অভিজিৎ চন্দ

প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে কিছু বলা নানা কারণে বেশ কঠিন কাজ। প্রথমত, এই বিপুলাকার
বস্তুটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পড়া ও হৃদয়ঙ্গম করা খুব সহজ বিষয় নয় আর দ্বিতীয়ত, আমরা যারা শিক্ষা ব্যবস্থার
কোনো না কোনো স্তরে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত, আমরা নিজেদের ক্ষেত্রে এই সদ্য প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির প্রভাব
কি কি হতে পারে তার অনেকটাই সার্বিক বিশ্লেষণের উপর হামেশাই আরোপ করে ফেলি। কিন্তু প্রাথমিক
স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর, বৃত্তিমুলক শিক্ষা থেকে বিশুদ্ধ দর্শন বা কলা, সমস্যাই বলুন আর
সম্ভাবনাই বলুন, ধরণ পৃথক। তাই প্রথমেই এ কথা বলে রাখা ভালো যে এই দুটি দোষ থেকে আমার
মতামতও সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া কঠিন। একথা মাথায় রেখেই আমি কিছুটা সতর্কতার সাথে এবারের
প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষা নীতির কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
এ কথা মোটামুটি অনেকেই জানেন যে এবারের প্রস্তাবিত নীতিতে শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে প্রায় পুরোটাই
পাল্টে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ৬০ এর দশকের শেষে বা ৮০ র দশকের মাঝামাঝি যে শিক্ষা নীতির
প্রচলন করা হয়েছিল তার সাথে এবারের প্রস্তাবিত ব্যবস্থার অনেকটাই তফাৎ।
খুব কঠিন কথার ভেতরে না গিয়ে এটা বলা যায় যে এবার ৫+৩+৩+৪ ধাঁচের একটা স্কুল শিক্ষার
কথা বলা হচ্ছে। দু বছরের প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে পাঁচ বছরের একটা পর্যায়, যার পরে থাকবে
তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত একটা প্রলম্বিত প্রাথমিক স্তর। তারপরের তিন বছর প্রথাগত
পড়াশোনার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক পড়াশোনার সুযোগও থাকবে আর নবম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত নানারকম
বিষয়ে পড়বার, জানবার স্বাধীনতা। মাধ্যমিক পরীক্ষা বলে কিছু থাকবে না, একেবারে দ্বাদশ শ্রেণীর
পরীক্ষা। বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে গুরুত্ব দান যেমন একটা ভালো দিক, তেমনি একটি শাখায় পুরোটা
বাধ্যতামূলকভাবে সীমাবদ্ধ করে না রেখে অন্য শাখার বিষয়ে জানার সুযোগ করা হচ্ছে, এমনটাই প্রস্তাব
অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ে পড়লেও সুযোগ থাকবে কলা বা অন্য বিষয় সংক্রান্ত জানার। দশম শ্রেণীর পরে
নয়, বরং নবম শ্রেণীর শুরুতেই একজন ছাত্র বা ছাত্রী স্পেশালাইজেশনের স্বাদ পেতে শুরু করবে। এটা
এক ধরণের স্বাধীন বিকাশ সুনিশ্চিত করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে এতে সম্ভাবনার নানা দিক রয়েছে কিন্তু দুটি একটি প্রায়োগিক সমস্যা খুব গুরুত্বপূর্ণ, দার্শনিক
দিকটিও সবটা প্রশ্নাতীত নয়। প্রথমত স্কুলগুলি এই পরিবর্তনের সাথে নিজেদের পাল্টাবে কিভাবে?
কতদিনে? যে পরিকাঠামো, শুধু ঘরদোর, লাইব্রেরি ল্যাবরেটরী নয়, মানব সম্পদও বটে, তার প্রয়োজনীয়
যোগান, আদতে যা বিপুল, কিভাবে হবে? একটিই বিদ্যালয় তার মানব সম্পদকে কতটা দ্রুত কতটা
কার্যকরী ভাবে পাল্টাতে পারবে যাতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা থেকে ফলিত বিজ্ঞান, এই সব কটি ক্ষেত্রে তারা
ন্যুনতম যথাযথ ভুমিকা গ্রহণ করতে পারবে। তাছাড়া মোটের উপর স্মৃতিনির্ভর (memory based) একটি
ব্যবস্থা রাতারাতি এইরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ভিত্তিক বা activity based ব্যবস্থায় পাল্টে যাবে কিভাবে? যদি
আর্থিক যোগান হয়ে যাবে এমন কষ্ট কল্পনাও করি, তবুও লাখ লাখ স্কুলের পরিকাঠামো, পঠনপাঠনই হোক
বা মুল্যায়ন এর প্রথাগত অভ্যাস (যার সবটাই বাদ দেওয়ার যোগ্য, কোনো পরিসংখ্যান বা রিপোর্ট তা
বলে না) বদলানো, শিক্ষক শিক্ষিকাদের যথাযথ প্রশিক্ষন ও ওরিয়েন্টেশন তৈরীর বিষয়টা কিভাবে হবে,
তাও একটা বড় প্রশ্ন।
প্রাক প্রাথমিক স্তরকে বাধ্যতামূলক করে যে প্রথম পাঁচ বছরের প্রস্তাব, তাতে অঙ্গনওয়ারী শিক্ষাকর্মীদের
ভূমিকা কি হবে তা স্পষ্ট হওয়া উচিত। এমন হবে না তো, ‘প্রশিক্ষিত’ কর্মীর অজুহাতে প্রকারান্তরে প্রাইভেট

ও মন্তেশরি স্কুল ব্যবসাকেই চাপিয়ে দেওয়া হল? উত্তরটা জরুরী, বিশেষত যে দেশে এখনও বিপুল সংখ্যক
মানুষ প্রায় পরিকাঠামোবিহীন গ্রামের বাসিন্দা, অনেকের মানতে কষ্ট হলেও, আসলে বেশ গরীবও বটে ।
প্রাতরাশের ব্যবস্থা খারাপ নয়, বিশেষত মিড ডে মিলের পাশাপাশি, কিন্তু টাকার যোগান, খাবারের গুণমান?
এইখানেই একটা মস্ত বড় প্রশ্ন এসে যাচ্ছে কারণ প্রস্তাবিত নীতিতে পাবলিক প্রাইভেট হাত ধরাধরি ব্যবস্থা
নয়, যা বলা হচ্ছে তা প্রাইভেট ফিলান্থ্রপি পার্টনারশিপ (খেয়াল করুন এটাও পি পি পি কিন্তু পাবলিক
শব্দটা নেই)। প্রাইভেট আর সহৃদয় ব্যক্তিবর্গের দয়া ও মহত্বের উপরে এতটা আস্থা রাখা যাবে তো?
ঠকে যাবে না তো দেশবাসী? অন্তত প্রান্তিক শিশুরা?
প্রশ্ন তো উঠবেই, অন্তত ঘর পোড়া গরু হলে তো বটেই।
আর একটা জরুরী বিষয় হল ননফরমাল বা প্রথাবহির্ভুত শিক্ষা। অঙ্গনওয়ারী শব্দটায় অঙ্গন আছে, কিন্তু
প্রস্তাবিত নতুন নীতিতে অঙ্গন নেই, ক্লাস্টার আছে। গ্রাম, শহর বা আধা শহরে মানুষ দূরবর্তী ক্লাস্টার
থেকে শিক্ষার যোগান বা সাপ্লাই পাবে কারণ আঙিনার পাঠকেন্দ্রগুলির অনেকগুলির বিনিময়ে হবে একটি
দূরবর্তী ক্লাস্টার। সর্ব শিক্ষা বা সার্বিক শিক্ষা বাদ দিয়ে এটা কি আদতে উল্টোদিকেই হাঁটা হবে না?
এছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমাদেরকে ভাবাচ্ছে আর তা হল দূরমাধ্যমের লেখাপড়ায় নেট নির্ভরতা।
এটা সর্বস্তরের জন্যেই কম বেশি প্রযোজ্য কিন্তু সত্যিসত্যিই গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটা কতটা বাস্তবসম্মত
তাও ভাবা দরকার। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছে গেল মানেই সেখানে সারাদিন আলো পাখা চলে না।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ৮ ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ যোগাযোগ থাকে এমন গ্রাম বেশি নয়। তাহলে শিক্ষা
নীতির পাতায় প্রস্তাবিত দূরমাধ্যমের লেখাপড়া বা বিভিন্ন স্তরে নেট নির্ভরতা আসলে কতটা সহায়ক হবে,
সে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক।
উচ্চশিক্ষা মূলত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছে। চার বছরের
স্বাতক, মাল্টিপল এন্ট্রির সুযোগ ও প্রভূত ফ্লেক্সিবিলিটির কথা প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রথমেই বলি স্নাতক স্তরের পড়াশোনা সব বিষয়ে চার বছরের হবে, এখন যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিগ্রি,
সমস্ত বিভাগেই (আইন ও মেডিক্যাল ছাড়া) তাই হবে। যদিও আগে শেষ করতে চাইলে তাও করা
সম্ভব হবে তবে তাতে পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি হবে না। মাল্টিপল এন্ট্রি ও এক্জিট মানে কেউ চাইলে এক বছর
পরে ছেড়ে দিয়ে আবার তিন বছর বাদে দ্বিতীয় বছর থেকে শুরু করতে পারে। প্রত্যেকের অ্যাকাডেমিক
ক্রেডিট জমা থাকবে তার ক্রেডিট ব্যাংকে, তাই মার যাওয়ার বা একটা বছর জলে গেল, এমনটা হবে
না।
অন্য একটি দিক হল বিজ্ঞানের স্নাতক চাইলে মিউজিক নিয়েও পাশাপাশি পড়তে পারবে, ইতিহাসের ছাত্র
পারবে সংখ্যাতত্ত্বের একটি বা জীববিজ্ঞানের কোনো একটি পেপার পড়তে।
উপরের এই তিনটি প্রস্তাব নিয়ে আমার মনে হয় আপাতভাবে আপত্তিকর কিছু নেই কিন্তু কিছু সংশয়
এখানেও আছে এবং তা মুলত প্রায়োগিক দিক দিয়ে। মাল্টিপল এন্ট্রি যেমন সুযোগ দিচ্ছে প্রবেশের
তেমনিই মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার। আমাদের মতো দেশে যেখানে বেকারত্ব ভীষণ রকম বাড়ছে,
(অতিমারীর প্রভাব বাদই দিলাম) সেখানে এটি ড্রপ আউটের সংখ্যা বাড়াবে না তো?
চার বছরের স্নাতক স্তর কতজন শেষ করবেন আজকের আর্থ সামাজিক কাঠামোয় বিশেষত যেখানে শেষ
করার পর চাকরি সুনিশ্চিত নয়, সেটাও তো বিচার্য।
এখানে আরও একটি বিষয় ভাবা দরকার। তা হল, একজন যে নিজের পছন্দ মত এক আধটা অন্য
বিষয় পড়বে, তা কি চক বোর্ডের ক্লাসে না কি প্রয়োজনে অন লাইন ক্লাসে? অনলাইনের কোর্সটি কে বা
কারা পড়াচ্ছেন? তার জন্য অর্থ কত লাগবে? সর্বোপরি আমি প্রান্তিক গ্রামে বসে কোর্সটা ঠিকঠাক করতে

পারব তো? তা যদি না হয়, তবে আমার পছন্দের কি মূল্য রইল? আর যদি কলেজেই পড়ানো হয় তবে
তো ঐ বিষয়ের অধ্যাপক থাকতে হবে। কলেজে যে নিজের অনার্স সাবজেক্টের শিক্ষকই অপ্রতুল তা কি
আমরা জানি না? তাহলে? সমস্যাটা ভাবায় বৈকি।
কল্যাণগড় বিদ্যামন্দির একসাথে ইতিহাস, ভূগোল, অংক, বাংলার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষাও দেবে, এটা
যতটা কঠিন, বেঁড়াচাঁপা কলেজ এর পক্ষে রসায়নের একজন স্নাতক স্তরের ছাত্রীর ইতিহাস এর তেষ্টা
নিবারণ করা, বা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এর পক্ষে কারও সঙ্গীত বিদ্যার খিদে মেটানো বোধ
হয় আরও কঠিন। স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রায়োগিক প্রশ্নগুলি উঠবেই।
আলোচনা করতে চাইলে আরও অনেক বিষয় নিয়েই করা যায়, করা উচিতও, তবু সবটা এই স্বল্প পরিসরে
সম্ভব নয়। শুধু অন্য দুটি বিষয়ের আপাতত উল্লেখ করে শেষ করব। একটি হল, বিদেশের সেরা শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানগুলিও এদেশে স্বাগত, এইরকম একটি প্রস্তাবনা এবং দ্বিতীয়টি ভারতীয় মূল্যবোধ এর বিকাশে
গুরুত্ব আরোপ।
পৃথিবীর সেরা ১০০ টি বিশ্ববিদ্যালয় যাতে এদেশে শিক্ষাক্ষেত্র খোলে এমনটাই নাকি আশা। বিগত ১০
বছরের অভিজ্ঞতা এর প্রায় পুরোটাই উল্টো। কিন্তু উল্টো কোনোদিন সোজা হবে না, তা তো বলা যায়
না। মেনে নিচ্ছি এটা অকাট্য যুক্তি তবু বাস্তবতাটা মাথায় রাখলে সকলেরই মঙ্গল।
আর ভারতীয় মূল্যবোধ বলে যে বিষয়টা বলা হচ্ছে তা ঠিক কি কেমন তার কিছু পরিচয় আমরা পাচ্ছি
জীবনের চারপাশে, শিক্ষার আঙিনাতেও। অতিমারির কারণে সিলেবাসে কোপ পড়লে হয়ত এই দৃষ্টিভঙ্গীর
কারণেই ভারতীয় সংবিধান অংশটাই বাদ পড়ে, বিশেষ করে তার অনেকটাই যখন যথাযথ ‘ভারতীয়ত্ব’ এর
দিকচিহ্ন বহন করে না। আশংকা থাকছেই বিগত কয়েক বছরের কাজকর্মের কারণে।
তবুও বলব, অপেক্ষায় থাকতে হবে, নজর রাখতে হবে প্রায়োগিক দিকগুলিতে, সবটাই খারাপ বা সবটাই
ভালো এখনই ভাবলে চলবে না, ভালো আরও ভালো করে জানতে হবে প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি লাইনে কি
কি লেখা ছিল, কি কি করা হচ্ছে।
প্রয়োজন হলে কথা বলতে হবে, প্রশ্ন করতে হবে, বুঝতে হবে, ‘মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধনই
শিক্ষা’, বিবেকানন্দের কথাটি আদৌ অর্জিত হল কি না।