রাশেদ শাওন

‘দড়িতে পড়ল হ্যাচকা টান।’ অমনি মিটিমিটি হাঁসতে থাকে জেমি। মুখের রেখায় হাসির ঝিলিক ধরে রেখে, টিমটিমিয়ে জ্বলতে থাকা আলোটা নিভিয়ে উঠে দাড়ায়। নিজের ডান হাতটা বাম হাতে চেপে ধরে টের পায় মৃত মানুষের মতো বরফ শীতল যেন আঙ্গুলগুলো তার। এবারে দুহাতের তালু ঘষতে থাকে। কিছুটা আরামবোধ হয়। হাতপা ছড়িয়ে টানটান করে। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে যে আড়ষ্ঠতা ছিল গায়ে, মনে তা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। এ ঘর থেকে ফ্রিজ খোলার শব্দ শোনা যায়। শোনা যায় কাঁচের গ্লাসে কিছু একটা পড়ার শব্দ। মৃদু অথচ নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দেওয়া বুদবুদ ওঠার শব্দটাও কানে পড়ে জেমির পড়ারলেখার ঘর থেকে। একটা গ্লাস হাতে করে ফিরে আসে সে। এরই মধ্যে পোশাক বদলে নিয়ে্ছে। ঘুমের পোশাক পরেছে, গরম কাপড় ছেড়ে।

গ্লাসে কয়েকটা ঘণঘণ চুমুক দিতেই তার আরও গরমগরম লাগে। ল্যাপটপ রাখা যে টেবিলে তার পাশে গ্লাসডোরটা সরিয়ে বাইরে তাকায়। সারা দুনিয়া আবছা শুভ্র আলোতে ভেসে যাচ্ছে। ব্যালকোনির মেঝেতে বরফের কয়েক ইঞ্চি পুরু আস্তর। তাতে পা রাখলে, কম করে হলেও ইঞ্চি দশেক ডুবে যাবে। তা বুঝতে পেরেও পা বাড়িয়ে দেয়। এখনও বরফ ঝড়ছে। ঝুরঝুর করে। সে মনে মনে ভাবে বৃষ্টি ঝড়তে থাকে ছন্দে ছন্দে। মেঘেরাও উড়ে চলে একটা গতিতে। কিন্তু বরফ কেন যেন নিয়ম মানে না। তার না আছে ছন্দ, না আছে কানো তরঙ্গ জ্ঞান। তাদের কোনো তাড়া নেই। তাদের ভাবখানা এমন, পড়তে ইচ্ছে হইছে তাই ঝড়ে পড়লাম; স্বেচ্ছাচারী যেনো। আবার যখন আজকে রাতের মতো অনবরত তুষারপাত হতে থাকে তখন তারা যেনো উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারা। ঝুপঝুপ করে ঝড়ছে তো ঝড়ছেই। সেই ঝড়ে পড়া বরফগুলোকে হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় পঞ্চাশের চৌকাঠ ছোঁয়া এই নারী। অনেকক্ষণ ধরে হাত বাড়িয়ে থাকে মুঠোয় বরফ ধরবে বলে। ফেলে আসা দিনগুলোর মতো, ঘুমিয়ে থাকা রাতের মতো তুষারকণাগুলো তাকে ভিজিয়ে দেয় ঠিকই কিন্তু জমে না তারা। গলে পানি হয়ে যায় তাকে ছোঁয়া মাত্র। সে ভাবতে থাকে, বৃষ্টি তার খুব প্রিয় ছিল এক সময়। বাংলাদেশের বৃষ্টি। বৃষ্টি নিয়ে তার পছন্দের লেখক হুমায়ূন আহমেদের একটা কথা সে ভুলতে পারেনি আজও।

“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বৃষ্টি পড়ে বাংলাদেশে।”

অথচ সেই সুন্দর বৃষ্টি ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, সাতসমূদ্র তের নদী পার হয়ে আজ এইখানে জেমির একলার সংসার। যে সংসারে সেই কর্তা আবার সেই গিন্নি।

আবার এও ভাবে, ‘বেশতো আছি। সাজানো একটা ঘর, দামি গাড়ি, সপ্তাহে পাঁচ দিন দশটা-ছয়টা কাজ, লেখালেখি, বন্ধুবান্ধব, হুল্লোড়, লংড্রাইভ, ঘোরাঘুড়ি সবই চলছে। সামার, ফল, উইন্টার; উইন্টার এলে সামারের জন্যে অপেক্ষা, সবই যেন একটা ছকে বাঁধা, পরিকল্পিত।’

যদিও মাঝে মাঝে তার কাছে এ স্বাধীন জীবনটা একটা দেখতে না পাওয়া, বুঝতে না পারা জালের ভিতরে আটকে থাকা। মুক্ত জীবনটাও যেনো চোরকির সূতোয় বাঁধা। এখানে এই বিদেশবিভুঁইয়ে এরই নাম জীবন। শুধুতো তার মতো সংসার বিবাগীরাই নয়, যারা পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার মেলা সাজিয়ে বসেছে তাদেরও কি একই পরিস্থিতির ভিতর বসবাস নয়?

নানা কিছু ভাবতে ভাবেত বরফ শীতল হাতটা নিজের ‍চিবুকে নিয়ে রাখে সে। এর পর তা ছুঁয়ে নেয় ঠোঁটে, গলায়, বুকে। কেমন একটা শান্তি অনুভূত হয় দেহের ভিতরে, মস্তিস্কে। বহু দিনের শুষ্ক-তপ্ত ভিতরটা যেন এক পষলা বৃষ্টির ছোঁয়ায় ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

অবশেষে ধর্ষকটাকে ফাঁসি ঝুলিয়ে মারতে পেরেছে সে। অথচ কতই না কসরত করতে হয়েছে কয়েকটা মাস। সমাজ, সংসার, আইন; কত দিকই সামলাতে হল, প্রেমিক ছদ্দবেশী পুরুষটাকে তার কৃতকর্মের জন্যে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো পর্যন্ত। এখন সে তৃপ্ত, আনন্দিত ও গর্বিতও। অন্তত্য একজনকে সে মারতে পেরেছে, এত বছর পরে হলেও।

আমার পছন্দ ছিল এহতেশামকে। পাগলের মতো ভালোবাসতাম আমার চেয়ে বছর দশেকের বড় কাজিনটাকে। সে বুঝেও নাবোঝার ভান করত। আমি চাতক পাখির মতো তার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। সে সময় আমার সরলতার সুযোগে অনুপ্রবেশ ঘটে লিখনের। একই ক্লাশে পড়তাম। এক সাথে ভার্সিটিতে যাওয়া, ক্লাশ শেষে ঘোরাঘুরি, প্রজেক্টগুলো করতে একে অন্যের বাসায় আসাযাওয়াও ছিল আমাদের।

কতইবা বয়স তখন আমার। সবেমাত্র ভর্তি হয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবেগী, অভিমানী, আর কিছুটা খামখেয়ালী স্বভাবের মেয়ে ছিলাম তখন আমি। মাঝে মাঝে নিজেকে বুঝতে পারতাম না। এহতেশাম ভাইয়াকে যতটা ভালো লাগতো ঠিক ততটাই অবহেলা পাচ্ছিলাম তার কাছ থেকে। ভিতর ভিতর তাকে না পাওয়ার তৃষ্ণায় কেমন যেন মনের অবাধ্য হয়ে উঠছিলাম দিনেদিনে। এমন সময় ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে ক্লাশমেট লিখনের সাথে। দিনে দিনে তার হাতের পুতুলে পরিণত হতে থাকলাম। সেই সুযোগটা নিল সে। আমাকে জয় করতে শুরু করল। নিজের অজান্তে তার ফাঁদে আটকে গেলাম। তাকে সবচেয়ে আপন বন্ধু ভাবতে লাগলাম। আমার সব না বলা কথাগুলো তার সাথে শেয়ার করতাম। সব খুনসুটিগুলো ওর সাথেই চলত। কিন্তু এক দুপুরে ঘটে গেল আমার সর্বনাশ। বাসায় কেউ ছিল না সেদিন। ক্লাশ থেকে ফিরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। লিখন ফোন করেছিল বাসার ল্যান্ডফোনে। টেলিফোন বাজার শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। আমি ফোন ধরতেই সে জানালো মেহতাব স্যারের ক্লাশটা কিছুই বুঝতে পারেনি। মানবদেহের হরমনগুলো তার কাছে যেন মহাবিস্ময়। আমি জুলজিতে বেশ ভালো ছিলাম আগে থেকেই। ওর বুঝতে না পারার কথা শুনে বাসায় আসতে বললাম তখনই। কথার ফাঁকে এও বললাম আপু আর আম্মু বাসায় নেই। ফিরতে রাত হবে। সে যেন খুব দ্রুতই আসে বাসায়। আমরা পড়াশোনার পাশাপাশি কিছুটা সময় আড্ডাবাজিও করতে পারব অনায়াশে।

লিখন কি বুঝলো জানি না। সে এল যেনো রকেট গতিতে। আমি তখনও ফ্রেশ রুমে। বারবার কলিং বেল বাজার শব্দে নিজেকে গোছগাছ না করে তাড়াহুড়ো করে সদর দরজায় দেখতে গেলাম, কে এসেছে? দেখি লিখন দাড়িয়ে দরজার ওপাশে। সে যেহেতু ছিল আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু তাই কোনোরকম লাজশরমের কথা না ভেবে দরজা খুলে তাকে ভিতরে আসতে বললাম স্বাভাবিকভাবে। সে কি বুঝল জানি না। ঘরে প্রবেশ করেই আমাকে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে গেল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার উপরে ঝাপিয়ে পড়ল। সব খোয়ানোর পথে আমার কোনো বাঁধাই আর বাঁধা হতে পারল না তার কাছে। লিখন আমাকে নিয়ে নির্বিচারে খেলে গেল শয়তানের মতো। আমি হয়ে গেলাম তার হাতের পুতুল। আর সে আমার শরীরটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে পালালো, যখন বুঝলো আমাকে শুধু ভোগই করেছে, তার পৈশাচাকতায় কোনো সায় ছিল না আমার।

ঘটনার মাসখানিক পরে জানলাম ধনীর বখে যাওয়া তরুণ লিখন বিদেশে পাড়ি দিয়েছে পড়াশুনার নাম করে। আসলে ততদিনে জানোয়ারটা বুঝে গিয়েছিল, আমি তাকে ক্ষমা করব না কোনোভাবেই। ওর নামে থানায় অভিযোগও করেছিল আমার পরিবার। তাতে সুবিধা হচ্ছিল না তথ্যপ্রমাণের অভাবে। আমিতো জানতাম না, শ্লীলতাহানীর অভিযোগ করতে গেলে মেডিকেল করাতে হয়, আলামত নষ্ট করা যায় প্রমাণস্বরূপ।

সে দিন পিশাচটা ফিরে যাওয়ার পরে লজ্জায়-অপমানে, আর শারীরিক যন্ত্রণায় শাওয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে ছিলাম কতক্ষণ মনে নেই আজ। মা আর বড়পু বাসায় ফিরে আমাকে দেখতে পায় বাথটাবে সজ্ঞাহীন অবস্থায়। ফ্লাটের সদর দরজা বাইরে থেকে টেনে দেওয়া ছিল। লক ছিল না ভিতর থেকে। তারা কিছু একটা আঁচ করলেও আমার কাছে কিছু জানতে চায়নি সেদিন। তারা ভাবেইনি আমি ধর্ষিত হয়েছিলাম আমারই সহপাঠির কাছে। পুরো ঘটনাটি পরিবারের কাছে জানাই সপ্তাহখানিক পরে।

আমি ততদিনে ক্লাসে যাওয়া ছেড়েছি। খাওয়াদাওয়ায় অনিয়মিত। রাতে নিজের বিছানায় নির্লিপ্তের মতো শুয়ে থাকি অপলক জেগে থেকে। যখনই চোখ বন্ধ করি বা তন্দ্রা আসে তখনই দেখতাম বন্ধুরূপী হায়নার লোলুপ চোখ। দিনে দিনে আমি ভেঙ্গে চূড়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকলাম। এমন সময় একদিন এহতেশাম ভাইয়া এল আমাদের বাসায়। আমি জানতামও না। পরে শুনেছি, আমার আচমকা এমন পরিবর্তন দেখে বড় আপুই তাকে খবর দিয়ে ডেকে এনেছিল। ভাইয়া যেহেতু তাকে নিয়ে আমার আগ্রহের বিষয়ে জানত তাই এমন দুর্দিনে সে আর চুপচাপ থাকেনি। আমার পাশে এসে দাড়িয়েছিল ভাই হয়ে।

সেদিন সে নানা প্রশ্ন করেছিল আমাকে। তার কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। শুধু যখন সে জানতে চাইল- আমি প্রেমে ছ্যাকা খেয়েছি কিনা, তখনই তাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমার কান্নার শব্দে বাড়ির সকলে এসে জড়ো হয় আমার শোবার ঘরে। সেই কান্না খানিক বাদে থামলেও লাগাতার হিচকি শুরু হয়। সেই ভয়াবহ হিচকির তোড় সামলাতে সামলাতে বলে উঠি, “আমার সর্বনাশ করেছে লি-খ-ন।”

কেউ কথাটি সাথে সাথে শুনেছিল কিনা জানি না তবে ভাইয়ার তা বুঝে নিয়েছিল মুহুর্তের মধ্যে। সাথেসাথে তার বাম হাতটা আমার মাথায় বুলাতে বুলাতে বলেছিল- “তোর কিছুই হয়নি, পাগলী। কিচ্ছু না।”

এর পর নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। আমরা যে বাড়িতে থাকতাম তা ছিল দাদার সম্পত্তি। ডেভলপার কোম্পানি পুরোনো বাড়ি ভেঙ্গে দশ তলার বাড়িটি তৈরি করেছিল। আর ওয়ারিশ সূত্রে আমরাও একটি ফ্ল্যাট পেয়েছিলাম। তো সঙ্গত কারণেই এলাকায় আমাদের সবাই চিনতো লোকাল হিসেবে। ভাইয়াদের দাপটটাও ছিল ভালোই। সে তার বন্ধুবান্ধব আর এলাকার অন্য লোকালদের নিয়ে লিখনদের বাসায় একদিন হামলাও করল। ইবলিশটার বাড়ি ছিল পাশের পাড়ায়। আর ওরা ছিল পয়সাওয়ালা। সঙ্গত কারণে পুলিশ প্রসাশন ছিল ওর বাবার পকেটে। সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে লিখন মাসখানেকের মধ্যে পাড়ি দেয় বিদেশে।

এদিকে আমি অপমানে, বিতৃষ্ণানায় দিনে দিনে আরও কুঁকড়ে যেতে থাকি। নিজেকে শোবার ঘরের চার দেওয়ালে বন্দী করে ফেলি। আর ভিতর ভিতর ভেঙে চুড়মার হতে থাকলাম। আমার চারপাশে তখন অন্ধকার আর দিশেহারা প্রতিটি মুহুর্ত। সেই সময় সুযোগটা এল। আমার জীবনের অন্ধকার অধ্যায় শুরু মাসখানেক আগে কৌতুহল বশে বিদেশের একটি ইউনিতে ভর্তির জন্যে আবেদন করি। তারই জবাবে মেইলটা আসে তিন মাস পর। তা হাতে পেয়ে আমি যেনো বেঁচে থাকার একটা রাস্তা খুঁজে পাই। পাড়ি দিই সহস্র মাইল পথ। চলে আসি আমার আপন ভূবনে গড়তে এই ঠাণ্ডার দেশে। এখন যেখানে আমার বাস।

এর পর ধীরে ধীরে সময়গুলো আমার পক্ষে এলো। মাথা খাঁড়া করে দাড়ালাম। নতুন করে স্বপ্ন বুনতে থাকলাম। ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে শুরু করলাম পেশাজীবন। ব্যস্ত হয়ে গেলাম কেরিয়ার গড়তে। নরম মাটির দেশের নারীদের মতো বার হাত শাড়ি আমি অঙ্গে জড়াই আজও কিন্তু ভিতরটা জ্বলে পুড়ে অঙ্গর যেনো। সেখানে এক ইস্পাত কাঠিন মন আমার। আশপাশের কিছুই সে শক্তপোক্ত মনে ধরে। শুধু ভিতর ভিতর প্রতিশোধ পরায়ন আরেকটা আমি বড় হতে থাকে দিনে দিনে। আবচেতন মনে নানাভাবে খুঁজতে থাকি শয়তানরূপী পশুটাকে। ততদিনে পেরিয়ে গেছে দশটি বছর।

একদিন ঠিকই হদিস মিলল লিখনের। সে আমার মত প্রবাসী হয়নি। ফিরে গেছে দেশে। পৈতিক ব্যবসা তার হাতে পড়ে এখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে জানতে পারি, সে এখন ‘বিগ ফিস’। শুধু ব্যবসা করেই মন ভরছে না মহাজনের। তার নাকি ক্ষমতা চাই। সামনের ইলেকশনে তাই প্রার্থী হতে চায়। এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন দলে নামও লিখিয়েছে সে। এসব জানতে পেরে ভাবি, এইতো মোক্ষম সময়। আর মনে মনে প্রতিদিন আওড়াতে থাকি- ‘বার বার ঘুঘু তুমি ধান খেয়ে যাও, এই বার ঘুঘু তুমি…’

৩.

খুব বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি যাকে বলে। এমন বৃষ্টি দেখে মনে পড়ে হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত উক্তি।

“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বৃষ্টি পড়ে বাংলাদেশে।”

এগার বছর পর দেখছি বাংলাদেশের বৃষ্টি। আর হাসছি মনে মনে। আহা! মুক্তি। আমার মুক্তি। আলোতে নয়। আমার মুক্তি মিলিছে অন্ধকার থেকে। সে লুকিয়ে ছিল এতটা বছর। কোনো দিন ভাবিনি এত সহজে পাব তার দেখা। এতটা পথের বাঁক পেড়িয়ে এসে দেখি সে ছিল মোড়ে দাড়িয়ে।

কি সব ভাবতে ভাবতে ট্যাক্সি থেকে থেমে সোজা গিয়ে দাড়ালাম ইমিগ্রেশনের চেক ইন লাইনে। হাতে বিদেশি পাসপোর্ট দেখেই কিনা জানি না একজন নিরাপত্তা কর্মি এগিয়ে এসে আমাকে রাস্তা দেখিয়ে সামনে এগিয়ে দিলেন। আমি আর না করলাম না।

নির্বিঘ্নে সবগু্লো ধাপ পাড় করে বসলাম গিয়ে এয়ারলায়েন্সের প্যাসেন্জার লাউণ্জে। তখনই হঠাৎ চোখে পড়ল পাশেই যাত্রীর হাতে ধরা পত্রিকায়। প্রথম পাতাতেই খবরটি ছাপা হয়েছে। পাতাটির মাঝামাঝি বরাবর একটি বক্সস্টোরির শিরোনাম- ‘বিখ্যাত ব্যবসায়ির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার’। তার ঠিক নিচে ছোট করে সাবহেড- ‘হত্যা নাকি আত্মহত্যা’। খটকা লাগলো- হত্যা নাকি আত্মহত্যা?

আড়চোখে তাকিয়ে অন্যের পড়তে থাকা সংবাদপত্রে ভুলেও তাকাইনি কোনোদিন। সংবাদটির সাথে ইনসেটে জুড়ে দেওয়া ছবিটি দেখার জন্যে সেই কাজটিই করলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকালো বিরক্তি নিয়ে। আমি নিজেকে সামলে মৃদু হাসলাম। তখনই এয়ারলায়েন্সের অ্যানাউন্স ডায়াস থেকে ভেসে এল সুরেলা কণ্ঠে ঘোষণা। স্বভাবসুলভভাবে মিটিমিটি হাসতে থাকি অনবরত।

কেন যেন জীবনান্দ দাসে কবিতার লাইন মনে এল-

“আমি অনেক দিন-অনেক অনেক দিন

অন্ধকার সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যূর মতো মিশে থেকে

হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব ব’লে

বুঝতে পেরেছি আবার;”

মাথার ভিতরে আরো ঘণ থাকে আবেগ। আমি মিটিমিটি হাঁসতে থাকি। কবির এই কবিতাটি স্কুলে এক বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় আবৃত্তি করেছিলাম। তখন আমি নাইন কি টেনে পড়ি। মুখস্থই ছিল তা। চোখ বন্ধ রেখে আবেগে ভেসে যেতে আবৃত্তি করছিলাম-

“হায়, উৎসব!

হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে

আবার ঘুমাতে চেয়েছি আমি,

অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যূর মতো মিশে

থাকতে চেয়েছি।”

এ পর্যন্ত এসে আমাকে থামতে হয়েছিল। অডিশন নিতে থাকা শিক্ষক ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “হয়েছে হয়েছে। এবার নিজের সিটে গিয়ে বস।”

তিনি বিড়বিড় করে আরও একটি শব্দ বলেছিলেন সেই মুহুর্তে। অন্যরা শুনেছিল কিনা জানি না। আমি স্পষ্ট শুনলাম, “কি অশ্লীল”।

এর পর থেকে স্কুলের অনেকেই আমাকে ‘অশ্লীল’ বলে ডাকত। যদিও আমার চলনবলন, পোশাকপরিচ্ছদ এমনকি ব্যক্তিত্বেও কোনদিনই দৃষ্টিকটু এমন কিছু ছিল না যাতে আমাকে অশ্লীল নামে ডাকা যায়। 

৪.

সাতসকালে বিছানা ছাড়া জেমির অভ্যাস। আজও খুব সকালে ঘুম থেকে জেগেছে। ইচ্ছা ছিল পুরো সকালটা বাইরে বরফের মধ্যে হেঁটে হেঁটে কাটিয়ে দেবে। গত রাতে যে পরিমান তুষারপাত হয়েছে, এমনটা হয় খুব কম। এ বছর পুরোপুরি উইন্টার শুরু আগেই এমন তুষারপাত কিছুটা অপ্রত্যাশিত এবং এ বছর শীতের শুরুতে এই প্রথম তুষারপাত। তা তার জীবনে শান্তির বারতা নিয়ে এল কিনা জানা নেই তবুও সে ভেবেছিল সকালটা উদযাপন করবে প্রকৃতির সাথেই। তবে সে আর হয়ে ওঠেনি। একটা ইমেইল এসেছে আধাঘণ্টা আগে। আমেরিকার বিখ্যাত এক পাবলিসার্স থেকে এসেছে তা। তারা ইমেইলে জানিয়েছে, তার লেখা গল্পের বইয়ের পান্ডুলিপি ‘এ রেপিস্ট ডিসার্ভ হ্যাংগিং ডেথ’ ছাপাতে চায়। তারই অনুমতি চেয়ে কিছু অফিসিয়াল কাগজাদি এসেছে একটা অ্যাটাচড ফাইলে। সেসব নিয়ে বসেছে সে।

পঞ্চাশে এসেও নতুন যে জীবন ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে তা সে দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে যেন। খুব কাছেই তা। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখা যাবে আর কিছুক্ষণ পরেই।