স্বপন রঞ্জন হালদার
(রিটায়ার্ড মাস্টারমশাই লনে বসে আছেন ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে। মোবাইলে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে।
চোখ বুজে সেই গানে ডুবে আছেন মাস্টারমশাই। দু-চারটি ফুলের টব, অবশ্যই একটি ক্যাকটাস
দৃশ্যমান। ঢোকে বিপ্লব। মেয়েলি যুবক। পোশাক তেমনটাই)
বিপ্লবঃ (পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে) স্যার, স্যার কেমন আছেন?
মাস্টারমশাইঃ (চোখ মেলে। মোবাইল বন্ধ করে) তুমি………?
বিপ্লবঃ চিনতে পারছেন না তো? আমি বিপ্লব। বছর দশেক আগে রাজডাঙা হাইস্কুলে
পড়তাম। আপনি তখন আমাদের এ এইচ এম ছিলেন।
মাস্টারমশাইঃ কী নাম বললে?
বিপ্লবঃ বিপ্লব, আমাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। (মাস্টারমশাই তাকিয়ে
থাকে) প্রায়ই মেয়েদের টয়লেটে ঢুকে পড়তাম বলে।
মাস্টারমশাইঃ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল বটে। বসো, বসো (বিপ্লব বসে)।
কবে কার কথা! তখন তো তুমি বাচ্ছা ছেলে।
বিপ্লবঃ হ্যাঁ তো। ক্লাস নাইনে পড়তাম।
মাস্টারমশাইঃ চেহারা ছবি একদম পাল্টে গেছে। কি করে চিনি বল তো?
বিপ্লবঃ আপনি তো একদম বুড়ো হয়ে গিয়েছেন।
মাস্টারমশাইঃ তা বয়েস কি কম হল?
বিপ্লবঃ কি এমন বয়স আপনার? ৬০-৬২?
মাস্টারমশাইঃ সিক্সটি সেভেন।
বিপ্লবঃ দ্য নাইট ইজ টু-উ ইয়াং। আমার বাবার বয়স ৭২। এখনও তরতাজা যুবক। চুলে
নিয়মিত কালার করেন। আপনি কেন করেন না, স্যার? চুলগুলোর জন্যেই
আপনাকে বেশি বুড়ো লাগছে।
মাস্টারমশাইঃ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ে জেতা যায় না। অতএব সারেন্ডার করাই ভালো। যাকগে,
তোমার খবর বলো। কী করছ এখন? বেশ-ভূষা এরকম কেন?
বিপ্লবঃ স্যার, আমি প্রচণ্ড একটা ক্রাইসিসে আছি। আপনার হেল্প চাই।
মাস্টারমশাইঃ আমার হেল্প? ক্রাইসিসটা কি?
বিপ্লবঃ হ্যাঁ তো।
মাস্টারমশাইঃ ক্রাইসিসটা কি?
বিপ্লবঃ স্যার, (ইতস্তত করে) কিভাবে যে শুরু করব, সেটাই বুঝতে পারছি না। আসলে
কি জানেন স্যার আমি না ছোটবেলা থেকেই এরকম-
মাস্টারমশাইঃ কী রকম?
বিপ্লবঃ বাইরে পুরুষ, ভেতরে নারী। সেই ছোট্ট বয়েস থেকেই আমার মেয়েদের সঙ্গে
মিশতে ভাল লাগত। ওদের সঙ্গে গল্প করতাম। খেলনাবাটি খেলতাম। চুরি
পরতাম, চুলে ফিতে বাঁধতাম। বায়না ধরলে আমার মা-ই আমাকে নাচের স্কুলে
ভর্তি করে দিয়েছিল।
মাস্টারমশাইঃ তা তুমি এসব কথা আমাকে—
বিপ্লবঃ বলছি কেন, তাই তো? স্যার, আপনি একদিন আমাদের ক্লাসে বিজ্ঞানের
অগ্রগতির এক্সাম্পল দিতে গিয়ে বলেছিলেন, আজকের দিনে একটা ছেলেকে
মেয়েয় কিম্বা একটা মেয়েকে ছেলেয় বদলে দেওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। মনে
আছে?
মাস্টারমশাইঃ কত কথাই তো বলতে হয় ক্লাসে। সব কি আর মনে থাকে। হয়তো বলেছিলাম।
কিন্ত তাতে কি হল?
বিপ্লবঃ সেই দিন থেকে আমি মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে আমি আমার পুরুষ
মানুষের মলাটটা বদলে ফেলব।
মাস্টারমশাইঃ তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! এসব তুমি কি বলছ পাগলের মতো?
বিপ্লবঃ অন্তত আপনি আমাকে পাগল বলবেন না, স্যার। প্লিজ। এ ব্যাপারে আমি
আপনার হেল্প চাই।
মাস্টারমশাইঃ কী মুশকিল! এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কী হেল্প করব? আমি কি ডাক্তার?
তাছাড়া এসব বাইরের দেশে হয়। অপারেশান-টপারেশান করতে হয়। অনেক টাকা
পয়সার ব্যাপার। এসব কুবুদ্ধি মাথায় নিয়ো না। লেখাপড়া কদ্দুর করেছ?
বিপ্লবঃ করেছি খানিকটা। আপনারা স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবার পর মামাবাড়ি চলে যাই।
সেখানেও একটা কো-এড স্কুলে পড়তে পড়তে ফের একদিন মেয়েদের টয়লেটে
ঢুকে পড়ি। বিশাল ঝামেলা হয়েছিল। গার্জেনরা মাসপিটিশন দেয়। আবার স্কুল
ছাড়া হই।
মাস্টারমশাইঃ তা তোমার মামারা তোমাকে ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করল না কেন?
বিপ্লবঃ ইস। তাহলে আমি ভর্তিই হতাম না। মামারা তো ছেলেদের স্কুলেই ভর্তি করতে
চেয়েছিল। আমি বলেছিলাম তাহলে আমি পড়াশুনোই করব না।
মাস্টারমশাইঃ কেন, ছেলেদের স্কুলে ভর্তি হলে তোমার অসুবিধেটা কী ছিল?
বিপ্লবঃ উঃ, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, স্যার— আমার তো মেয়েদের সাথে মিশতেই
ভালো লাগত। ছেলেদের মধ্যে আমি খুব আন-ইজি ফিল করতাম।
মাস্টারমশাইঃ অ। তারপর, ওই স্কুল ছাড়ার পর কী করলে?
বিপ্লবঃ তারপর প্রাইভেটে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বি এ পাশ করেছি। এখন বাংলায়
এম এ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
মাস্টারমশাইঃ বাঃ, খুব ভালো। এম এ টা পাশ করে চাকরি বাকরির চেষ্টা করো। এসব পাগলামি
বাদ দাও।
বিপ্লবঃ প্লিজ, এটাকে পাগলামি বলে ইগনোর করবেন না, স্যার। আমার যন্ত্রনাটা
একটু বোঝার চেষ্টা করুন। অনেক কষ্টে আপনার ঠিকানা জোগাড় করে বড়ো
আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। প্লিজ হেল্প মি।
মাস্টারমশাইঃ কী মুশকিল! কবে একটা কী বলেছিলাম ক্লাসে, তার জন্য তুমি আমার হেল্প
চাইতে এসে পড়লে। আরে বাবা, এর জন্যে তো ডাক্তারের কাছে যাবে। আমার
কাছে কেন। এসবের আমি কী জানি?
বিপ্লবঃ আপনি আমাকে গাইড করুন। কোথায় কোন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে বলে
দিন।
মাস্টারমশাইঃ সেটা তুমি তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনা করো। তাদের পরামর্শ নাও।
এসব ব্যাপারে আমার কোনও জানাশোনা নেই।
বিপ্লবঃ একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন না। আপনার তো চেনাজানা মানুষের সার্কেলটা
অনেক বড়ো। আমার মনে আছে, আপনি বলেছিলেন সেদিন—আমি তোমার
কষ্টটা বুঝি। কিন্তু এখন আমার কিছু করার নেই।
মাস্টারমশাইঃ কবে বলেছিলাম?
বিপ্লবঃ ওইতো, যেদিন আমাকে তাড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্তটা স্কুলে ডেকে পাঠিয়ে আমার
বাবাকে জানানো হয়। আপনার রুমে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি আপনাকে
বলেছিলাম, স্যার আমি কোনও নোংরামি করতে মেয়েদের টয়লেটে ঢুকিনি।
ছেলেদের টয়লেটে ঢুকতে আমার ভীষণ লজ্জা করে। শুনে আপনি আমার মাথায়
হাত বোলাতে বোলাতে কথাটা বলেছিলেন।
মাস্টারমশাইঃ ও। তা সে যদি বলেও থাকি, কোন পরিস্থিতিতে কেন বলেছিলাম—
বিপ্লবঃ স্যার আপনার পায়ে পড়ি। আমাকে ফেরাবেন না।
মাস্টারমশাইঃ নাঃ, তুমি তো আমাকে ভারী ফ্যাসাদে ফেললে। তোমার বাবা-মা কী বলছেন?
বিপ্লবঃ মা নেই। বাবা এসব ব্যাপারে উদাসীন।
মাস্টারমশাইঃ তোমার বন্ধুবান্ধব? তারা কী বলে?
বিপ্লবঃ আমার কোনও ছেলেবন্ধু নেই। দু একজন মিশতে চাইত উপযাচক হয়ে। কিন্তু তারা
কেউ ভালো নয়। আমাকে মেয়ে মনে করেই মিশতে চাইত আমার সঙ্গে। অসভ্যতা
করত। আমাকে নিয়ে বিছানায় যেতে চাইত। (নীরবতা) স্যার, টবের ওই গাছটা কী
গাছ?
মাস্টারমশাইঃ ওটা ক্যাকটাস।
বিপ্লবঃ ক্যাকটাস! এর ফুল ফোটে না। তাই না স্যার?
মাস্টারমশাইঃ না ক্যাকটাসের ফুল হয় না।
বিপ্লবঃ কিন্তু ক্যাকটাস নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখে। ওর ডালে ডালে ফুল ফুটবে। ওকে ঘিরে প্রজাপ্রতি
উড়বে রঙ-বেরঙের। ফুল ফোটানোর জন্যে ওর বুকটা তো ভেতরে ভেতরে ফেটে
চৌচির হয়ে যায়। সেটা কি আপনারা বোঝেন স্যার? এর চাপা কান্নাটা কি আপনারা
সত্যি শুনতে পান না?
মাস্টারমশাইঃ শোনো, আমার একজনের কথা মনে পড়েছে। একসময় আমার সঙ্গে আলাপ ছিল।
সোমনাথ। সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। শুনেছি ও নাকি অপারেশান-টপারেশান করিয়ে
মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় হয়েছে।
বিপ্লবঃ হ্যাঁ, স্যার। খবরটা আমি পড়েছি। আপনার পরিচিত? স্যার, ওর সঙ্গে একটিবার
যোগাযোগ করিয়ে দেবেন? প্লিজ–
মাস্টারমশাইঃ দেখি চেষ্টা করে। বহুদিন আগেকার কথা। বি এড পড়তে গিয়ে আলাপ হয়েছিল।
তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। খোঁজ-খবর নিতে হবে, বুঝলে?
বিপ্লবঃ স্যার, আপনি আমায় কথা দিন।
মাস্টারমশাইঃ বললাম তো দেখছি।
বিপ্লবঃ উঃ কী আনন্দ যে হচ্ছে আমার। আনন্দে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে।
মাস্টারমশাইঃ বাঃ, তুমি তো সুন্দর নাচতে পার। অর্পূব লাবণ্যময় তোমার শরীর। বসো, বসো
তুমি। মনেই হচ্ছিল না যে তুমি—
বিপ্লবঃ আসলে স্যার, আমি তো মেয়েই। ভগবান ভুল করে আমাকে পুরুষের দেহ দিয়ে
ফেলেছেন। সেই ভুলটা আমি ভাঙতে চাই। পূর্ণ নারী হয়ে উঠতে চাই। স্যার, আমার
এই চাওয়া টা কি অন্যায়?
মাস্টারমশাইঃ না-না। এ তোমার একদম ঠিক চাওয়া। শোনো, বিপ্লব, আমি তোমার এই চাওয়াটাকে
বাস্তবায়িত করবার জন্যে অবশ্যই চেষ্টা করব। তুমি চাইলে সাধ্যমতো টাকাপয়সাও
দেব আমি। আমার বিশ্বাস, সোমনাথ কে আমি ঠিক খুঁজে বের করতে পারব।
বিপ্লবঃ থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
মাস্টারমশাইঃ জানো বিপ্লব, আমিও খুব নিঃসঙ্গ। স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে প্রায় বছর পাঁচেক হল। ছেলে
চাকরির সূত্রে বিদেশে। মেয়ে আন্দামানে।
বিপ্লবঃ এমা, এত বড়ো বাড়িতে তাহলে আপনি একা থাকেন?
মাস্টারমশাইঃ পুরোপুরি একা। বিপ্লব, আজকের দিনটা তুমি আমার সঙ্গে থাকতে পার না? আমরা
একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। গল্প করব। গান শুনব। তুমি নাচবে প্রাণ খুলে। তারপর
পাশাপাশি শুয়ে দু’জন দু’জনকে আদর করব।
বিপ্লবঃ স্যার!
মাস্টারমশাইঃ থাক না বিপ্লব। তুমি যখন নাচছিলে তখন আমি তোমার ভেতরের আকাশটা দেখতে
পেয়েছি। থরে থরে সাজানো রয়েছে মেঘমালা। আমি রুক্ষ শুষ্ক বিদীর্ণ মৃত্তিকা। তুমি
ঝরে পড়তে পার না আমার তৃষ্ণার্ত বুকের ওপর?
বিপ্লবঃ আপনি এসব কী বলছেন? আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আপনি আমার বাবার মতো!
মাস্টারমশাইঃ হ্যাঁ, তাই। তাই তো, আমি তো তোমার বাবার—
বিপ্লবঃ ছিঃ!
মাস্টারমশাইঃ তু-তুমি ভুল বুঝছ আমাকে। বাবা ছেলেমেয়েকে আদর করে না। আমি তো তোমাকে—
বিপ্লবঃ আঃ— (আর্তনাদ করে ওঠে)
মাস্টারমশাইঃ শোনো, বিপ্লব—
বিপ্লবঃ থুঃ!
অন্ধকার