পলাশ মজুমদার

দিন দিন মৌমিতা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আগের সেই মৌমিতাকে প্রবাল কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। মৌমিতার এই পরিবর্তন অস্বাভাবিক ঠেকছে ওর কাছে। শুধু প্রবালের নয়, মৌমিতার মা-বাবার কাছেও। কী হয়েছে মৌমিতার, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ও। কারণ জিগ্যেস করলেও মৌমিতা বলছে না কিছু। সব সময় আনমনা। ভাবলেশহীন। অফিসে যাচ্ছে-আসছে। প্রায়ই ফিরছে রাত করে। অফিসের কথা বলে বের হচ্ছে ছুটির দিনেও। প্রবালের সঙ্গে মন খুলে কথা বলছে না। মৌমিতা ওকে শুধু এটুকু বলছে যে অফিসে কাজের বড্ড চাপ।

ছেলের দিকে পর্যন্ত ঠিকমতো খেয়াল নেই মৌমিতার। তিন বছর বয়সি অমিতাভকে সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাবার বাসায় দিয়ে যায় মৌমিতা; আর বিশ^বিদ্যালয়ের ক্লাস ও অন্যান্য কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় নিয়ে আসে প্রবাল। সন্ধ্যার পর অমিতাভ প্রবালের কাছে থাকে। বাবাকে তখন চোখের আড়াল হতে দেয় না ছেলে। দুজন কখনো ঘুরতে বেরিয়ে যায়। পার্কে, রেস্টুরেন্টে কিংবা কোনো বন্ধুর বাসায়। তিনজন শেষ কবে একসঙ্গে বেরিয়েছে, প্রবালের ঠিক মনে পড়ে না। যে মৌমিতা একসময় ঘুরতে পছন্দ করত, সে এখন ঘোরাঘুরির কথা মুখেও আনে না। প্রবালকে অবাক করে বিষয়টি।

মৌমিতা দেরি করে ফিরলেও কিছু বলা যাচ্ছে না; বললে শুরু হয় কথা-কাটাকাটি। কয়েক দিন আগে ঝগড়াঝাটির একপর্যায়ে মৌমিতা বলে ফেলেছে—তুমি মনে হয় আমাকে সন্দেহ করছ; আগের মতো বিশ^াস রাখতে পারছ না। এত সন্দেহ করলে একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। প্রবাল আর কথা বাড়ায়নি; বাড়ালে সেদিনই হয়তো চূড়ান্ত কিছু হয়ে যেত।

সামান্যতে মৌমিতার মেজাজ উঠে যাচ্ছে সপ্তমে। বেশির ভাগ সময় চুপ থাকলেও কখনো সহ্য করতে না পেরে জবাব দিচ্ছে প্রবাল। তখনই শুরু হয় ঝগড়া।

এমন তো ছিল না মৌমিতা। নম্রতা-ভদ্রতার জন্যই সবাই মৌমিতার প্রশংসা করত। চুপচাপ আর সহৃদয় ব্যবহারের কারণে প্রবাল পছন্দ করেছিল মৌমিতাকে; সাড়া দিয়েছিল মৌমিতার প্রস্তাবে; বিসর্জন দিয়েছিল নিজের ভালো-লাগা, সমাজ-ধর্ম, অভ্যাস—প্রায় সবকিছু। পা বাড়িয়েছিল সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জীবনে।

সবাই জানে, ওরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। আসলে তা নয়। অনেকটা বাধ্য হয়েই বিয়েতে রাজি হয়েছিল প্রবাল।

দুজন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ত একসঙ্গে। প্রথম প্রথম ওদের গ্রুপের সবাই জানত যে প্রবাল ওর স্কুলের এক সহপাঠিনীকে ভালোবাসে। ও সে রকমই তাদের জানিয়েছিল। ওই মেয়েটি আবার ঠিক পছন্দ করত না প্রবালকে, হাই-হ্যালোর মধ্যে রাখতে চেয়েছিল সম্পর্কটি। অপরূপ সুন্দরী সুপর্ণা ঘোষ নামের মেয়েটির প্রেমে বয়ঃসন্ধির সময়ে হাবুডুবু খেয়েছিল ও।

সুপর্ণা ছিল প্রবালের প্রথম ক্র্যাশ। দিনে দিনে সেই আবেগ না কমে বরং বেড়েছে। সুপর্ণা থাকত প্রবালদের পাশের পাড়ায়। ওদের মধ্যে দূর-সম্পর্কের আত্মীয়তার সংযোগও আছে কিছুটা। সুপর্ণার এক মাসি প্রবালের কাকি হয় সম্পর্কে। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে দুজনের প্রায়ই দেখা হতো। তবে তেমনভাবে কথা হতো না। সুপর্ণা ওকে যেন এড়িয়েই চলেছে সব সময়। অনেক চেষ্টার পরও প্রবাল সুপর্ণাকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারেনি। হয়তো সুপর্ণা তখন অন্য কোনো ছেলেকে ভালোবাসত বলে সাড়া দেয়নি প্রবালের আহ্বানে। তবু প্রবাল আশা ছাড়েনি কখনো।

মফস্বলের একই কলেজ থেকে পাস করে প্রবাল ভর্তি হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। সুপর্ণা ইডেন কলেজে। ওদের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে ঢাকায় আসার পরও। প্রবালের মনে তাই ক্ষীণ আশা ছিল। সুপর্ণার প্রতি প্রবালের দুর্বলতার বিষয়টা মৌমিতাসহ অন্য বন্ধুরা জানত। প্রবালের বন্ধুভাগ্য বরাবরই ভালো। বন্ধুরা তার জন্য সব করতে রাজি। এমনকি কয়েক বন্ধু এগিয়ে এসেছে সুপর্ণার বিষয়েও; এই প্রচেষ্টায় যুক্ত ছিল মৌমিতাও। প্রকৃত বন্ধু হিসেবে প্রবালের পাশে দৃঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল সে; সুপর্ণাকে রাজি করানোর সব ধরনের চেষ্টা করেছিল মৌমিতা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি।

মৌমিতার এই সংবেদনশীলতার জন্যই প্রবাল ঝুঁঁকতে থাকে মৌমিতার দিকে; যেকোনো সমস্যায় মৌমিতার সহযোগিতা চাইত ও; খুব সহজে সমাধান দিতে পারত মৌমিতা। মৌমিতার সাহস আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে মুগ্ধ ছিল প্রবাল। ধীরে ধীরে মৌমিতার প্রতি তৈরি হয় ওর একধরনের নির্ভরতা। একসময় প্রবাল খেয়াল করে যে মৌমিতা ওর প্রতি কিঞ্চিৎ দুর্বল হয়ে পড়েছে। মৌমিতার চাহনি, কথা বলার ভঙ্গি হয়ে ওঠে কেমন যেন মাদকতাময়। যখন-তখন কারণে-অকারণে মৌমিতার ফোন, দেখা করার জন্য ব্যাকুলতা ভাবনায় ফেলে দেয় প্রবালকে। মৌমিতার মানসিক অনুভূতি টের পেলেও প্রবাল প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী ছিল না।

প্রবাল জানত, মৌমিতার সঙ্গে সম্পর্ক কখনো হওয়ার নয়। হওয়া অসমীচীন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করে না প্রবাল; তবু বাধা ছিল ধর্ম। ও মা-বাবার একমাত্র ছেলে। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে অনেক আগে, আমেরিকায় সেটেল্ড। মুক্তমনা বাবার প্রভাবে ছোটবেলা থেকে প্রবালের ধর্মে-কর্মে আস্থা ছিল না; এমনকি নিয়মরক্ষার জন্যও ঠাকুরদেবতার সামনে ও কখনো মাথা নোয়ায়নি। জাত-ধর্মনির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে ও মিশতে পারে অনায়াসে। ধর্মচর্চায় অনাগ্রহী হলেও ধর্মের প্রতি প্রবালের বিরাগ ছিল না; এমনকি ধর্মান্তরের কথা ও কখনো ভাবেনি। অসম্ভব। ওর বাবার মুখাগ্নি করবে কে? তবু সুপর্ণার অবহেলা, উদাসীনতা কিংবা রহস্যময়তা ওকে একটু একটু করে ঠেলে দেয় মৌমিতার দিকে।

একপর্যায়ে বন্ধু সুমনকে দিয়ে প্রবালের কাছে প্রস্তাব পাঠায় মৌমিতা। প্রথমে প্রবাল বেশ দ্বিধায় থাকলেও একটা সময় আর অগ্রাহ্য করতে পারে না। বন্ধুরা সবাই ওকে মৌমিতার পক্ষ নিয়ে বোঝায়, মৌমিতা সত্যিই ওকে ভালোবাসে। ভাবনায় পড়ে যায় ও। একটা মেয়ের ভালোবাসা তো আর ফেলনা নয়। তাছাড়া প্রবাল ভাবে, প্রেম করলে যে বিয়ে করতে হবে, এমন তো কথা নেই। যেহেতু ওর কোনো সংস্কার নেই, আবেগের ফুৎকারে ও উড়িয়ে দেয় রক্ষণশীলতা ও সামাজিক নৈতিকতার ফাঁকা বুলি। অবশেষে সময়ের হাতে সব ছেড়ে দিতে মনস্থির করে।

লেখাপড়া শেষে মৌমিতা যোগ দেয় বেসরকারি ব্যাংকে। আর প্রবাল শিক্ষক হিসেবে বিশ^বিদ্যালয়ে। এই দীর্ঘ সময়ে প্রবাল অনেকবার চেষ্টা করেছিল সম্পর্ক ছিন্ন করতে, কিন্তু পারেনি। পারেনি মৌমিতার জেদের কারণে; সে কোনোভাবে প্রবালকে হারাতে রাজি নয়। মৌমিতা অক্টোপাসের মতো প্রবালকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিল। এমনকি সুইসাইড করার হুমকি পর্যন্ত দেয়। প্রবাল জানত, মৌমিতার পক্ষে তা অসম্ভব নয়। বড়লোকের একমাত্র মেয়ে বলে সে চাইলেই সবকিছু পেতে অভ্যস্ত ছিল। এটা ছিল প্রবালের উদ্বেগের কারণ।

যেদিন মৌমিতার মা-বাবা বুয়েট থেকে পাস করা কানাডাপ্রবাসী ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করে, সেদিন বাসা ছেড়ে চলে আসে মৌমিতা। প্রবাল তখন শাঁখারিবাজারে ছোট একটি বাসা নিয়ে একা থাকত। কী করবে বা কী করা উচিত—প্রবাল ভেবে পায় না। অবশেষে বন্ধুদের খবর দেয় ও। ছুটে আসে কয়েকজন; সবাই মিলে ওকে আশ^স্ত করে।

সবার উদ্যোগে তখনই হয়ে যায় রেজিস্ট্রি-বিয়ে। প্রবালের বিশ^াস, বিয়ে নিছক এক কাগজের চুক্তি ছাড়া আর কিছু নয়; সম্পর্ক সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। দুটি মনের মিলন না হলে কেবল নিয়মরক্ষার জন্য এক ছাদের নিচে কি থাকা সম্ভব। শুধু বিয়ের আগে প্রবালের একটিই মৌখিক শর্ত ছিল—মৌমিতা যেন কখনো ওকে ধর্মান্তরের কথা না বলে। আর কোনো বিষয়ে ওর আপত্তি নেই। মৌমিতা খুব সহজে নিয়েছিল বিষয়টি। তারপর থেকে শুরু ওদের যৌথ জীবন।

প্রথম পর্যায়ে বন্ধুরা প্রবালকে প্রায়ই ভয় দেখাত; বলত মৌমিতা থেকে সরে যেতে, সম্পর্ক ছিন্ন করাতে। কেউ কেউ বলত, তোকে শেষ পর্যন্ত ধর্মান্তরিত হতে হবে।

না, প্রবাল তা হয়নি। হওয়ার কথা মনেও আসেনি। প্রয়োজনও বোধ করেনি কখনো। যদি সুপর্ণার সঙ্গেও ওর বিয়ে হতো, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটি ঠিক এরকম হতো—এমনই ধারণা প্রবালের। সংসার তো শেষ পর্যন্ত দুজন নারী-পুরুষেরই ব্যাপার, যেখানে অন্যান্য বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং অর্থহীন। তাই প্রবাল ধর্মীয় ভিন্নতার বিষয়টি টের পায়নি; ধর্ম ওদের সম্পর্কে বাধা হয়েও দাঁড়ায়নি কখনো।

মৌমিতার বাবা আশরাফুল আলম ও মা ফাতেমা বেগম একপর্যায়ে ওদের সম্পর্ক মেনে নেন। তারা শুধু বলেছিলেন, দেখো প্রবাল, আমাদের তো সমাজ আছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে তোমাকে বলছি না। তবে আমাদের একটা কথা রাখতে হবে। আমাদের আত্মীয়স্বজনকে বলতে হবে যে প্রবাল ঘোষ নাম বদল করে তুমি এখন প্রবাল ইসলাম। নাম নিয়ে প্রবালের আপত্তি ছিল না। অনেক সময় ও দুষ্টুমি করেও নতুন কাউকে বলত, আমার নাম প্রবাল ইসলাম। এ-কথা বলে মনে মনে হাসত।

প্রবাল শ^শুর-শাশুড়িকে হ্যাঁ বা না কিছু বলেনি তখন। শুধু বলেছিল, আপনারা কখনো মা-বাবা থেকে আমাকে আলাদা হওয়ার কথা বলবেন না। আর তাঁদের কাছে গোপন রাখবেন নামের ব্যাপারটা। এ কথা জানতে পারলে কষ্ট পাবেন তাঁরা; তাঁদের অনেক বুঝিয়ে সম্পর্কটি আমি স্বাভাবিক করেছি। একমাত্র ছেলে বলেই তাঁরা মেনে নিয়েছেন। তবে আমার আত্মীয়স্বজন এই সম্পর্ক কখনো মেনে নেবে না। এই বিয়ের কারণে আমাদের পরিবার এখন অনেকটাই সমাজবিচ্ছিন্ন। বলা চলে একঘরে।

প্রবালের মুক্তচিন্তার প্রভাবে মৌমিতার বিশ^াসও একসময় শিথিল হয়ে আসে। তারা দীক্ষা নেয় ইহজাগতিকতায়। কানাডা বা আমেরিকা চলে যাওয়ার কথাও তারা ভেবেছিল অনেকবার। পারেনি দুজনের পিছুটানের জন্য। সেই পিছুটান মা-বাবা। কোনো কিছুর অভাব ছিল না ওদের। আনন্দ-হাসি-গানে বেশ তো কেটে যাচ্ছিল দিন। ওদের মধ্যে যে মতদ্বৈততা ছিল না, তা নয়। কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য হলে তা মিটিয়ে নেয়ার জন্য মৌমিতাই অস্থির হয়ে উঠত।

সামান্য কারণে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে একবার প্রবাল রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের বছরখানেক পর। উঠেছিল এক বন্ধুর বাসায়। বন্ধ করে রেখেছিল মুঠোফোন। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মৌমিতা ওর অবস্থান শনাক্ত করে; দুই দিন পর ঠিকই ওকে ধরে নিয়ে আসে। মৌমিতা ক্ষমা চায়। আর কোনোদিন এমন কিছু করবে না বলে আশ^স্ত করে। প্রতিজ্ঞা করে বন্ধুদের কাছে। কেটে যায় মেঘ। প্রবাল সব সময় টের পেত, মৌমিতা ওকে অনেক ভালোবাসে, যেখানে নেই সামান্য খাদ।

তারপরও প্রবালের মনের কোথাও অবিশ^াস লুকিয়ে ছিল। তাই সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি ছিল প্রবালের মধ্যে। প্রবালের যুক্তিবাদী মন ওকে যুক্তি দেখাত যে, দেখো, কোনো কারণে আমরা আলাদা হয়ে গেলে একটি শিশুকে ভগ্ন শৈশব নিয়ে বেড়ে উঠতে হবে; সারা জীবন বহন করতে হবে একটা অপরাধবোধ। কাজেই আগে সিদ্ধান্ত নাও, আমাদের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত সত্যিই টিকে থাকবে কি না।

সম্পর্ক নিয়ে প্রবালের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কথা ও অনেকবার বলেছিল মৌমিতাকে। মৌমিতা হেসে উড়িয়ে দিত—তোমার সঙ্গে এ রকম কখনো হবে না। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ওরা। তারপর ওদের ঘর আলোকিত করে আসে এক রাজপুত্র। ভুলিয়ে দেয় সব দুঃখ-কষ্ট আর মতভেদ। ছেলেকে কেন্দ্র করে ওদের সংসার হয়ে ওঠে সুন্দর সাজানো বাগান। এভাবে তো ওদের দিনগুলো কেটে যেতে পারত।

অকস্মাৎ শুরু হলো কালবৈশাখী। এ কোন ভূত চাপল মৌমিতার মাথায়। প্রবাল তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। ও খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে প্রণয়ঘটিত কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। কারো সঙ্গে গোপন সম্পর্কে জড়ায়নি মৌমিতা, যার জন্য প্রবালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ভাবছে।

প্রবাল টের পেয়েছে, মৌমিতার ধ্যানজ্ঞান ক্যারিয়ার। অনেক ওপরে উঠতে হবে। ব্যাংকের চাকরিতে এমনিতে কাজের ভীষণ চাপ। তার ওপর রয়েছে ক্যারিয়ার নিয়ে মৌমিতার মাত্রাতিরিক্ত সিরিয়াসনেস। একদিন ঝগড়ার একপর্যায়ে মৌমিতা বলেছিল, ক্যারিয়ারিস্ট মেয়েদের কখনো বিয়ে করা উচিত নয়; আমার সিনিয়র আফরোজা ম্যাডাম বিয়ে করেননি বলেই এত দূর আসতে পেরেছেন। এ কথা শুনে প্রবাল মনে মনে হেসেছিল—কেমন বোকা হতে পারে আজকালকার ক্যারিয়ারিস্ট মেয়েরা।

ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার করেই মৌমিতা প্রাণপাত করছে প্রতিনিয়ত। ছেলের দিকেও তাকাচ্ছে না ভালো করে। এটা কেমন মাতৃত্ব? একজন মায়ের কাছে কি সন্তানের চেয়ে ক্যারিয়ার বড়? প্রবালের বুদ্ধিতে ঠিক কুলোয় না। প্রবাল বোঝানোর চেষ্টা করে মৌমিতাকে। কিন্তু পারেনি? ছেলের জন্মের পর মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে প্রবাল ওকে বুঝিয়েছিল, সন্তানের জন্য মায়ের সান্নিধ্য জরুরি। প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দাও। নয় কলেজের চাকরিতে জয়েন করো, যেখানে কাজের চাপ কম। মৌমিতার একরোখা ভাব দেখে প্রবাল শেষে বলে ফেলেছিল, তাহলে আমি চাকরি ছেড়ে দিই। সবার ওপরে সন্তান। তারপর থেকে এ নিয়েই চলছে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের শেষ কোথায় ঠেকবে, প্রবাল অনুমান করতে পারছে না।

ছুটির দিন হওয়ায় আজ দুজনেই বাসায়। কথায় কথায় মেঘ জমে আকাশে। পূর্বাভাস পেয়ে অমিতাভ অন্যদিনের মতো চলে যায় পাশের রুমে। ঝগড়ার একপর্যায়ে মৌমিতা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তোমার সঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়। আমি সেপারেশন চাই। ডিভোর্স লেটার রেডি করছি।

এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে যায় প্রবাল। শুধু হাত-ব্যাগটা নিয়ে। পথে পথে হাঁটে। কী করবে ভেবে পায় না। প্রবালের বেশি মনে পড়ছে ওর মায়ের কথা। গত বছর ও মাকে হারায়। মরার আগে মা বলেছিল, এই মেয়ে শেষ পর্যন্ত তোর সঙ্গে থাকবে না। তখন তুই ভালো দেখে স্বগোত্রীয় একটি মেয়েকে বিয়ে করিস। সুখী হবি।

কার সঙ্গে এই ব্যাপারটা শেয়ার করবে প্রবাল? না, কাউকে কিছু জানানো যাবে না। এ কথা জানাজানি হলে অনেকে হাততালি দেবে। উপহাস করবে। ও যে সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিল মৌমিতাকে। শুধু কষ্ট পাবেন বাবা। দিদি হয়তো সান্ত্বনা দিয়ে বলবে, ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।

প্রবালের পাসপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ বছরের ভিসা ছিল। তৎক্ষণাৎ টিকিট কেটে বিমানে চেপে বসে পরদিনই। নিউইয়র্কে দিদির বাসায় ওঠে প্রবাল। সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ফেসবুকেও আসে না। এভাবে কেটে যায় কিছুদিন।

মাসখানেক পর একদিন মেসেঞ্জারে ঢুকতেই মৌমিতার খুদেবার্তা দেখে চমকে ওঠে প্রবাল। মৌমিতা ডিভোর্স লেটার উইথড্র করতে চায়। আহ্বান করে ফিরে আসতে। বলে, ছেলের কথা কি তোমার একবারও মনে পড়ে না? ফিরে এসো তাড়াতাড়ি। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে প্রবাল। উত্তর দেয়—না, এই সম্পর্ক আর টেনে নেয়ার কোনো মানেই হয় না।