অতনু দত্ত

একটা খুব লম্বা করিডরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছে অমরেশ। দু দিকে পরপর দরজার সারি।
সব গুলো বন্ধ। কেউ কোথাও নেই। করিডরের শেষ প্রান্তে ফাঁক ফোকর দিয়ে পিছলে আসা
আলোতে একটা আলো আঁধারি। গা ছমছম করে ওঠে অমরেশের। মনে হয় কাউকে ফোন করা দরকার,
কিন্তু কাকে তা বুঝে উঠতে পারে না। তবু ফোনের জন্য বুক পকেটে হাত দিয়ে চমকে ওঠে। ফোনটা
নেই। হঠাতই তমসার কথাগুলো মনে পড়ে “কতদিন বলেছি বুক পকেটে ফোন রাখবে না। ওটা ভালো
নয়। হার্টের দোষ হয়।” দম বন্ধ হয়ে আসে অমরেশের, মনে হয় এই অন্ধকার অলিন্দ ধীরে ধীরে
ছোট হয়ে আসছে, চেপে ধরছে তাকে, গিলে খেতে চাইছে। কিছু না ভেবে পা চালায় সে। বেরোতে হবে,
এখান থেকে বেরোতে হবে। পেছনে কতগুলো পায়ের শব্দ ভেসে আসে। দৌড়তে যায় অমরেশ। ঠিক
তখনই পায়রার ডানার মত ঝটপট করে সামনের দরজাগুলো খুলে যেতে থাকে। দৌড়ে পেরোনোর
চেষ্টা করে। পারে না। ফাইল হাতে ধুতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা অফিসের গ্রূপ ডি দীনবন্ধুবাবু
বেড়িয়ে আসে। হ্যাঁ সবগুলো দরজা থেকেই। আস্তে আস্তে অসংখ্য দীনবন্ধুবাবুর একটা ভিড় তাকে
ঘিরে ধরে, সবাই একসাথে হাতের ফাইল খুলে তাকে কিছু বোঝাতে চায়, সই চায়। সবার কথায় ঘাবড়ে
যায় অমরেশ। দুহাতে কান চেপে ধরে বাঁচতে চায় সে। আচমকা হট্টগোলটা একটা তীক্ষ্ণ পাখির
ডাকে বদলে যায়। ডাকটা নির্মমভাবে ঢুকে যেতে চায় মগজের ভেতরে। অমরেশের মনে হয় কানে
তালা লেগে যাবে।
আচমকা পাখির ডাক ছাপিয়ে তমসার আওয়াজ ভেসে ওঠে।
“এই যে, অনেক বেলা হল। ওঠো এবার। শনিবার বলে কি দুপুর অবধি ঘুমোবে? ওঠো বাজারে যেতে
হবে না?”
ঘুম ভেঙ্গে পাখির ডাকের উৎস খুঁজে পায় অমরেশ। পাশেই রান্নাঘরে মিক্সি চালিয়েছে কাজের
মেয়ে। স্বপ্নটার কথা ভেবে হাসি পায় এবার। একবার ভাবে দীনবন্ধুবাবুকে কাল বলবে এই
স্বপ্নটার গল্প। তারপর ভাবে নাহ, থাক। দুখী মানুষ, কয়েক মাস পরে রিটায়ার করবেন। সংসারে
অনেক ঝামেলা ওনার। একমাত্র মেয়েকে ভুলভাল জায়গায় বিয়ে দিয়েছিলেন। লম্পট মাতাল
অত্যাচারী স্বামীর হাতের মার বছর খানেক সহ্য করেও মেয়েটা চেষ্টা করেছিল টিঁকে থাকতে,
কিন্তু ক্রমাগত বুড়ো বাবার কাছ থেকে টাকা এনে দেওয়ার দাবী না মানতে পেরে ফিরে এসেছে
বাপের বাড়ি। এখন ওখানেই থাকে। কি যেন নামটা? হ্যাঁ নীলা। ছলছল চোখে এসব কথা বলার সময়
বলেছিলেন দীনবন্ধুবাবু, “জানেন স্যার মেয়েটার নামটাই ভুল রেখেছিলাম। নীলা কি সবার সহ্য
হয়?” সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য অমরেশ বলেছিল, “ও কথা কেন বলছেন? বরং বলুন সবাই কি নীলার
কদর করতে পারে?”
কথাটা সেদিন মন থেকেই বলেছিল অমরেশ। ও দেখেছে নীলাকে বিয়ের সময়। খুব মিষ্টি দেখতে।
লাবণ্যময়ী মেয়ে। টানা টানা চোখ। বিয়ের সাজে খুব সুন্দর লাগছিল। ওর বরকে মোটেই মানাচ্ছিল না
ওর সাথে।

বিছানা ছাড়তে ছাড়তে অমরেশের মনে হয় অদ্ভুত স্বপ্নটা ডেকে তমসাকে শোনায়। কিন্তু শুরু
করতেই তমসা ঝাঁঝিয়ে ওঠে

থামো তো তুমি। ঘুম ভেঙ্গেই যত ঢপের গপ্প। যাও তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি
চা বসাচ্ছি। হাজার একটা কাজ পড়ে রয়েছে, আর আমি কিনা এখন ঢপের গল্প শুনতে বসব!
সংসারের কাজগুলো কে করবে শুনি?
মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে যায় অমরেশের।

স্নানের আগে দাড়ি কাটতে গিয়ে নিজের মুখটা আয়নায় দেখে অমরেশ। অন্য দিনগুলো অফিসের
তাড়া থাকায় নিজেকে এমন করে দেখা হয় না। চোখ এবং ভুরুর তলায় ফোলাগুলো বড় বেশি চোখে
পড়ে আজকাল। গাল দুটোও ফুলেছে আগের তুলনায়। চোয়ালের দু পাশ মেদ জমে আগের চেয়ে বেশি
চওড়া। চিবুকের নীচে চামড়ায় ঢিলে ঢিলে ভাব। বোঝে বয়স হচ্ছে। এই তো কদিন আগে আটচল্লিশে
পা দিয়েছে। সে তুলনায় মুখের চামড়া এখনো বেশ টানটান। শুধু ওই ফোলাগুলো… দু হাতের তর্জনী
দিয়ে চোখের নীচের চামড়া দু দিকে টেনে ধরে অমরেশ। চোখ ছোট হয়ে অনেক ইয়ং লাগে নিজেকে
দেখতে। এককালে খুবই হ্যান্ডসাম ছিল অমরেশ সেটা জানে। এখনো খুব খারাপ নয়, তবে ঐ, ভাঙ্গন
ধরেছে।
দুপুরে খাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে একটু আদুরে নেকু নেকু গলায় তমসা বলে

হ্যাঁ গো, সকালে কি একটা স্বপ্নের কথা বলছিলে না? কি স্বপ্ন গো? বল না…
ভুলে গেছি এখন।
মিথ্যে কথা বলে অমরেশ। মন খারাপের সাথে একটু রাগও হয় এবার। সব কিছুই নিজের সময়ে
নিজের মত করে চাই তমসার। অমরেশের নিজের চাহিদা মত কোন কিছুই হয় না আর সংসারে।
থাক বেশি রাগ দেখাতে হবে না। বলবে না তো বলবে না। আমারও শুনতে বয়েই গেছে।
কয়েক মিনিট পরেই হালকা নাক ডাকার আওয়াজ ভেসে আসে তমসার দিক থেকে।
স্বপ্নটা আবার মনে পড়ে অমরেশের, তারপরই ভাবনাটা চলে যায় স্বপ্ন থেকে দীনবন্ধুবাবুর মেয়ে
নীলার ওপর। ওর মুখটা মনে পড়ে যায়। বিয়ের আগে আরো একবার গিয়েছিল মধ্য কলকাতার এক
ঘিঞ্জি এলাকায় দীনবন্ধুবাবুর বাড়িতে। সেবার দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় হঠাৎ করে
নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়েছিল। আচমকা অনেক গুলো টাকার দরকার পড়াতে নিজের পকেট
থেকে কিছু টাকা অমরেশ ধার দিয়েছিল তখন। স্ত্রী সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর কৃতজ্ঞতা
জানানোর জন্য কর জোড়ে একদিন বাড়িতে যেতে বলেছিলেন। সেই অনুরোধ ঠেলতে না পেরে গিয়েছিল
অমরেশ। ঘন্টাখানেক ছিল সেবার। খারাপ লাগে নি। উপকারে ডোবা স্বামী স্ত্রীর আন্তরিকতায়
খুশি হয়েছিল। দীনবন্ধুবাবু যখন বলছিলেন “স্যার, আপনি ওই সময় টাকাটা না দিলে আমি বোধহয়
আর ওকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারতাম না”, বেশ লজ্জাই পাচ্ছিল অমরেশ। তখনই প্রথম দেখেছিল
নীলাকে। অনেক ছোট ছিল সে সময়। বড় বড় ফুলের মত চোখ মেলে দেখে যাচ্ছিল ওকে। মুগ্ধ হয়ে
শুনছিল ওর মুখ থেকে বেরোন সব কটা শব্দ। দেখছিল সেই ভগবানকে, যে না থাকলে মা আর বাড়ি

ফিরে আসতো না। খুব ভালো লেগেছিল অমরেশের মিষ্টি ফুলের মত মেয়েটাকে। আরো একবার মন
খারাপ হয়। ভাবে যদি কিছু করা যেত মেয়েটার জন্য।
জোর করেই নীলার চিন্তা সরিয়ে দিয়ে, মাথার ভেতরে ঘুরঘুর করা নাছোড়বান্দা দুশ্চিন্তাটা এবং
সন্ধ্যের প্রোগ্রামের কথা ভাবতে শুরু করে অমরেশ। আজ বেস্ট ফ্রেন্ড দেবুর সঙ্গে সন্ধেবেলা
বারে যাওয়ার প্ল্যান আছে। সে অবশ্য নতুন কিছু নয়। আগেও অনেক গেছে। কয়েক পেগ লাগায়,
আড্ডা মারে, পুরনো সব গল্পগুলো নতুন করে আওড়ায়, প্রাণ খুলে খিস্তি খেউড় করে। যা যা ঘরে
বা আর কারো সঙ্গে করতে পারে না, সে সব কিছু করে। এমন কি নিতান্ত ব্যক্তিগত গোপন
কথাগুলোও হাসিমুখে শেয়ার করে নিজেদের মধ্যে। শেষে একটু টিপসি হয়ে উবের ধরে বাড়ি। বেশ
একটা আন-উইন্ডিং হয়, রোজকার একঘেয়ে জীবনে একটু সতেজতা আসে। ওরা পালা করে বাড়িতেও
বসে মাঝে মাঝে। কিন্তু বাইরে না গেলে বৌওদের সামনে শালীনতার গন্ডিতে আটকে ঠিক ফ্রী হতে
পারে না যেন।
তবে আজ খুব সিরিয়াস কাজ রয়েছে। একটা মরণ বাঁচন সমস্যার সমাধান চাই। জানে না আদৌ হবে
কি না। দেবুর বৌ সুমনা একটা বিশাল দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেছে কাল। ইন ফ্যাক্ট
আজকের প্রোগ্রামটা সে জন্যই ফিক্স করেছে সে। অন্য সময় বারের কথা শুনলে ঘ্যানঘ্যান করা
তমসা নিজেই এই বুদ্ধিটা দিয়েছে। দেবুকে যে ভাবে হোক আজ বুঝিয়ে সুঝিয়ে শোধরাতে হবে,
ফিরিয়ে আনতে হবে। এই কাজে নাকি তার চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ নেই এ দুনিয়ায়। দেবুর পুরো
ঘটনাটা ঘুরপাক খায় মাথার ভেতরে।
গত পরশু ছেলেকে টিউশনি পড়তে পাঠিয়ে সুমনা এসেছিল। এসেই নাকি তমসার কাছে কান্নাকাটি শুরু
করে। ওদের বন্ধুত্বের সুবাদে তমসা আর সুমনার বন্ধুত্বও কম নয় মোটেই। প্রচুর সময় সঙ্গে
থেকে থেকে ওরাও এখন বেস্ট ফ্রেন্ড। অফিস থেকে ফিরে এসে অমরেশ দেখে দুজনে সামনের
ঘরের সোফায় গম্ভীর মুখে বসে। ফ্রেশ হয়ে এলে সুমনার ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কান্নার মাঝে সব কিছু
খুলে বলে তমসা।
সুমনার সঙ্গে নাকি বেশ কিছুদিন ধরেই সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না দেবুর। বুধবার সন্ধ্যেবেলা কোন
একটা ছোটখাট ঘটনায় দুজনের তুমুল ঝগড়া হয়। সে সময় দেবু সুমনাকে আচমকা ডিভোর্সের কথা
বলে। এও বলে যে ও নাকি অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, এবং তার সঙ্গেই থাকতে চায়। সুমনা
তো আকাশ থেকে পড়ে। বিশ্বাসই করতে চায় না। তখন দেবু ওকে সেই মেয়েটার ফটো দেখায়। বলে
দরকার হলে নাকি কথাও বলিয়ে দেবে। শুধু তাই নয় পরশু সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বলে গেছে,
রাতের কথাগুলো সব সত্যি। সুমনা যেন কয়েকদিন সময় নিয়ে দেবুকে জানায় কি ভাবে এগোতে চায়।
এসব শুনে চড়াৎ করে অমরেশের মাথাটা গরম হয়ে যায়। দেবু, হতচ্ছাড়া দেবু কিভাবে এরকম করতে
পারে? যদিও ছোটবেলা থেকেই ও একটু প্রেমিক টাইপের ছিল, কিন্তু বিয়ের পর এতগুলো বছর তো
মন দিয়ে সংসার করল। ছেলেটাও ছোট নয় আর। ইলেভেন এ পড়ে। এই বয়সে এসে কি করে এসব
ভাবতে পারে ও। রেগে তখুনি ফোন করতে চায় অমরেশ। ওরা দুজনেই বারণ করে। তমসা বুদ্ধি দেয়
কোথাও বসে ড্রিঙ্ক করতে করতে কথা বলতে। তাতে নাকি আসল কথা বেরোবে। অমরেশ বোঝে
ওরা ঠিক বলছে তাই মেনে নেয়।

রাতে কিছু না বলে গতকাল সকালে অফিস থেকে ফোন করে আজকের প্রোগ্রাম ঠিক করে অমরেশ।
দেবুর সঙ্গে কথা বলে অবশ্য কিছুই বুঝতে পারে না। একটু কষ্টও হয়। সেও তো দেবুর বেস্ট
ফ্রেন্ড। তবু কিছু বলল না! নাঃ সত্যিই দেবুটা অমানুষ হয়ে গেছে। আজ দেখা যাক। যদি ও না মানে,
সম্পর্কই শেষ করে দেবে। তারপরে আবার ভাবে, নাঃ মাথা গরম করলে চলবে না। সুমনা আর ওর
ছেলেটার জীবন জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। দেবু সত্যিই এসব করলে সংসারটা ভেসে যাবে। সমস্যা তো
সবারই থাকে। তার আর তমসার মধ্যেও তো প্রচুর ঝামেলা হয় আজকাল। তমসাও তো তাকে
আজকাল খুব একটা পাত্তা দেয় না। দুটো কথা বলতে গেলে বিরক্ত হয়। মাঝে মাঝে অকারণে রেগে
ওঠে। অভ্যাসে সংসার করতে হয় তাই যেন করছে। সব কিছুতেই নিজের মত জাহির করার চেষ্টা।
তারও তো ভালো লাগে না এসব। তাই বলে পরকীয়া? ভাবতেও পারে না অমরেশ।
হঠাৎ করে কাল রাতে ঘুমনোর আগে, সাপ্তাহিক আদর করার সময় তমসার বলা একটা কথা মনে
পড়ে যায়,

জানো তো, যাদের চরিত্রের দোষ হয়, লম্পট হয়, তাদের না চোখ দেখলে বোঝা যায়। কেমন
যেন ঘোলাটে হয়ে যায় চোখদুটো। ঠোঁটের পাশগুলো না কেমন ঝুলে যায়। হাসিটাও বিশ্রী হয়ে
যায়। দেবুদাকে কিছুদিন ধরে আমার তেমনই লাগছিল।
ওই সময় এসব কথায় বিরক্ত হয়েছিল অমরেশ, ধমকে বলেছিল
থামো তো, ওটা চরিত্রের দোষ নয়। বয়সের দোষ।
আজ এখন মনে হয়, ঠিক ওই সময়টায় কেন তমসার মনে দেবুর কথা এল? কেন ভাবছিল দেবুকে
নিয়ে? তাহলে কি…
নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হয় অমরেশ। ভাবে নিজের মনটাও আজকাল এসব নোংরা কথা শুনে
শুনে ছোট হয়ে যাচ্ছে। আজকাল কি কেউই আর সুস্থ স্বাভাবিক নেই? নাকি এটাই জীবন। সব ঢেকে
রাখা। মুখোশ এঁটে থাকা সব সময়।
সন্ধেবেলা মেট্রো ধরে ঠিক সময়েই পার্ক স্ট্রীটের কাছের এক গলিতে, ঝকমকে আলো লাগানো
বারটার সামনে পৌছয়। দেখে দেবু নির্লিপ্ত মুখে বাইরে সিগারেট টানছে। ভেতরে ঢুকে প্রায়ান্ধকার
হলের এক কোণে একটা টেবিলে বসে ওরা। বেয়ারা ড্রিঙ্ক দিয়ে যায়। দুজনের কেউই শুরুতে বিশেষ
কথা বলে না। প্রথম ড্রিঙ্কটা শেষ হওয়ার মুখে দেবু বলে ওঠে
নে এবার বলে ফেল যা বলতে এসেছিস আজ। আমাকে বোঝাতে এসেছিস তো?
এতক্ষণ অবধি অমরেশের মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল, হয়ত যা শুনেছে সব ভুল। হয়ত দেবু বলবে,
ও একটা মজা করছিল সুমনার সঙ্গে। আবার ম্যাজিকের মত স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব কিছু। সেই
খুশীতে খুব করে খেয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরবে দুজনে। সে সব ভাবনা মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়
দেবুর কথায়। ঝটকা লাগে একটা। রাগও হয় খুব। বেশ জোরেই বলে ওঠে
তুই এসব কি শুরু করেছিস বল তো? কাল সুমনা এসেছিল। সব বলেছে আমাদের। তোর লজ্জা
করে না দেবু? এই বয়সে এসে তুই কিনা… ছিঃ ছিঃ…
চেঁচাস না। সবাই দেখছে। আমি বলছি তোকে সব। কাল তোর ফোন পাওয়ার পর আমি
আন্দাজ করেছিলাম, সুমনা তোর ওখানে গিয়েছিল। আজ আমি সব জেনে শুনেই এসেছি।
তোকেও ব্যাপারটা বলা দরকার ছিল। আগেই বলতাম, বলিনি শুধু অশান্তির ভয়ে। তোকে
আগে বললে তুই পাঁচকান করতিস। জানাজানি এখনো হবে, তবে এখন আমি মানসিকভাবে
তৈরি সব কিছুর জন্য।
তুই এতোটা ডেসপারেট হয়ে উঠেছিস? কার জন্য দেবু? কিসের জন্য। বয়স কত হয়েছে
খেয়াল আছে?
তা আছে বলেই তো করছি এসব। অমু, জীবন একটাই। আমি পরজন্মে বিশ্বাস করি না। কাল
শালা টপকে গেলে হয়ে গেল। ওখানেই শেষ। দি এন্ড।
কিছুক্ষণ চুপ করে প্রথম ড্রিঙ্ক শেষ করে দ্বিতীয়টার অর্ডার দেয় দেবু। বলে
এই শালার মেকি, নেকু নেকু জিন্দেগী আমি আর সহ্য করতে পারছি না অমু। মাইরি বলছি।
এমনি চললে হয়ত আমিই ডিপ্রেশনে চলে যাব কোন একদিন।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ মুখটা সামনে নিয়ে এসে কাটা কাটা শব্দে বলে
তুই কি জানিস সুমনার সঙ্গে গত দু’বছর ধরে আমার কোন শারীরিক সম্পর্ক নেই?
কি বলছিস? তাহলে তুই যে মাল খেতে খেতে আজেবাজে কথাগুলো বলতি?
সব মিথ্যে… আটার লাইস। কাছে গেলেই নানান বাহানা। জোর করলে কান্নাকাটি। আই
কান্ট বি এ রেপিস্ট, ইউ নো? কাউকে বলিনি। লুকিয়ে রেখেছি।
ডাক্তার…
দেখিয়েছি। লাভ হয় নি কিছু। প্রবলেমটা শারীরিক নয় মানসিক। ছাড় অমু… হবে না কিছু
আর।
তোর সংসারটার কি হবে ভেবে দেখেছিস?
হ্যাঁ, দেখেছি। কিছুই হতে দেব না। ওরা যেমন আছে তেমনি থাকবে। ওদের ভরণ পোষনের
সব দায়িত্ব আমারই থাকবে। ফ্ল্যাটটাও সুমনার নামে লিখে দেব আমি।
দেবু… তুই তুই… আর ইউ শিওর তুই ভুল ডিসিশন নিচ্ছিস না? কার জন্য এসব করছিস?
কে সে?
হাত বাড়িয়ে গ্লাসের তলানিটুকু এক চুমুকে শেষ করে দেবু। অমরেশকেও বলে শেষ করতে। বিল
চুকিয়ে বলে
চল।
কোথায়?
চল না।
বেরিয়ে আসতে আসতে অমরেশ বোঝে হাল্কা নেশা হয়েছে। চেনা রাস্তাটা কেমন অচেনা লাগে।
বাইরে এসেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে যায় ওরা। দেবু ড্রাইভারকে ঠিকানা বুঝিয়ে বলে। মধ্য
কলকাতার কোন একটা গলির নাম নেয়। ঘড়ি দেখে অমরেশ, রাত সাড়ে আটটা বাজে।
একটা মোড়ে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে হাঁটা লাগায় দুজনে। রাস্তায় আসতে আসতে দুএকবার জিগ্যেস
করে অমরেশ দেবুকে, কোথায় যাচ্ছে। দেবু বলে, “গিয়েই দেখিস”। নেহাতই ঘিঞ্জি গলির ভেতরে

একটা জীর্ণ বাড়িতে ঢোকে ওরা। ঢুকেই নোংরা উঠোন, এককোণে জলের কল, ডাঁই করে রাখা এঁটো
বাসন। জমে থাকা নোংরা। সামনে দোতলা পলেস্তারা খসা দেয়াল। সরু উঁচু ধাপওয়ালা সিঁড়ি বেয়ে
দোতলায় যায় ওরা। দরজায় নক করতে এক বৃদ্ধা বেরিয়ে আসে। হাতে ধরা বছর চার পাঁচেকের
ছেলে। দেবুকে দেখে হাসে বৃদ্ধা। কিছু না বলে বাচ্চাটার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় নীচে। ওরা
ঘরে গিয়ে বসে । অমরেশ একটা ছোট কাঠের টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে, দেবু ইঁট দিয়ে উঁচু করা
খাটের ওপরে পা ঝুলিয়ে। খাটের তলায় বাক্স প্যাঁটরা ঠাসা। ঘরের আসবাবপত্রের ওপর চোখ
বুলিয়ে ওঠার আগেই পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢোকে একটি মেয়ে। চমকে ওঠে অমরেশ। চোখ ঝলসে ওঠার
মতো সুন্দরী। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে হয়তো। মুখে কোনরকম প্রসাধনী নেই। তা সত্ত্বেও
দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অমরেশ এবারে বোঝে দেবুর পদস্থলনের কারণ।

অমু, এ হচ্ছে রাখী। আমার… কি আর বলি, জানিস তো সব।
রাখী, এ আমার ছোটবেলার বন্ধু অমরেশ। খুব বড় চাকুরে। তোমাকে দেখতে এসেছে।
দেবুর বলার ধরণে লজ্জা পায় অমরেশ। রাখী বলে
আমাকে দেখতে? ও মা, কেন? আমাকে আবার দেখার কি আছে। একটা হতভাগী মেয়ে আমি।
ছিলে, এখন আর নও। এক কাজ করো তো রাখী। সেদিন একটা বড় হুইস্কির বোতল
এনেছিলাম, তার কিছুটা পড়েছিল তো। যাও নিয়ে এসো। অমুকে খাওয়ার মাঝেই তুলে নিয়ে
এসেছি এখানে।
খেয়েই তো এসেছ, আবার খাবে?
আরে নিয়ে এসো না, প্রথম বার বন্ধুকে নিয়ে এলাম…
আচ্ছা, আনছি।
বেরিয়ে যায় রাখী।
“এটা কোন জায়গা?” জিগ্যেস করে অমরেশ।
তুই যা ভাবছিস তা নয়। এটা ভদ্র পাড়া। তবে গরীব পাড়া। রাখীরা এখানে ভাড়া থাকে। এই
ওপরের ঘরটা আর নীচে একটা ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম। রাখীর হাজব্যান্ড একটা
এক্সিডেন্টে মারা যায় কয়েক বছর আগে। ডায়মন্ড হারবারের দিকে ওদের বাড়ি ছিল।
ভদ্রবাড়ির কলেজে পড়া মেয়ে। ছেলে মানুষ করার জন্য একটা ছোট বাচ্চাদের স্কুলে আয়ার
চাকরী নিয়ে এখানে এসে ওঠে। তারপর আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়।
রাখী হাতে একটা বোতল নিয়ে ঘরে ঢোকে। অন্য হাতে দুটো গ্লাস আর একটা প্লেট। অমরেশের
সামনেই রাখা টেবিলে গ্লাস দুটো রেখে বোতল খুলে হুইস্কি ঢেলে দেয়। একটা প্লাস্টিকের কৌটো
থেকে চানাচুর ঢেলে দেয় প্লেটটাতে। অমরেশের খুবই কাছাকাছি, গা ঘেষে দাঁড়ায় রাখী। একটা
মেয়েলি গন্ধ নাকে আসে। কোন পারফিউম নয়, তবুও ভালো লাগে। অমরেশের অস্বস্তি হয় খুব।
মনে হয় রাখীর শরীরের উত্তাপ ও যেন টের পাচ্ছে। একটা গ্লাস দেবুকে দিয়ে অন্য গ্লাসটা
অমরেশের দিকে মিষ্টি হেসে এগিয়ে দেয় রাখী। নেওয়ার সময় হাতের আঙ্গুলটা ছুঁয়ে যায়। রাখীর
হাসি মুখ দেখে ভেতরে একটা চাপা রাগ অনুভব করে অমরেশ। তারপরেই অবাক হয়ে বোঝে রাগ নয়
মোটেই। এটাকে ঈর্ষা বলে। সে হিংসে করতে শুরু করেছে দেবুকে। ভয়ঙ্কর হিংসে।
ডিভোর্সটা হয়ে গেলে, বুঝলি অমু, ভাবছি ওকে একটা ভদ্রগোছের জায়গায় নিয়ে রাখবো।
এই পাড়াটা বড় নোংরা। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেব শহরতলীর দিকে। ওখানেই থাকবো। খুব
একটা মন্দ থাকবো না রে। রাখীর রান্নার হাতও খুব ভালো। সব হয়ে যাক তোকে একদিন
চুপি চুপি ডেকে এনে খাওয়াবো। তমসা তো আর আসবে না।
অমরেশ কিছু বলার আগেই রাখী বলে ওঠে
তুমি এসব কি শুরু করেছ বল তো। কি দরকার এত ঝামেলার। এই বা কি মন্দ আছি আমরা
সবাই। এভাবেই চলুক না। শুধু শুধু অশান্তি। ওনাদেরও কত কষ্ট হবে। আমার আর কি, চলে
যাবে এভাবেই কোন রকমে। আমাদের এভাবেই চলে যায়।
অবাক চোখে রাখীকে দেখে অমরেশ। দেবু একটু গর্ব করেই তাকায় ওর দিকে, হাসে। অমরেশ বোঝে
ওর বুকের ভেতরে ঈর্ষা বাড়ছে ক্রমাগত। গ্লাসে একটা বড় চুমুক দিয়ে বলে “অনেক রাত হল দেবু
বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে”। আমাকে কথাটার ওপর একটু বেশিই জোর দেয় যেন। দেবু হাসে। বলে
আরে, এমন কিছু দেরী হয় নি। বোস তো। আর এদিকে তাকাস না, এদ্দুরে এলাম একটু আদর
করে নিই আমার জানকে।
বলেই দেবু হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয় রাখীকে। জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে একটা চুমু খায়। রাখী নিজেকে
মুচড়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। ধমকের সুরে বলে
আরে মাতাল হয়ে গেলে নাকি? কি করছ? বন্ধুর সামনে…
অমরেশের কান মাথা ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। দেবুকে সেই মুহুর্তে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হয়। কিছু না
বলে উঠে দাঁড়ায়। পা টা একটু টলে যায়। গ্লাস তুলে এক চুমুকে খালি করে সশব্দে টেবিলে নামিয়ে
রেখে ছিটকে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। পেছন থেকে দেবু অমুর নাম ধরে ডেকে চলে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে
গিয়ে বোঝে খুব নেশা হয়ে গেছে। বাড়িটার থেকে বেড়িয়ে কোথায় যাচ্ছে না জেনেই সোজা হাঁটতে
থাকে। শরীরের ভেতরের অস্বস্তিটা প্রবল হয়ে ওঠে। খানিকটা গিয়ে একটা ল্যাম্প পোস্ট ধরে
দাঁড়িয়ে হড় হড় করে বমি করে। একটু ভালো লাগে। মাথার ভেতরের ঘোলাটে ভাব একটু হলেও স্বচ্ছ
হয়। সামনের একটা বাড়ির ফাঁকা রোয়াকে বসে বিশ্রাম নেয় অমরেশ। রাখীর কথা মনে পড়ে এবং
হঠাৎ করেই নীলার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ওর সেই ফুলের মত নিষ্পাপ চোখদুটো। বুকের
ভেতরটা হু হু করে ওঠে। ভীষণ ভাবে নীলাকে দেখতে ইচ্ছে করে, কাছে পেতে ইচ্ছে করে।
আরো একটু এগিয়ে একটা বড় রাস্তা পায় অমরেশ। রাস্তার হলুদ আলোতে হেঁটে চলা নিজেকে বড়
বেমানান লাগে। কপাল জোরে একটা ট্যাক্সি জুটে যায়। ট্যাক্সিওয়ালা কোথায় যাবে জিগ্যেস
করলে, নিজের অজান্তেই দীনবন্ধুবাবুর বাড়ির ঠিকানা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। ট্যাক্সিতে বসে
চোখ বোঁজে অমরেশ। রাখী এবং নীলার চেহারা মিলে একাকার হয়ে যায়। দেবু এখন রাখীর সঙ্গে…
ভাবতেই আবার অস্বস্তিটা ফিরে ফিরে আসে। মনে হয় যেন জ্বর এসেছে। শরীরটা আবার খারাপ
লাগে অমরেশের।
একটু পড়ে ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলে, “আ গয়া বাবু, ঔর আগে জানা হ্যায় ক্যা?”

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কয়েকটা বাড়ি পরেই মোড়ের আগে দীনবন্ধুবাবুর বাড়িটা দেখা যাচ্ছে।
কি করবে বুঝে উঠতে পারে না অমরেশ। এ সময় তাকে এই অবস্থায় দেখে দীনবন্ধুবাবু কি ভাববেন।
নীলাই বা কি মনে করবে। কি বলবে সে, ঠিক কেন এত রাত্রে মাতাল অবস্থায় এখানে এসেছে। অথচ
মনে হচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তে নীলাকে একবার না দেখলে সে মরেই যাবে।
হঠাৎ মনে হয় অনেক দূর থেকে একটা খুব পরিচিত সুর ভেসে আসছে। ভালো করে খেয়াল করে,
আলো সহ আওয়াজটা আসছে বুকের কাছ থেকে। বোঝে মোবাইলটা বাজছে। বার করে দেখে তমসার
নাম ভেসে উঠেছে স্ক্রীনে।
তুলতে গিয়েও ফোনটা কেটে দেয় অমরেশ। ড্রাইভারকে নিজের ফ্ল্যাটের ঠিকানা বলে গাড়ি স্টার্ট
দিতে বলে। ড্রাইভার অবাক হয়।

পর বাবু, আপনে তো ইয়ে হি এড্রেস বোলা থা।
আরে হাঁ ভাই, গলত এড্রেস দে দিয়া থা। সরি। আব সহী পতে পে লে চলিয়ে।
কিছু না বুঝে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। রিয়ার ভিউ মিররে নিজের মুখটা চোখে পড়ে। অবাক হয়ে
অমরেশ দেখে চোখদুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। ঝুলে পড়েছে ঠোঁটের কোনগুলো…