্চাশ টাকা খরচ করতে পারবে না, অথচ কবিতা লিখতে এসেছ!’
বকাবাদ্য করে কুদ্দুস ভাই চলে যান। স্মরণ করার চেষ্টা করি, রাজধানীর বিভিন্ন গলি উপগলির মুখে দুপুরে প্রখর রোদে দাঁড়িয়ে কিংবা হেলান দিয়ে কুদ্দুস ভাই যখন স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি (!) করে শোনাতেন, তার পকেটে কত টাকা থাকত? চাকরির বয়স একবছর হয়নি, এখনই ভাতকে অন্ন বলা শুরু করেছেন, ধুরধুর করছেন অন্যদের!
যে অবহেলা শুরু হল, তা চলল ধারাবাহিকভাবে। অনেকবারই কবিতা দিয়েছি। শেষদিকে কুদ্দুস ভাই দেখা দিতেন না। বলতেন, রিসেপশনে দিয়ে দাও। অফিসের ভেতরে ঢুকে ক্যান্টিনে খাওয়ার স্বপ্ন বুঝি আর পূরণ হল না! সেটা না হয় নাইবা হল, ঝুপড়ি হোটেলে খেলাম; মেসের বুয়ার রান্নার মানও মন্দ না। কিন্তু একটাও কবিতা ছাপা না হলে পরিজন-মণ্ডলে কীভাবে মুখ দেখাই। ইতোমধ্যেই সবখানে চাউর করে দিয়েছি কবিতা লেখার সংবাদ। এখন যদি ফেল করি মানসম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কুদ্দুসের বাচ্চা আমার সঙ্গে এভাবে পল্টি নেবে কখনো ভাবতেও পারিনি। আগে বুঝতে পারলে কোনো চায়ের স্টলেই ওকে খাতির করে চা-পানি খাওয়াতাম না!
তবে এতটা বীতশ্রদ্ধ এখনও হইনি, নিজের কবিতাকে ছাপার অযোগ্য ভাবব। সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য বুদ্ধি করে বান্ধবীর নামে একটা কবিতা ইমেইল করে দিলাম। কম্পোজ করতে বিশ, দোকানের ইমেইল চার্জ বিশ, বিশ দু-গুণে চল্লিশ টাকা খরচ হলইবা! পরের সপ্তাহেই ছাপা হয়ে গেল কবিতাটা। আমার মাথায় হাত, আয়নায় চোখ। দিনের পর দিন সময়মতো খেতে না পেয়ে চেহারা ভচকায়া গেছে, এজন্যই কি কুদ্দুস শালার বিরাগভাজনে পরিণতি হয়েছি। মাথা গরম হলেও নিজেকে সংযত রাখলাম। গরম মাথায় আর যাই হোক, কবি হওয়া যায় না। কবিকে থাকতে হয় কাদামাটির দলার মতো কোমল। মনে মনে কুদ্দুসের পিণ্ডি চটকে দিলাম। নে ব্যাটা, এবার সামলা। ইতোমধ্যে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জেনেছি, কুদ্দুস প্রতি শুক্রবার পার্কে আড্ডা দেয়। সেখানে নারী কবিসহ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা থাকে। একদিন খুঁজে খুঁজে ঠিকই পৌঁছে গেলাম কুদ্দুসের আড্ডাস্থলে। আমার উপস্থিতি তিনি বোধহয় প্রত্যাশা করেননি। বললেন, ‘কী চাও এখানে?’
হাত কচলে বললাম, ‘ইয়ে… কুদ্দুস ভাই, আপনি তো বড় কবি। বিষয়টা বুঝবেন নিশ্চয়ই…।’
‘বুঝতে পেরেছি। বসো এখানে।’
ঘাসের ওপর গুটিশুটি মেরে বসতেই কুদ্দুস ভাই সেদিনের পত্রিকাটা মেলে ধরেন। আঙুল রাখেন বিন্তি মাহমুদার কবিতার উপরে। বলেন, ‘দ্যাখো, একেবারেই নতুন কবি। অথচ লেখা খুব ভালো। পড়লে প্রথমে মনে হবে জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ছি, পরক্ষণে মনে হয় বিষ্ণু দে-র।’
আমার কবিতা আমাকে দেখিয়েই লেখার পাঠ শেখাচ্ছে? গোপন বিষয়টা প্রকাশ করারও উপায় নেই। কাচুমাচু করে বললাম, ‘যথাসাধ্য চেষ্টা করছি ভালো করে লেখার।’
‘শুধু লিখলেই হবে? পড়তে হবে না!’
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুদ্দুসের সভাসদরা সমস্বরে হুক্কাহুয়া তুলল, লিখতে হলে পড়তে হবে। পড়লে জানা যাবে, কীভাবে ভালো কিছু লিখতে হয়! সবার দিকে তাকিয়ে কুদ্দুস সম্পাদকের দিকে ফিরি, ‘আগামীকাল টিউশনির টাকা পাব। তখন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ বইটা কিনে নেব।’
‘ও, তোমরা শুধু নীরেণবাবুকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে, বর্তমানের কবিতার গতিপ্রকৃতি কী বোঝা চেষ্টা করবে না! পড়ার আগেই খারিজ করে দিয়েছ কুদ্দুস ঠাকুরকে?’
এবার বড় ধরনের থতমত খেতে হয়। বলি, ‘বইমেলায় গিয়ে আপনার সব বই কিনে আনব।’
‘শুধু পড়লেই হবে না। বুঝতে হবে। কবিতার রসায়ন সহজ বিষয় নয়। কম বুঝলে, ক্ষেত্র বিশেষে বেশি বুঝলেও ভজঘট পাকিয়ে ফেলবে। পরিমিতি বোধ খুব জরুরি। এটা হচ্ছে, তরকারিতে লবণ দেওয়ার মতো।’
কুদ্দুস ভাই কবিতার নানা দিক ব্যাখ্যা করেন। এত এত আনাড়ি আর কচি মুখের ভীড়ে, ময়দা মাখা সুন্দরীদের আদিখ্যেতার মধ্যে কেমন যেন লজ্জা লাগে। অগ্রজ বন্ধু আমার সঙ্গেই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ফাঁদার পাঁয়তারা করছে। শুধু নিজের ‘ওজন’ একটু বাড়িয়ে নিতে। সেটাতেও কোনো আপত্তি ছিল না, যদি না আমার ওজন নিয়ে কারচুপি না করত। আমি যে যোগ্যতম কবি, বুঝিয়ে দিয়েছি ছদ্মনামে কবিতা ছাপিয়ে।
পরদিন বইমেলায় গিয়ে কুদ্দুস ভাইয়ের নতুন বইটা দিতে বললাম স্টলকর্মীকে। আমার পাশে দাঁড়ানো জনৈক উশকোখুশকো ধরনের লোক তা লক্ষ করে বলেন, ‘কুদ্দুসকে কবিতা দিয়েছেন বুঝি?’
কী আশ্চর্য! ইনি কীভাবে বুঝলেন! বিস্ময় গিলতে গিলতে বলি, ‘হ্যাঁ। কীভাবে জানলেন?’
‘কাব্যগ্রন্থ কেনা দেখে। তরুণ কবি ছাড়া সাহিত্য সম্পাদকের বই আর কে কেনে?’
‘কেন, সাধারণ পাঠক!’
‘হাসালেন মশাই। পাঠক পড়বে কবিতার বই! আমি নিজেও তো বর্তমান সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি। নিজের বউকেও অনেক অনুরোধ করে কোনোদিন এককপি বই কেনাতে পারিনি। আপনি আছেন অচেনা পাঠকের ভরসায়।’
‘তাহলে তো মুশকিল। কবিতার দুর্দিন!’
‘মুশকিলের কিছু নেই। রিভিউটা ভালো কইরা লেইখেন।’
‘ওই সব আমি পারি না।’
‘গুরুবন্দনা করতে না পারলে কুদ্দুস আপনার কবিতা ছাপবে কোন স্বার্থে!’
ভড়কে গিয়ে বইটা ফেরত দিতে চাই। সেলস গার্ল মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘বিক্রিত বই ফেরত নেওয়া হয় না।’
‘তাহলে এটা বদলে আপনার পছন্দের কোনো কৌতুকের বই দিন।’
‘ওইসব কৌতুক-ফৌতুকের স্টল এটা নয়। নামটা দেখে নিন, কবিতালয় প্রকাশনী। প্রবন্ধের বই নিয়ে যান।’
বাসায় এনে খুলে দেখি, কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ। এ তো আরেক জ¦ালা দেখছি। চামে গছিয়ে দিয়েছে। এসব পড়তে ভালো লাগে না। ভাবলাম, এ সুযোগে বইটা মনুকে উপহার দেব। সে কবিতা লেখে ‘সমুদ্রপাড়ের কবি মনু মোতালেব’ নামে। কিন্তু সমুদ্র-পরিচয়ের কেউ তার কবিতা ছাপে না। এদিকে মনুও একরোখা, শুধু সনদের নাম ব্যবহার করে কোথাও কবিতা ছাপতে দেবে না। ছাপলে পুরোটাই ব্যবহার করতে হবে। ভালো কবিতা লিখলেও তাই কোথাও সে সুযোগ পায়নি আত্মপ্রকাশের। আমিও বুঝতে পারি না, নামের সঙ্গে ‘সমুদ্রপাড়ের কবি’ লিখলে কার কী ক্ষতি হয়। বাড়া ভাতে ছাই পড়ে নাকি কালি বেশি খরচ হয়!
আমার উপহার পেয়ে মনু খুশি হয়। বলে, ‘ভালো একটা বই উপহার দিয়েছিস। এই না হলে বন্ধু। আজও তো দুপুরে খাসনি?’
‘না। বুয়া আসেনি।’
সময়মতো মেসের মিল-বিল পরিশোধ করতে পারিনি বলে আমার খাবার বন্ধ রয়েছে এক সপ্তাহ যাবত। এটা চেপে যাই। মানসম্মানের বিষয়। মনু বলে, ‘চল তোকে আজ সবজি বিরানি খাওয়াব।’
মনুর ডেরা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলি, ‘দোস্ত, কুদ্দুইস্যা তো কবিতা ছাপে না!’
‘ছাপার মতো কী করেছিস তুই?’
‘এ পর্যন্ত প্রায় তিন শত কবিতা দিয়েছি।’
হা হা করে হাসে মনু। বলে, ‘তুই আসলে বড় বেকুবরে। এভাবে কি কবিতা ছাপা হয়!’
‘আমি তো জানি, এভাবেই ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে গতকালের কচি কবি…।’
কথা থামিয়ে দেয় মনু। কপালে কুঞ্চনরেখা ফোটে তার। বলে, ‘এক কাজ কর তুই। বিন্তিকে নিয়ে কুদ্দুসের সঙ্গে পার্কে দেখা কর।’
এমন কথায় ভয় পেয়ে যাই। আমার প্রেমাস্পদকে নিয়ে ওই ব্যাটা কী করবে। চাকরি নেই, বাবা-মা থেকেও নেই। থাকার মধ্যে আছে এ একটুকরো প্রেম। দাড়ি-গোঁফ বড় হলে শেভ করার টাকাটা যে পকেটে গুঁজে দেয়। চেহারা দেখে সমুদ্রপাড়ের কবি মনু মোতালেব আবার বলে, ‘বিন্তি মাহমুদার কবি (!) পরিচয় গোপন রাখবি। অন্য নাম বলবি। আমিও এক বান্ধবীকে পটিয়ে নিয়ে গেছি কুদ্দুসের আড্ডায়। পরের সপ্তাহেই কবিতা ছাপতে চেয়েছিল। কিন্তু সমুদ্রপাড়ের কবি ছাপবে না বলে অনুমতি দিইনি।’
হিসাব মেলাতে না পেরে আবার বলি, ‘কিন্তু কেন? তোকে কেন বান্ধবী নিতে হবে, আমাকেই কেন…!’
চারপাশ ছালার বস্তা দিয়ে সযত্নে ঢেকে রাখা হোটেলে প্রবেশ করতে করতে মনু বিরক্ত হয়ে বলে, ‘তুই কবি নাকি রামছাগল? আরে ব্যাটা, কবিমাত্রই সৌন্দর্যের পূজারি। নারীরও।’
‘তাই বলে আরেকজনের প্রেমিকার দিকে হাত বাড়াবে ওই লুচ্চা ব্যাটা!’
‘এভাবে ভাবছিস কেন? আমরা কি সুন্দর কোনো জায়গায় বেড়াতে যাই না? সুন্দর কোনো দৃশ্য দেখলে দাঁড়াই না থমকে! এটাও এমনই। কুদ্দুস শুধু দেখে। দেখেই ওর সুখ। আবার এটা দেখাতে পারা একজন কবির যোগ্যতাও। আমার প্রেমিকা নেই; তোর তো সে সমস্যা নেই। ঘাবড়াস কেন, ছিনিয়ে নেবে এমন ভয় নেই।’
‘আচ্ছা। তাহলে একদিন যাব। কিন্তু সব শুনে বিন্তি কি রাজি হবে?’
‘কৌশলে নিয়ে যাবি। বিন্তিকে সব খুলে বলার দরকার নেই। অফিসেও নিতে পারিস। তোদের দুজনকেই কুদ্দুস একঘণ্টা সময় দেবে। ক্যান্টিনের বার্গারের সঙ্গে চা-কফি খাওয়াবে। কবিতাও ছেপে দেবে ইলাসট্রেশনসহ। মন বেশি প্রসন্ন হলে তোর ছবি দিয়ে গুচ্ছকবিতাও ছাপতে পারে।’
মনটা ভরে ওঠে খুশিতে। এবার বুঝি একটা হিল্লে হল। অন্তত একটা কবিতা ছাপা হলে চেনা মানুষদের কাছে গুরুত্ব বেড়ে যাবে অনেক। যথাযোগ্য সম্মানও দেবে তারা। ডান হাতে খিচুড়ি গলাধঃকরণ করলেও বাম হাতটা খালি। সেই হাত ব্যবহার করে শার্টের পকেটে থাকা সদ্য লেখা ভাঁজ করা কবিতাটা বের করি। পড়ে শোনাই। শুনে মাথা দোলায় মনু। বলে, ‘কবিতাডা ভালাই লেখছস। কিন্তু এটা কোন ছন্দ? মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত নাকি অক্ষরবৃত্ত?’
আমি এসবের কিছুই বুঝি না। ভবিষ্যতে বাংলা কবিতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, মনু এমন আলোচনা করতে শুরু করে। আবার ফেরে কবিতার বৃত্ত রচনায়— মাত্রা, স্বর, অক্ষর! এসবের বিন্দুবিসর্গও যে বুঝি না তা চেপে যাই। তাহলে হয়ত ওর কাছে আমার প্রসিদ্ধি কমে যাবে। তবে এসব কথার মাধ্যমে ও যেন আমাকে গোলাকার এক বৃত্তের ভেতর ছুঁড়ে মারে। অর্ধচেতনে ঘুরতে থাকি আগাপাশতলায়।
সমুদ্রপাড়ের কবির কাছ থেকে বিদায় নিই। কোথায় যাওয়া যায়, ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটি। আজ বোধহয় কোথাও কবিতার অনুষ্ঠান নেই। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটা বিড়ির অবশিষ্টাংশ কুড়িয়ে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করি। দ্বিতীয় টানেই মাথা ফ্রেশ হয়ে যায়। কল করা যায় বিন্তিকে। ও রাজি হলে আজই চলে যাব কুদ্দুস ঠাকুরের অফিসে। পকেটে তো তাজা কবিতা রইলই। কল করা মাত্রই শুনতে পাই মার্জিত কণ্ঠের পরিচিত সেই ঘ্যানঘ্যানানি, অ্যাকাউন্টে নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা নেই!