ইমন চৌধুরী

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি নাদিয়া আমার দিকে আগুনচোখে তাকিয়ে আছে। আগুনচোখে বললে অবশ্য কম হয়ে যায়! এসিডচোখেও বলা যেতে পারে! আগুনের চেয়ে কিছু কিছু এসিড অনেক বেশি পাওয়ারফুল। নাদিয়ার দৃষ্টিও আমার কাছে সেরকম মনে হয়। ওর দৃষ্টিতে আমি পুড়ে পুড়ে রোজ ছাই হই! বহুকাল আগে এক বইমেলায় ওকে প্রথম দেখে আমি পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিলাম! কয়লা থেকে এখন ছাই হই! এরপর আর কী কী হতে হবে ভাবতে গেলে চোখে সর্ষেফুল দেখি!
আমার বিরুদ্ধে নাদিয়ার সবচেয়ে বড় অভিযোগ, আমার নাকি সামান্য একটা মশা মারারও ক্ষমতা নেই! প্রায়ই আমাকে চারপেয়ে একটা প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করে সে। প্রাণীটার নাম জানতে চেয়ে আমাকে দয়া করে কেউ বিব্রত করবেন না!
মশারির ভেতর একটা মশা ঘুরছে অনেকক্ষণ ধরে। নাদিয়া আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলতেই আমি উঠে বসলাম। ভয়ে ভয়ে বউয়ের চোখে চোখ রাখলাম। নাদিয়া শীতল গলায় বলল, ‘মানুষ বউয়ের জন্য কত কী করে! আর আমার ভাগ্যে জুটেছে একটা…!’
আবার সেই চারপেয়ে প্রাণীর সঙ্গে তুলনা! প্রিয় পাঠক, প্রাণীটার নাম এবারও চেপে গেলাম। বউয়ের কাছে না-থাকলেও সমাজে আমার খানিকটা সম্মান আছে। ঘটা করে সবাইকে প্রাণীটার নাম জানিয়ে দিয়ে আমি নিজের সম্মানটুকু খোয়াতে চাই না।
আমি আদুরে ভঙ্গিতে নাদিয়ার ডান হাতটা ধরতেই যেন গোটা পৃথিবীটা মৃদু ঝাঁকুনি খেল! এক ঝটকায় আমার কাছ থেকে নাদিয়া তার কাশফুলের মতো শুভ্র হাতটি বন্ধনমুক্ত করে বলল, ‘খবরদার! ঢং করবে না! আমি রোজ এত যত্ন করে মশারি খাটাই। তারপরও ভেতরে মশারি ঢুকে কী করে?’
‘সেটা তো আমারও প্রশ্ন!’
‘কথা না প্যাঁচিয়ে দয়া করে মশাটা ধরো।’
‘কী মুশকিল! মশা ধরব কী করে! মশার কি হাত আছে না লেজ আছে যে ধরব?’
‘আমার সঙ্গে একদম ইয়ার্কি করবে না। তোমার সঙ্গে আমার ইয়ার্কির সম্পর্ক না!’
‘তাহলে কিসের সম্পর্ক?’
নাদিয়া চুপ হয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কটা ভালোবাসার। ‘ভালোবাসা’ শব্দটা উচ্চারণ করতে নাদিয়া কি লজ্জা পাচ্ছে! অবশ্য ভালোবাসার সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কিও খানিকটা চলতে পারে।
নাদিয়া এবার পাল্টা প্রশ্ন হাঁকাল, ‘কিসের সম্পর্ক তুমি বোঝো না? তোমার মতো রোবটের পাল্লায় পড়ে আমার জীবন শেষ! মানুষ বউয়ের জন্য কত কী করে! আর তুমি সামান্য একটা মশাও মারতে পারো না!’
নাহ্! এই অপবাদ আর সহ্য করা যায় না। আজ মশার একরাত কি আমার একরাত! অবশ্য মশার যে মতিগতি দেখছি তাতে আমার একরাত না দশ রাত ঠিক বুঝতে পারছি না।
আমি একবার নাদিয়ার দিকে তাকাই, আরেকবার মশার দিকে তাকাই। ত্যাঁদড় মশা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে মশারির ভেতর। দু’চারবার হাত চালিয়েও দেখলাম। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হলো না। ত্যাঁদড় মশা প্রতিবারই হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। মশা মারতে কামান দাগানোর কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু এই বজ্জাত মশাটাকে কামান দিয়েও ঘায়েল করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। রীতিমতো ডিনামাইট বা আকাশ থেকে উপর্যুপরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে হবে। তাতে অবশ্য মশার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও উড়ে যাবো! সেটা ঠিক হবে না।
নাদিয়াকে বললাম, ‘আমি মশাটাকে চোখে চোখে রাখছি। তুমি মশা মারার ব্যাটটা নিয়ে এসো। আর সঙ্গে চুলায় ডিম সিদ্ধ দাও!’
‘ডিম সিদ্ধ দাও মানে!’ নাদিয়ার কণ্ঠে বিস্ময়।
‘খালি হাতে যুদ্ধ করা যায় নাকি! যুদ্ধ করতে গেলে হাতে যেমন অস্ত্র থাকা চাই, তেমনি গায়ে থাকা চাই শক্তি। শক্তি বাড়াতে ডিম খাওয়ার বিকল্প নেই! যা বলছি করো, আজ মশার একদিন কি আমার একদিন!’
নাদিয়া এবার হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। তারপর কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে রইল। নাদিয়ার এই চেহারা দেখে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি জানি এটা ঝড়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্ত! এরপর ঝড় শুরু হবে। সেই ঝড়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। ঝড়ের তীব্র হাওয়ায় আমি উড়ে গিয়ে কোথায় গিয়ে পড়ব নিজেও জানি না!
মশাটা মাথার চারপাশে ঘুরছে। প্যাঁ-পুঁ আওয়াজ করছে বিরতিহীন। আমি নাদিয়ার রুদ্রমূর্তি দেখে আরেক দফা হাত চালালাম। বজ্জাত মশার পেছন পেছন ছুটলাম কিছুক্ষণ। খাটের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আবার ও প্রান্ত থেকে এ প্রান্ত। মশাটা মনে হচ্ছে মজা পেয়ে গেছে। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে আমার করুণ পরিণতি। সামান্য একটা মশাও মারতে না পারার যে অপবাদ, সেই অপবাদ থেকে এই জীবনে কি আমার আর মুক্তি নেই!
নাদিয়া খাটে হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে আমাকে দেখছে। আমি একবার মশা দেখি, আরেকবার নাদিয়াকে দেখি। হঠাৎ মিসাইলের গতিতে ‘ঠাশ’ করে একটা শব্দ ভেসে এলো আমার কানে। অমনি চোখ বন্ধ করে ফেলি আমি। চারদিকে সুনসান নীরবতা নেমে এলো। নাদিয়া চুপ। মশাটাও চুপ। চোখ মেলতেই দেখি মশাটাকে মেরে টিস্যু পেপারে হাত মুছছে নাদিয়া। তারপর একসময় টিস্যু পেপারটা এক পাশে ছুড়ে ফেলে কোলবালিশটা টেনে নিল বুকের কাছে। চুপচাপ শুয়ে পড়ল নাদিয়া। আমি ভয়ে ভয়ে তার দিকে হাত বাড়াতেই মুখ ঝামটা মেরে নাদিয়া বলল, ‘খবরদার! আমাকে স্পর্শ করবে না একদম! সামান্য একটা মশা মারতে ডিম সেদ্ধ খেতে হয়, আবার বড় বড় কথা! জীবনে একটা মশাও মারতে পারলে না! লজ্জা করে না তোমার!’
‘জীবনে একটা মশাও মারতে পারিনি এটা ঠিক। কিন্তু তোমার মতো এক রূপবতী নারীর হৃদয় জয় করে তাকে বিয়ে করেছি। এরপরও বলবে আমি কিছুই পারি না?’
নাদিয়া জবাব দিল না। উত্তাল সমুদ্র ধীরে ধীরে শান্ত নদী হয়ে আসছে। যে করেই হোক, একটা মশা আমাকে মারতেই হবে। মশা মেরে এই নারীর হৃদয় আমাকে দ্বিতীয়বারের মতো জয় করতে হবে। আমি কি পারব! আচ্ছা, মশাগুলো এত ত্যাঁদড় হয় কেন!