রাজা সরকার
প্রায় দিনই চোখে পড়ছে মানুষটি । যাতায়াতের পথে কখনো মুখোমুখিও হয়। কিন্তু কথা হয় না ।দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘরের জানালা খুললেও চোখে পড়ে। বয়স কত হবে! হতে পারে ষাটোর্ধ। ষাট থেকে সত্তরের মধ্যে একটা কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করা খুব মুস্কিল। হালকা চেহারা। কামানো মুখ। মানুষটি ঠিক পৌনে দশটা নাগাদ এসে দাঁড়ান এখানে। জায়গাটা একটা ডাক্তারখানার বাইরের চাতাল।ডাক্তারখানা দোতালায়।এই ডাক্তার খানায় বোধহয় রুগী কম।এই সময় জায়গাটায় ভিড় থাকে না তেমন। মানুষটি এসে একদম দেরি না করে বুক পকেট থেকে একটাই খুচরো সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুজে দেয় এবং পকেট থেকে একটা দেশলাই বের করে তাতে আগুন ধরায়। দেখে মনে হতে পারে তাঁর খুব তাড়া আছে। কিন্তু তা নয়। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কয়েকটা দীর্ঘ টান দিয়ে খুব আরামে ধোঁয়া ছাড়ে। ছেড়ে আস্তে আস্তে আশপাশে থাকায়। কিন্তু আর নড়ে না। তারপর বেশ সময়ান্তরে আয়েস করে সে বাকি টানগুলো দিতে থাকে। পারতপক্ষে সে কারোর দিকে চোখাচোখি তাকায় না। রাস্তায় ভিড় বেশি না হলেও লোকজন গাড়ি রিক্সা খুব কম থাকে না।তবে কেউ যে তাঁর দিকে খুব একটা তাকায় এমন নয়।এমনিতেই দিনের শুরুর দিকে একজন বয়স্ক মানুষের দিকে মানুষের তাকানো বা আগ্রহী হওয়ার খুব একটা কারণ নেই। কারণ ব্যস্ততা। বলা ভালো এই নব্য ব্যস্ততা।
অনেক ধূমপায়ীকে দেখেছি এইসব বয়সে এসে ধূমপান ছেড়ে দেয়। যেমন আমিও ছেড়ে দিয়েছি।এ-ছাড়া আজকাল এত ধূমপান বিরোধী প্রচার বিজ্ঞাপন চলছে যে অনেক জায়গাতেই ওটা করা যায় না। বেশ বিলক্ষণ বোঝা যায় যে এই মানুষটির যৌবন কালে,মানে ষাট-সত্তর-আশির দশকগুলোতে, ধূমপানের খুব রমরমা ছিল। নিষেধ-ত ছিলই না, বরং ওটা একটা ব্যক্তিত্বের অংশ বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু দিন গিয়াছে–সেই দিন আর নেই।মনে হচ্ছে মানুষটি কোনোভাবে প্রতিহত হয়েছেন।হয় তাঁর স্বাস্থ্যের কারণে নয়তো বাড়ির লোকজন বাচ্চাকাচ্চার জন্য পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে বেশি সতর্ক এবং যত্নশীল থাকার কারণে।
আমি ওনার ধূমপানের দৃশ্যটিকে ধীরে ধীরে শরীর-মনে গ্রহণ করতে থাকি। যেন ওখানে দাঁড়িয়ে আমিই ধূমপান করছি। ইদানীং ঐ দৃশ্যটি না-দেখা পর্যন্ত আমার অস্বস্থি হয়। আমি দৃশ্যটি সেই পর্যন্ত দেখি যখন তিনি সিগারেটের শেষাংশটি মাটিতে ফেলে স্যান্ডেলের দ্বারা পিষ্ট করতে থাকেন। অতঃপর মানুষটি কোথায় কোন দিকে চলে যান আমি আর দেখি না। ধরে নেয়া যেতে পারে মানুষটি এতদ্ঞ্চলেই থাকেন। কিন্তু আশ্চর্য মানুষটিকে আমি কখনো অঞ্চলের রাস্তাঘাটে দেখি না। অবসর প্রাপ্ত মানুষ হিসেবে কাজে অকাজে বাইরে যাতায়াত করলেও মানুষটির সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। আসলে ইদানীং কেন জানিনা মনে মনে আমি মানুষটিকে আমি খুঁজতে শুরু করেছি।
ব্যাপারটা যেহেতু কোন ভৌতিকতা নয়, বরং একান্তই বাস্তব এবং আমার স্ত্রীও একদিন জানালা দিয়ে আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে মানুষটিকে দেখে একটা হাল্কা মন্তব্য করেছেন।তবে ধরে নেয়া যেতে পারে মানুষটি এখানেই কোথাও আশে পাশে আছেন বা থাকেন । আর এসব সম্ভাবনার কারণেই মানুষটির সঙ্গে আমার একদিন দেখা হয়ে যায় অন্য এক জায়গায়।
আমাদের পাড়ার মোড়ে বিলিতি মদের এই দোকানটির কিছুদিন আগে পত্তন হয়েছে। নাম ‘লন্ডন স্টোরস’। কেন ‘লন্ডন’ কে জানে! সকাল দশটায় খোলে। বন্ধ হয় রাত দশটায়। যদিও নিয়ম রাত ন’টা পর্যন্ত খোলা রাখার।তবে ক্রেতাদের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবে হয়তো দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের পাড়ায় মদের দোকান আগে কল্পনা করা যেত না।এখন করা যায়।অনেক সাধারণ মানুষ আর দশটা টুকিটাকি জিনিস কেনার মতো বাজারে যাতায়াতের পথে মদ কিনে বাজারের ব্যাগে ঢুকিয়ে অম্লান মুখে বাড়ি ফেরে।মেয়েরাও কেনে আজকাল।তা দেখে প্রথম প্রথম কারো কারোর চোখ আটকে গেলেও এখন আর হয় না।বরং উৎসব অনুষ্ঠানের সময় দীর্ঘ লাইন পড়ে।
সেদিন একটু বেলার দিকে কী কাজে যেন আমার ঐ মোড়ের দিকে যাওয়া হয়েছিল। ‘লন্ডন স্টোরস’ মদ্যবিপনী ছাড়িয়ে যেতে গিয়ে দেখলাম একজন কাস্টমার মদ কিনছেন। সকালের দিকে ভিড় থাকে না।ফলে কাস্টমারকে চিনতে পারলাম সহজেই । চিনতে পারলাম কাস্টমার সেই নিঃসঙ্গ ধূমপায়ী,আমাদের তিনতলার জানালা খুললে যাকে দেখা যায়। আজও সময়মতই তাকে দেখা গেছে। তারপর এই দেখা ।তাকে এই অন্য জায়গায় দেখে আমি কিছুটা অভিভূত হয়ে পড়লাম। তারপর আমি যা করলাম সেটা আমার ক্ষেত্রে একপ্রকার সাহসিকতাই বলা যায়। কারণ বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যে কোনো মানুষের সঙ্গে যেচে গিয়ে কথা বলা আমার এ যাবত জীবনে ঘটেছে বলে মনে করতে পারলাম না।আমি গিয়ে মদ্যবিপনীর কাউন্টারে তাঁর গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। তিনি শুরুতেই আমার দিকে তাকালেন না।বস্তুটির ক্রয় সম্পূর্ণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার উদাসীন ভাবে আমার দিকে তাকালেন মাত্র। আমি সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম। যন্ত্রচালিতের মত জিজ্ঞেস করে বসলাম—কী খবর—কেমন আছেন? কথা না বলে চলে যেতে চাওয়া মানুষ এই অবস্থায় যা করেন উনিও তাই করতে চেয়েছিলেন। উত্তর দিয়েছিলেন—এই-তো ঠিকই আছে সব। অতঃপর চলে যেতে উদ্যত মানুষটিকে আমি আরও দু একটা কথা বলে থামিয়ে দিলাম। হাতে খবরের কাগজে মোড়া মদের পাঁইট ধরা অবস্থায় তিনিও দোকানের সামনে থেকে সরে এসে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। দৃশ্যটি খুব সাধারণ। কেউ তেমন লক্ষ্য করছে না।
দু’জন ষাটোর্ধ মানুষ এমন সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এটা তেমন লক্ষ্য করার বিষয়ও নয়। তা ছাড়া কতক্ষণ আর কথা বলবে। এই পাঁচ মিনিট,দশ মিনিট—খুব বেশি হলে পনের মিনিট ! কিন্তু তাঁদের কথা আর শেষ হচ্ছে না। তারা কথার ভেতর যেন আটকে আটকে যাচ্ছে। বেলা দশটার কিছু পরেই হয়তো তাঁদের কথা শুরু হয়েছে। এই সময়টা এখানে অফিস যাত্রী, ইস্কুল কলেজের ছাত্রদের যাতায়াত থাকে । তা ছাড়া নানা ধরনের দুই চাকা, তিন চাকা বা চার চাকার যানবাহনের ভিড় থাকে। থাকে কোলাহল । সঙ্গে থাকে নানা ধরণের কথা-শব্দ-প্যাঁচানো হরেক রকমের হর্ন, যা আবশ্যক বা অনাবশ্যক মনে হতে পারে। আসলে দিনের শুরুর দিকের এই অধিবাস কারোর চাওয়া বা না-চাওয়ার উপর নির্ভর না করেই জমে উঠে। দিন দিন সময় এ ভাবেই গড়ায় শুধু।
কিছু সময় পর যে কেউ লক্ষ্য করলে দেখতে পেত আমরা দুই ষাটোর্ধ মানুষ পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে। খেয়াল করলে বোঝা যেত যে উনারা হাতে হাত মিলিয়েছেন এক মুহূর্ত আগে। শোনা যেত যে একজন বলছেন–আমি সতীশ তলাপাত্র। অন্যজন বলছেন আমি গোবিন্দ সুর। একজন বলছেন আমি আপনার বাড়ির ঠিক কুড়িটি বাড়ির পর যে গলিটা উত্তর দিক চলে গেছে তার শেষের বাড়িটিতে আমার বাস । ঐ গলিটির এখন নাম হয়েছে সারদামনি রো। তবে অনেক আগের নামটা ছিল চুল্লু গলি। তারপর সেটা হলো গাঁজা গলি। আর এখন এটা বুঝতেই পারছেন যে সারদা রো হিসেবে পরিচিত।
এরপর থেকেই রাস্তায় ভিড় এবং কোলাহল আরো বাড়তে থাকায় আমাদের আর ‘লন্ডন স্টোর্স’এর পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলা সম্ভব হলো না। আমরা রাস্তা ধরে সেই দিকে এগোতে থাকলাম যে দিকে বেশ কিছুটা গেলে একটি লোকাল ট্রেনের ইস্টিশন পড়ে। শীতকাল। রোদের তেজ আরামপ্রদ। হাঁটতে আমাদের কোন অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না। অসুবিধে বোধ করলে খবরের কাগজে মোড়া মদের পাঁইটটি আমার হাতের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতে একবার সতীশ বাবুকে বললাম। উনি বললেন—‘এখন নয়, এখনও সময় হয় নি’। এই সময় আমাদের কথা হচ্ছিলো চুল্লু বিষয়ে। ‘চুল্লু গলি’ কথাটা থেকেই আলোচনার শুরু।বেশির ভাগ কথা সতীশ বাবুই বলছিলেন। বলছিলেন চুল্লু জিনিসটা আসলে খুব খারাপ কিছু নয়। আজকাল অতিরিক্ত নেশার জন্য নানা কেমিকেল মেশানো আর অযত্ন কিংবা সতর্কতার অভাবে মাঝে মাঝে বিষক্রিয়া ঘটে মানুষ মারা যায়। অথচ আপনি জানেন কিনা জানিনা এই বাংলা ভূ-খণ্ডে মদ একটা কুটির শিল্প হিসেবেই ছিল একসময় । এই ভূ-খণ্ডের অধিবাসীদের প্রাচীন কাল থেকেই মদের একটা সমাজ-গ্রাহ্য অভ্যেস ছিল। কিন্তু একটা সময় বাঙালিরা যখন বাঙালি হয়ে উঠতে লাগলো, বিশেষত মধ্যবিত্ত বাঙালির জন্ম হতে লাগলো, শাসক হিসেবে বহিরাগত মুসলমান ও পরবর্তীকালে এই ভূ-খণ্ডের মাথার উপর ব্রিটিশ রাজত্বের প্রতিষ্ঠানগুলো জন্ম নিতে শুরু করলো তখন থেকেই সমাজ জীবনে নানা ঘাত প্রতিঘাত বা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আমরা একদিকে যেমন এক নব্য রক্ষণশীলতা গ্রহণ করতে শুরু করলাম, তেমনি অন্যদিকে জ্ঞানভিক্ষু হিসেবে অনেক দরজা জানালাও খুলে ফেলতে শুরু করলাম। আর এসবই প্রধানত আমাদের মধ্যবিত্ত তথা পরশ্রমজীবী মধ্যসত্বভোগী শ্রেণীটার মধ্যেই ঘটতে লাগলো বেশি করে।তখন মদ আর আপামর সমাজের কাছে গ্রাহ্য হিসেবে বিবেচিত থাকলো না। টুকরো টুকরো অংশের মধ্যে গ্রাহ্য আর অগ্রাহ্যে ভাগ হয়ে গেল। ভদ্র বাঙালিরা মদের প্রতি বেশ রক্ষণশীল হয়ে পড়লো। অবশ্য যে কোনো অবস্থায় চিরস্থায়ী বলে কিছু হয় না। ফলে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকেই—তা আমরা উপলব্ধি করি আর না করি —এই রকম অনেকটা বলে সতীশবাবু থামলেন। আমার দিকে সম্ভবত এই প্রথমবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন—অনেক বলে ফেললাম না, কীসের থেকে কী কথায় এসে পড়লাম—আপনাকে বিরক্ত করলাম নাতো? আমি ততোক্ষণে ভাবছিলাম—এই লোকটাকেই কি আমি খুঁজছিলাম—একজন প্রতিহত মানুষ হিসেবে মনে হয়েছিল যাকে—এতো সুন্দর মানুষটার বাচনভঙ্গি—বেশ খোঁজ খবর রাখা মানুষ দেখছি। উত্তরে আমি বললাম—আরে না না, আমিতো মুগ্ধ হয়েই শুনছিলাম। এত সুন্দর বলেন আপনি—আপনি কি শিক্ষকতা করতেন?
—কস্মিনকালেও না। কেন বলুন তো—
—না, আপনার বলার ভঙ্গীতে বেশ পেশাদারিত্ব আছে—
— তাই!–, আসলে একসময় ভালই বলতাম টলতাম—যাকগে আপনার কথা একটু বলুন, শুনি—আপনি কী করেন টরেন—মানে আলাপ যখন হলোই তখন আপনার কিছুটা বিশদ পরিচয় আর কি—
—আমি একজন সাধারণ অবসর প্রাপ্ত মানুষ। এই পাড়ায় বছর দশ বার যাবত আছি। আগে একটা মফস্বল শহরে ছিলাম।
—পেশা কী ছিল—বা এখনও কিছু করেন টরেন কি—।
—বিশুদ্ধ কেরানীগিরিই করতাম একসময়—এখন পুরোপুরি অবসর—শেষ বিদায়ের অপেক্ষা আর কি।
—ভাল ভাল তা আপনি কি সপরিবারে থাকেন—মানে—
—সপরিবার বলতে স্বামী স্ত্রী—একমাত্র পুত্র সন্তান প্রবাসে থাকে।
—আপনার এই মানুষ দেখার হবি’টা আমার বেশ পছন্দের—তবে যদি বলেন যে ঠিক কী ধরণের মানুষ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে—মানে আপনি কি মহিলাদের দেখতে বেশি ভালবাসেন না পুরুষদের—
ইতোমধ্যে কিছুটা সময় আমাদের পার হয়েছে কথা বলতে বলতে। আর সেই সুবাদে আমরা একটা রেল স্টেশনে এসে পৌঁছে গেছি। লোকাল ট্রেনের স্টেশন। আমাদের কি স্টেশনে আসার ইচ্ছে ছিল? বোঝা যাচ্ছে না। তবু এলাম। কাজের লোক বা ছাত্র ছাত্রীরা মোটামুটি সবাই চলে গেছে। এখন স্টেশন চত্বরে ভিড় কিছুটা হাল্কা । রোদে পিঠ দিয়ে বসার মত একটা বেঞ্চিও পাওয়া গেল। আমরা আপাতত সেখানে বসে কথা বলছি। এই মুহূর্তে দেখে মনে হতে পারে আমরা কে কী কাজের উদ্দেশ্যে ঘরের বাইরে বেরিয়েছিলাম তা মনে নেই। আসলে তা নয়। আমাদের তা মনে আছে।আমার যেমন স্ত্রীর জন্য পান আর জর্দা কেনার কথা ছিল। সতীশ বাবুর মদের পাঁইট কিনে ঘরে ফেরার কথা।
এতক্ষণ কথা বলে এটা জানা গেল যে জানালা খুলে তাঁকে দেখার জন্য আমার যে দৈনন্দিনের একটি রুটিন আমি তৈরি করেছি সেটার সম্পর্কে তিনি অর্থাৎ সতীশবাবু বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল। এমনকি এমনও বলতে পারলেন যে আপনি এই কর্মটি তিন মাস সাত দিন যাবত করছেন। আর এই সপ্তম দিনেই আমার সঙ্গে আপনার কথাও হয়ে গেল। আমার কখনও ইচ্ছে ছিল না যে আপনার সঙ্গে নিজে থেকে আলাপ করবো। কারণ আমি যেচে কারোর সঙ্গে কথা বলতে খুব একটা সক্ষম নই। এটা আমার একটা অন্যতম খারাপ দিক। আপনি করলেন তাই এটা আজ হয়ে গেল। ভালই হলো। মানুষে মানুষে পরিচয় থাকা ভাল।
একসময় পালটা সতীশ বাবুকে ‘আপনার পরিচয়টা’ বলাতে তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুধু বললেন—‘হাত থেকে সেই কবে রুমাল ফেলে দিয়েছিলেন তিনি, তারপরও বেঁচে আছি আর কি’। কথাটির মর্ম না বুঝলেও তখনই সেটার ব্যাখ্যা সতীশবাবুকে জিজ্ঞেস করতে আমার আটকালো। যদিও তিনি এরপরও বলে চলেছেন।
এ দিকে স্টেশন চত্বরের কিছুটা নির্জনতার সুযোগ নিয়ে খবরের কাগজে মোড়া পাঁইটটির ছিপি আলগা করে কিছুটা গলায় ঢেলে নিলেন তিনি। কর্মটি বিনা বাক্যে সারার পর আবার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে শুধু বললেন ‘জিনিসটা দিশি—আজকাল এফ এল অফ্ শপেও পাওয়া যায়—তাই আপনাকে আর অফার করলাম না। তবু যদি ইচ্ছে করেন একটু নিতে পারেন’।
—না না ঠিক আছে, এখন না—আমি নিই না যে তা নয়, নিই—দিশিতেও আপত্তি নেই। আজ বরং কথা বলি। আপনি বলুন । আপনার যে পরিচয়টা বলছিলেন সেটা কিন্তু শেষ হলো না।
বেশ কিছুক্ষণ পর কথার ফাঁকে উনি আর একবার পাঁইট এর ছিপি খুললেন এবং গলায় ঢেলে নিলেন। তারপর বেশ কিছুটা মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকখানা ট্রেন আসা যাওয়া করলো। মানুষজন নামলো উঠলো। সামনে দিয়ে মানুষজনের যাতায়াত আছে। এরমধ্যে এক ফাঁকে সতীশবাবু আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে তাঁর পাঁইটটি সেটার ভেতর রেখে দিলেন। বোঝা যাচ্ছে ওনার সচেতনার মাত্রাটা। এরমধ্যে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে হাতে নিয়েও ধরালেন না। বলতে শুরু করলেন—মশাই আমার আবার পরিচয়, তাও আবার আপনার মত একজন ভদ্রমানুষ তা জানতে চাইছেন—এতে একটু অবাকই হচ্ছি। যাকগে চাইছেন যখন তখন বলতেত হয়ই। তা জিজ্ঞেস করি মশাই আপনি যে এই ভর দুপুরে বাড়ি না ফিরে আমার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন—বাড়িতে আপনার স্ত্রী অপেক্ষা করছেন না? অন্তত ফোন করে বলে দিন ফিরতে খানিক দেরি হবে। উত্তরে আমি আমি বললাম—স্ত্রী আমার বাড়িতে অপেক্ষা করছেন না—উনিও বেরিয়েছেন কাজে—এক আত্মীয় বাড়ি গেছেন—ফিরতে ফিরতে দেরি হবে। আর সঙ্গে চাবি আছে—অসুবিধে হবে না।
—বা! এত বেশ হয়েছে দেখছি।
—তা আমার মত আপনারওতো বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করছেন নাকি—?
—না না আমার জন্য অপেক্ষা করার বিষয় নেই। বাড়িতে আমরাও দুটি প্রাণীই থাকি। আমি আর আমার বোন। আমাদের দুজনেরই সঙ্গী বলতে যা বলা হয় স্ত্রী অথবা স্বামী গত হয়েছেন বেশ ক’বছর পূর্বে। আমি নিঃসন্তান ছিলাম। আমার বোনের দুই সন্তান। দুজনেই বিদেশে প্রবাসে স্থিত। রাত দশটার আগে আমার কাছে কোন ফোন আসবে না। আমি এরকম মাঝে মাঝে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়ি। ফলে আমি বেশ নিশ্চিন্ত এ বিষয়ে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম ওই যে সেই চুল্লু নিয়ে—কথাটা কিন্তু আসলে চোলাই— ব্যঙ্গ করে হউক আর অনুরাগ করেই হউক চোলাই থেকে চুল্লু হয়েছে। তবে মনে হয়, যে পাতন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ওটা তৈরি হয় সেই পাতনেরই একটা স্থানীয় নাম বোধ হয় চোলাই—আমি মশাই খুব কনফার্ম নই। মনে হলো তাই বললাম। মুষ্কিল কি জানেন জন্মের পর থেকে যে সব শব্দ ঘরে শুনে শুনে আমি বড় হয়েছি সেখানে বাইরের কিছু শব্দ মাঝে মাঝেই হানা দিত । আর তার মধ্যে কিছু শব্দ ছিল বাচ্চাদের কাছে নিষিদ্ধ। আর সেই সব নিষিদ্ধ শব্দের মধ্যে একটা শব্দ ছিল ‘চুল্লু’। নিষিদ্ধ হলে কী হবে আমাদের বাড়ির চারপাশে তখন রমরমিয়ে চলছে বেশ কয়েকটি চুল্লুর ল্যাবরেটরি। সারাদিনরাত তার থেকে এক উৎকট গন্ধ ভেসে বেড়াতো বাতাসে। সঙ্গে থাকতো সন্ধ্যে থেকেই চুল্লুখোরদের উৎপাত। তবে এসব বেশিদিন চলতে পারে নি । পূর্ব বাংলার উৎখাত হওয়া মানুষজন তখন অগম্য অস্থান কুস্থানে যেখানেই জায়গা পাচ্ছে বসার চেষ্টা করছে। ফলে এই সব বন বাদাড়ও বাদ যায়নি। শিয়ালদা স্টেশনে তখন উদ্বাস্তুদের আর পা রাখারও জায়গা নেই। তার উপর আছে অসুখবিশুক মড়ক আর নানা রঙের আড়কাঠিদের উৎপাত। ফলে বাধ্যত অনেকেই সেখান থেকে নিজ দায়িত্বেই সরে পড়ছিল। আমার দাদু ছিলেন সেই রকম এক পরিবারের কর্তা। এই অঞ্চলে আসা প্রথম পাঁচটি পরিবারের মধ্যে একটির কর্তা হিসেবে তিনি ছিলেন। যাই হউক তখন রাস্তাঘাটহীন জলাজঙ্গলময় এদিকটায় উদ্বাস্তুদের সবে পা রাখা শুরু হয়েছে। ক্রমে আরো খানিকটা ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চুল্লুর ল্যাবগুলোও স্থানবদল করে আরো অনেক দক্ষিণের দিকে চলে যেতে শুরু করলো। এবং একসময় সবক’টিই প্রায় চলে গেল। কিন্তু নামটা রেখে গেল ‘চুল্লুগলি’।
এখন আমরা যেখানে বসে আছি এই স্টেশনখানি তখন এখানে ছিল না। কিছু পরে হয়েছে। তখনও এখান থেকে পশ্চিম দিকে অর্থাৎ আমাদের বর্তমান বাসস্থানগুলোর দিকে তাকালে চোখে পড়তো শুধু হোগলার জঙ্গল, লম্বা লম্বা ঘাসের জলাজমি, মাঝে মাঝে কৃষি জমি, জলাশয় আর পাঁচ দশ ঘরের স্থানীয়দের বেশ কিছু আবাস গোটা অঞ্চল জুড়ে। মূলত মৎসজীবী ছিল সকলে। মূল কলকাতা শহরে মাছের কিছুটা সাপ্লাই এই অঞ্চল থেকেই যেত। পরের দিকে উদ্বাস্তু মানুষের ভিড়ে সেই সব জলাশয় ক্রমে লুপ্ত হতে থাকলো। মাছও আর খুব পাওয়া যেতো না। মৎসজীবীদের পেশাবদল আস্তানাবদলও ঘটতে থাকলো।
—তা হলে আপনারা উদ্বাস্তু হয়েই এসেছিলেন এ অঞ্চলে?
—হ্যাঁ, ঠিক উদ্বাস্তু হয়েই এসেছিলাম। এখনও তাই আছি।
—কী রকম?
—আসলে আমার ক্ষেত্রে উদ্বাস্তু বিষয়টা এখন একটা মানসিকতা মাত্র। আমার দাদু বা বাবা ছিলেন প্রত্যক্ষ উদ্বাস্তু। পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় এক কাপড়ে প্রাণ হাতে করে রাতারাতি ঘরবাড়ি সহায়সম্পদ সব কিছু ছেড়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে এই বাংলায় আরো অনেকের মতো এসে তাঁদের ঢুকে পড়া। ফলে প্রথম দিকে জীবন ধারণ করার সংগ্রামটা তাঁদের কাছে যা ছিল তা অনেকটা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। সেটা যতদূর শুনেছি বা বুঝেছি যে প্রতি মুহূর্তে বাঁচা আর মরার মাঝখানে একটা বিন্দুতে দাঁড়িয়ে প্রায় আট জনের পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার এক উপায়হীন প্রাণান্তকর দিন যাপন। হঠাৎ একদিন বা দুদিনের মধ্যে একটা মানুষকে তাঁর শ্রেণীচ্যুত,গৃহচ্যুত,দেশচ্যুত করে দিলে সেই মানুষটার শরীর-মন থেকে যে ক্ষয়জনিত একটা ক্ষরণ শুরু হয় তার কোন উপসম ঘটানোর জন্য বাইরে থেকে কিছুই প্রয়োগ করার ছিল না সেই সময়। শুধু নিজের ঠোঁট নিজে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলা ছাড়া।পূর্ব বাংলায় একজন শিক্ষক হিসেবে জীবন যাপন করা আমার দাদু মানুষটির এই বৃন্তচ্যুত রূপটি যা হয়তো আরো হাজারো লাখো মানুষের মতোই ছিল—আর তারা সকলেই আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা হৃদয়হীনতা বা সংকীর্ণতা যাই বলুন তার প্রত্যক্ষ শিকার, যার কোনো তূলনা ছিল না সেই সময়। আজও হয়তো নেই। সেই সময় এটা যেমন আমার দাদু বা বাবা দেখেছেন, এখন হয়তো সেটা অন্য কেউ অন্য কোথাও দেখে চলেছেন। মানুষের এই স্থানচ্যুতি তথা উৎখাতের ইতিহাস বড় দীর্ঘ এক অধ্যায়। আধুনিক পৃথিবী এই অধ্যায়ের শেষ ঘটাতে পারে নি এখনও, এটা বলাবাহুল্য । পৃথিবীর তাত্বিক সমৃদ্ধি কি এখনও সেই সক্ষমতা অর্জন করতে পারে নি? যাই হউক আমি ঠিক সেই সময়টাতে ছিলাম আমার মা এর গর্ভে। বোধহয় সবচে নিরাপদ এক স্থানে ! আমি সেটা ভাবি বটে, কিন্তু কত গর্ভবতী মা- ইতো ওই সময়ে সমূলে বিনাশ হয়ে গেছে ! তবে ওই না-জন্মানো অবস্থাতেই আমিও দেশান্তরিত হতে পেরেছিলাম। তারপর আমি আর বেশি সময় নিই নি অবশ্য। এই জলা জঙ্গলের ভেতর পর্ণকুটিরে আমার জন্মলাভ হয়। শুনেছি সেটা এ দেশে আসার মাসদুয়েকের মধ্যেই। ফলে উদ্বাস্তু প্রজন্মের প্রথম ব্যাচের নবজাতকদের মধ্যে আমিও একজনা ছিলাম বলতে পারেন।
পাশাপাশি দুজন বসাতে আমরা অনেক সময়ই সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে একজন আরেক জনের কথা শুনছি। ঘাড় ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে একে অন্যকে দেখছি। কিন্তু এবার অনেকক্ষণ কেউ কারোর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখিনি। তাই হঠাৎ কথা থামিয়ে সতীশ বাবু বলে উঠলেন—আমি বোধ হয় আপনাকে বোর করে ফেলেছি—কি গোবিন্দবাবু, ঠিক না?
—না না কী বলছেন —এই সব কথা—এই সব কথা কেই বা বলতে পারে—বিশেষ করে আপনার মত করে —আমার অন্তত জানা নেই মশায়। আপনি বলুন। প্রয়োজনে একটু বিশ্রাম নিন—চা খাবেন?
—হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলেছেন চলুন চা খাই। সঙ্গে দু চারটা করে বিস্কুট হলে মন্দ হবে না।
—নিশ্চয়ই।
বোঝা যাচ্ছে সতীশবাবুর খিদের উদ্রেক হয়েছে। আমারও কিছুটা হয়েছে বুঝতে পারছি। দুপুরের খাওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ । আমাদের সময়ের খেয়াল নেই। স্টেশন চত্বরে মানুষজনের ভিড়ও বাড়ছে এখন।
এরমধ্যে হঠাৎ একটি ঝাকড়া চুলের বালিকা এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি আমাদের লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলো—‘কী দাদু, তোমরা বাড়ি যাবে না? অনেকক্ষণ বসে আছো দেখছি—এবার একটু বেঞ্চিটা ছাড়। আমাদের কাস্টমারেরা বসতে পারছে না’। বালিকাটির কথায় আমরা ক্ষুন্ন হতে পারলাম না। কারণ সে হাসতে হাসতে এমন ভাবে কথাগুলো বলল যেন দাদুদের সঙ্গে এটা তার একটা রসিকতা। আমরা ফ্যাল ফ্যাল করে তার কথা শুনে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি প্ল্যাটফর্মের লোহার রেলিং এর বাইরে একটি চা এর দোকান। একজন মহিলা চা তৈরি করছে। রেলিং এর ফাঁক দিয়ে সেই চা সরবরাহ করা হচ্ছে। বোধহয় বিকেলের দিকে খুলেছে। কারণ আমরা বসার সময় আমাদের চোখে পড়েনি। এখন বেশ খানিকটা ভিড়ও হয়েছে। মানুষজন চা খাচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটি আমাদের নীরব দেখে আবার হাসতে হাসতে বলে বসলো—তোমরা রাগ করলেনা-তো?
আমি মেয়েটিকে কাছে ডাকলাম। ডেকে বললাম বললাম ‘রাগ করলে কী করবি দিদিভাই—আমাদের তুলে দিবি না আর একটু বসতে দিবি—? আমার কথা শুনে সে আর কোন উত্তর না দিয়ে হাসি মুখে গা মুচড়াতে লাগলো। চপ্পল পড়া পা প্ল্যাটফর্মে ঘষতে লাগলো। আমি আবার বললাম ‘কী হলো কিছু বলছিসনা যে—?’ তার বিব্রত অবস্থা দেখে আবার বললাম ‘আচ্ছা ঠিক আছে আগে আমাদের দুটো চা এনে দে সঙ্গে দুটো করে বিস্কুট আনিস’। এবার সে যেন একটু রাস্তা পেল। এক ঝটকায় দোকানের দিকে সরে গিয়ে তার মা’ই হবে হয়তো, মহিলাটিকে বললো—‘মা দুটো চা, চারটে বিস্কুট দাও তাড়াতাড়ি ওই দাদুদের জন্য’। অতঃপর চা বিস্কুট নিয়ে এসে সে আমাদের দিল। তার নাম জানা গেল ‘চুমকি’। চুমকির সঙ্গে আমাদের আর গল্প করা হলো না। আমরা চা খেয়ে উঠে পড়লাম। লাইনের এক পাশ ধরে ধরে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে লাগলাম। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে একটা লাইন গেছে। তবে কিছুদূর গিয়ে গিয়ে একটা ক্যানিং, একটা লক্ষীকান্তপুর, একটা ডায়মন্ডহারবার হয়ে নামখানা পর্যন্ত গেছে। তারপর আছে বিস্তৃত জল আর সুন্দরবন ও শেষে বঙ্গোপসাগর। আমরা সাগরের দিকে হাঁটছি, কিন্তু সাগর পর্যন্ত যেতে পারবো না। সেই মুরোদ আর নেই। তবু মনে করলে এখান থেকেই সাগর অনুভব করা যেতে পারে। দক্ষিণ দিক থেকে যে বাতাস আসে তাত সাগর থেকেই আসে।
সতীশবাবু সেই চুমকির আবির্ভাবের পর থেকেই কথা আর বলছেন না। এখনও চুপচাপ। আমরা আর বেশি দূর গেলাম না। বলা ভাল যেতে পারলাম না। রেল লাইনের পাশাপাশি একটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে ঘাসের উপর বসে পড়লাম। বেশ বিকেল বিকেল হয়ে এসেছে। শীতকালের বেলা। বিকেলও বেশিক্ষণ থাকবে না। এখানে বসে সতীশবাবু তাঁর পাঁইটটা খুলে আবার কিছুটা গলায় ঢেলে নিলেন। এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব আরাম করে ধূয়ো ছাড়লেন। ভাবছিলাম আগের কথার রেশ ধরে হয়তো কিছু বলবেন। কিন্তু না, হঠাৎ বলতে শুরু করলেন—-
—আচ্ছা গোবিন্দবাবু, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন মানুষের স্মৃতির সঞ্চয় খুব কম কেন? সবার হয়তো না। কিন্তু সাধারণভাবে দেখবেন মানুষ স্মৃতির সঞ্চয় নিয়ে একদম চিন্তিত নয়। বা এমনও হতে পারে স্মৃতি ধরে রাখার ব্যাপারটা নেই। আসলে মাথার ভেতর স্মৃতি ধরে রাখার প্রকোষ্টটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। একজন কবি বলেছিলেন বেশ্যাদের স্মৃতি থাকতে নেই। তাঁদের স্মৃতি সঞ্চিত থাকলে তাঁরা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়তে পারে। তাতে তাঁদের জীবন যাপন বা লাইন অফ একশান বিপর্যস্থ হয়ে পড়তে পারে। যাই হউক, এখন পর্যন্ত জানা যায় জীব জগতে মানুষই স্মৃতির কারবারি। স্মৃতি মানুষকে কী দিয়েছে মনে হয় আপনার? জীবনে সুখস্মৃতিই বা কতটুকু? অসংখ্য দুঃখের স্মৃতির ভেতর আলেয়ার মত সুখস্মৃতি টিম টিম করে । না, ব্যক্তিমানুষের সুখ দুঃখের স্মৃতির পরেও থেকে যায় সমষ্টিগতভাবে মানুষের অতিবাহিত সময়ের স্মৃতি । যা থেকে আমরা পেতে পারি ইতিহাস। ইতিহাসতো শুরুতেই গাড্ডায় পড়ে গিয়েছিল রাজরাজাদের কীর্তিকাহিনি, শৌর্যবীর্য বা যুদ্ধ-বিবরণীর মধ্য দিয়ে। আজকাল অবশ্য শুনি ইতিহাসের একটি ধারা নাকি এই কেন্দ্রিকতার কাহিনি থেকে প্রান্তিকতার দিকে সরে আসছে । সাধারণ মানুষের অতীত নাকি সেখানে বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। জানি না সে সব প্রকৃত অর্থে কতখানি কী করতে পারছে। আজকাল আর পড়াশুনোটা সে ভাবে করতে পারছি না——।
কথাগুলোর মধ্যে আমাকে উদ্দেশ্য করে দু একটা প্রশ্নবোধক কথাও রেখেছেন সতীশ বাবু। কিন্তু উনি আমার উত্তর বা মতামতের দিকে তাকাচ্ছেন না। নিজেই বলে দিচ্ছেন। আমি মাঝখানে আর কিছু বলতে যাচ্ছি না। শুধু শুনেই যাচ্ছি । যতটুকু শুনছি তাতে আশ্চর্যই হচ্ছি যে মানুষটার ভাবনা চিন্তার গতি প্রকৃতি কি অদ্ভুত আর কি বিস্তৃত !
কথায় আছে শীতের বিকেল আসে আর যায়। সত্যি চলে গেল। অন্ধকার হয়ে আসছে। আমাদের বসার জায়গাটা খুব নিরিবিলি। সেই হিসেবে এখানে আর বসে না থাকাই ভাল । আমার এইসব ভাবনার মধ্যেই সতীশবাবু আমার ব্যাগ থেকে তার পাঁইটটা নিয়ে একবারে বাকিটুকু গলায় ঢেলে দিলেন। বললেন খালি বোতলটা ব্যাগে রাখবেন, এখানে ফেলবেন না। এখন বোঝা যাচ্ছে তিনি কিছুটা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। সারাদিন তেমন কিছু না খেয়ে শুধু মাঝে মাঝে দেশি মদটাই খেয়ে যাচ্ছেন। আমি বললাম ‘ঠিক আছে এবার তাহলে ফিরে চলুন স্টেশনের দিকে—জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আসছে’—।
—না না আর স্টেশনের দিকে কেন, এখানেই-তো ঠিক আছি। ভয় নেই। এটা আমার চেনা জায়গা। অন্ধকার হউক না। কত আর অন্ধকার হবে। অন্ধকারে কি আমরা দেখতে পারবো না? নিশ্চয়ই পারবো। আমার ধারণা অন্ধকারে মানুষ কিছুটা বেশিই দেখে। সবচে বড় ব্যাপার অন্ধকারে মানুষ প্রকৃতই নিজেকে দেখতে পায়। চাইলে নিজেকে সে খুলে খুলেও দেখতে পারে। আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন যে রাতে বাতি নিভিয়ে শোয়ার পর নিজেকে নিজের কাছে খুব আপন, খুব চেনা মনে হতে থাকে। সারাদিন দিনের আলোতে বা রাতের প্রথমাংশে বিদ্যুতের আলোতে নিজের সঙ্গে নিজের যে চেনা অচেনার একটানা একটা দ্বন্দ্বদীর্ণ সময় কাটে তার থেকে তখন একধরণের মুক্তির বোধ হয় না? —–
এই সময়টা সতীশবাবুর কথা জড়িয়ে আসছিলো। একসময় তার কথার মধ্যে কথা বলতে বাধ্য হলাম। বললাম এবার চলুন বাড়ি যাওয়া যাক। চলুন আপনাকে পৌঁছে দিই। উনি আমার কথা শুনে কিছুটা অবাক হলেন। বললেন—বাড়ি মানে—?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। উনি আবার শুরু করলেন—বুঝলেন গোবিন্দবাবু, আপনার এই অবসর জীবনে মানুষ পর্যবেক্ষণের কাজটাতে আপনি যে আজ ডাহা ফেল করেছেন সেটা কি বুঝতে পারছেন? আপনার সারাটা দিন মশাই খেয়ে নিলাম। এখনও পর্যন্ত আপনাকে তেমন কিছু প্রশ্ন করার সুযোগই দিলাম না। আমিই শুধু নানা কথা বলে গেলাম। যেগুলো বলার জন্য আমি কোনোকালেও আপনার মত এত ভাল শ্রোতা পেতাম না । আপনি স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন বলে এটা সম্ভব হলো, বলতে গেলে আমাকে ধরতে এসে নিজেই কেমন ফেঁসে গেলেন ! যাক বেশি সময় আপনাকে আর আটকাবো না। তবে শুরুর দিকের একটা কথা একটু সংশোধন করে বলি যে, আমি আমার নিজের যে পরিচয় আপনার কাছে দিয়েছিলাম সেটা অর্ধসত্য। একটা অর্ধসত্য কথা আপনার মত মানুষকে বলা আমার ঠিক হয় নি। আসলে আপনার যেচে এসে আলাপ করাটা বা আপনার আন্তরিকতাটুকু আমার কাছে তখন এত মহার্ঘ মনে হয়েছিল যে, সত্যি কথাটা বললে যদি সেটা আহত হয়ে ঝরে পড়ে—এই আশংকা থেকেই অর্ধসত্যটি বলতে হয়েছিল। আপনি মাফ করবেন আমাকে। আসলে আমি একজন পরিত্যক্ত মানুষ। আমার স্ত্রী বিয়োগ হয়নি। বিচ্ছেদ হয়নি। আমি নিঃসন্তানও না। আমার স্ত্রী বা সন্তান কিছু নেই, কখনো ছিল না । আমার বোন আমার কাছে থাকে। সেও অবিবাহিতা। আত্মীয় স্বজনের সংখ্যাটা আমাদের খুব কম নয়। কিন্তু আমার সঙ্গে কারোর আর কোনো যোগাযোগ নেই। যে বাড়িটি কথা বলেছিলাম সেটি ঠিকই আছে। ওখানে আমার বোন থাকে। একাই থাকে। তবে আমি ওখানে সব সময় থাকি না। মাঝে মাঝে যাই, কিছুক্ষণ থাকি। প্রায় কুড়ি বছর আমি এভাবেই আছি। বলা যায় একসময় আমাকে আমার ঐ পৈতৃক বাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। আমার প্রজন্মের উদ্বাস্তু সন্তানেরা এখন প্রতিষ্ঠিত। তাদের সন্তানেরাও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু আমি এখনও উদ্বাস্তু। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে এইতো কিছুদিন আগে এই অঞ্চলে এসে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেছি। বাসস্থানটি এদিকেই। অই যে রেল লাইনের অই পাড়ে পাড়াটা দেখা যাচ্ছে ওখানেই। আপনি চাইলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি । অবশ্য যদি সময় থাকে। না, থাক। বরং আজ আমি বলব এখন আপনি বাড়ি যান। পরে যদি মনে করেন তবে এই স্টেশনে চলে আসবেন। ওই চুমকির মা’এর চায়ের দোকানের সামনে বসবেন ।আমি খুঁজে নেব। বা চুমকির মা’কে জিজ্ঞেস করবেন আমার কথা।
একা একা বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে আমার সেদিন অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিলো। এমন একটি বিরল প্রজাতির মানুষের সান্নিধ্যে দিনটা কাটানোর পর কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিলো। আসলে সারাদিনে মানুষটিতো তেমন কিছুই বলে নি। অনেক সাধারণ কথার আড়ালে কিছু অসাধারণত্ব উঁকি দিলেও কথার পরিমান আর এমন কি। তবে শেষের দিকে কথাগুলো আবার সব গুলিয়ে দিল সবটা। আবার দেখা হলে চুপ করে শুনে গেলে হবে না। প্রশ্ন করতে হবে। আজকে তো নিজেই স্বীকার করলো যে আমাকে কোনো প্রশ্নের সুযোগ দেয় নি। আসলে বিষয়ের গভীরতা হঠাৎ এতটাই বেড়ে যাচ্ছিলো যে সেখানে প্রশ্ন করার জন্য আমার মতো মানুষের কিছুটা প্রস্তুতি দরকার।
২
প্রায় দিন সাতেক কেটে গেল। আমি আর স্টেশনের দিকে যাই না। সতীশবাবুকে রাস্তা ঘাটে বা আমার ফ্ল্যাটের সামনে বা লন্ডন স্টোর্স—কোথাও আমি দেখতে পাই নি। অবসর জীবন নিয়ে আমার কোনো মানসিক সমস্যা ছিল না । কিন্তু সতীশবাবুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার মাথায় কিছু অদ্ভুত চিন্তার জন্ম হলো। সেটা আমার স্ত্রী সুরভিও টের পেয়েছে মনে হচ্ছে। একদিন সে জিজ্ঞেসও করে বসলো—কী হলো জানালা খুলে তুমি আর দেখছোনা-তো লোকটাকে—তোমার টার্গেট কি পাল্টে গেল? নাকি বাজারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দেখ—হ্যাঁ কী ব্যাপার—মানুষ দেখে তার ঠিকুজি কুষ্টি বানিয়ে বানিয়ে তোমার গল্প তৈরি করা কি থেমে গেল—।
উত্তরে আমার মিটি মিটি হাসি ছাড়া আর কিছু না পেয়ে একসময় রেগে গিয়ে সুরভি বলতে শুরু করলো—কী ব্যাপার ওই হাড় জ্বালানো হাসিটা ছাড়া কি তোমার আর কিছু নেই?
হাল্কা এরকম একটা ঝাড় খেয়ে আমি সুরভিকে দিন সাতেক আগে লোকটির সঙ্গে একটা দিন কাটানোর অভিজ্ঞতাটা খুলে বললাম। তাতে সুরভি বিস্ময়াহত যেমন হলো, তেমন রাগও করলো। বললো, তোমার এমন ভীমরতি কবে থেকে শুরু হলো। নিজের স্ত্রীকে সাতদিনের বাসি খবর দিচ্ছ। ঘটনা কী? মনে-তো হয় আরো কিছু আছে যা বলছো না। তুমিও ওই লোকটার সঙ্গে স্টেশনে বসে বসে দিশি মদ খেয়েছো নাকি—-।
আত্মপক্ষ সমর্থনের তেমন সুযোগ না দিয়ে সুরভি বলে গেল—আমার ফিরতে দেরি হবে জেনে বেশ একটা ফুর্তির ভাব এসে গিয়েছিল নাকি। এখন-তো মনে হচ্ছে ঘরে ঢুকে যে নাকে কেমন একটা গন্ধ পেয়েছিলাম সেটা তা হলে সিওর ওই দিশি মদেরই হবে—।
সেদিন সুরভিকে থামানো যায় নি। সারাটাদিন একটা বিশ্বাস ভঙ্গের দায় নিয়ে আমার কাটাতে গেল। ফলে আমার কথাও যে কারণে আরো কিছুটা কমে গেল।
কিন্তু অষ্টম দিনে সকালে বাজার থেকে ঘরে ফিরে আমার জন্য যে একটি অষ্টমাশ্চর্য অপেক্ষা করছিল তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ঘরে ঢুকে দেখি সোফায় বসে আছেন সতীশবাবু। চা খেতে খেতে সু্রভির সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত। আমাকে দেখে তিনি মৃদু হেসে বললেন—আরে আপনিতো আর বলেন নি আসতে—তাই নিজেই চলে এলাম। এসেতো দেখি আপনার স্ত্রী আমার বেশ চেনা মানুষ। আমি অনেকটা নির্বাক অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে চা’এর টেবিলে বসে শুধু বললাম ‘ওয়েলকাম ওয়েলকাম’ ।
সেদিন সতীশবাবু চলে যাওয়ার পর থেকে সুরভির মেজাজ বেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলো। ক্ষণে ক্ষণে সতীশবাবুর গল্পগুলো করে গেল প্রায় সারাটা দিন ধরেই। আমিও নানা মাত্রায় বিস্ময়ে অবাক হতে হতে শুনে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম যাক মেঘ কেটে গেছে। কিন্তু রাতে শোয়ার আগে শেষ বাক্য যেটি বললো তাতে আমি আর প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না। বাক্যটি ছিল—তুমি আর সতীশবাবুর সঙ্গে বেশি মেলা মেশা করো না। এ কিন্তু অন্যরকম লোক।
আমাদের এই অঞ্চলটি একসময়ের খুব বিখ্যাত ছিল রিফিউজি কলোনীর কারণে। আসলে কলকাতার সন্নিহিত অঞ্চলে এই রকম একটি অনাহুত জনগোষ্টির জন্য নগর কলকাতা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। রিফিউজিদের বিষয়ে কলকাতার তখন একটাই মাত্র মূল্যায়নের ভাষা রূপ ছিল, তা হলো—এরা সব বাঙাল। কিন্তু ১৯৪৭ পরবর্তী বছর দুই তিনেকের মধ্যে যাঁরা উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে আশ্রয় নিচ্ছিলেন তারা মূলত বর্ধিষ্ণু শ্রেণির ছিলেন। ঘটনাক্রমে কেউ কেউ সহায়সম্বলহীন হলেও তাঁদের মেধাসত্ত্বটুকু ছিল। সাময়িক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাদের আত্মবিশ্বাসে কখনো টান পড়েনি। ফলে তাদের সেই সময়কার সংগ্রামী কাজকর্মে এর একটা ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তাঁরা এখানে এসেও শিক্ষাদীক্ষার কাজকে যেমন অগ্রাধিকার দিয়েছেন তেমনি বসবাসের জন্য ন্যুনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার চেষ্টাও করেছেন। ফলে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার তাদেরকে খুব বেশি অবহেলা করতে পারে নি। একসময় সরকারী সুযোগ সুবিধাদি পাওয়া বা তা বুঝে নেয়া গেছে এই সচেতন সক্রিয়তার কারণে। বর্তমানে এই নব্য নগরায়নের মধ্যে সেই সব জনগোষ্টির মানুষ যারা এখনও আছে তাদের দেখলে বোঝা যায় তারা কলকাতার নাগরিকতাকে খুব বেশি আমল দেয় নি। কেউ কেউ যেমন বলেন কলকাতার সংস্কৃতি মনষ্কতার সূচিত অবক্ষয় সেদিন ঠেকাতে পেরেছিল তৎকালীন ওই উদ্বাস্তু জনশক্তির ভাষাসত্তা আর সজীবতার দৌলতে।
সুরভি এখানকারই মেয়ে। জন্ম-কর্ম-শিক্ষা-বিবাহ-সংসার সব তাঁর এখানেই। ঘটনাচক্রে আমি এই গোবিন্দ বলতে গেলে এখানে বহিরাগত। ফলে সুরভি সতীশবাবুকে চিনতে পারবে এটা স্বাভাবিক। তবে চেহারার পরিবর্তন হেতু অনেক সময় চিনতে ভুলও হতে পারে। সেই কারণেই এক আধ দিন আমাদের জানালা থেকে দেখা ধূমপানরত মানুষটিকে বোধহয় সতীশবাবু হিসেবে সনাক্ত করতে পারে নি।
জনবিন্যাসের এই ঠাস বুনন আজ থেকে তিরিশ চল্লিশ বছর আগেও ছিল না এখানে। ছিল না বর্তমান প্রচলের মুক্ত বাজারের নাগরিকতা। বরং ছিল পাড়ায় পাড়ায় চেনা জানা আনা গোনা। মূল্যবোধে বজায় ছিল একটা শহরতলী-ভাব। জন্ম থেকেই সুরভিকে এই পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের একজন সাক্ষী বলা যেতে পারে। এখন সুরভির কথা অনুযায়ী জানা যায় সতীশবাবুর ছোট বোন লিপি ছিল তাঁর ক্লাসমেট। ছোট থেকে বড় পর্যন্ত তারা এক সাথেই পড়াশোনা করেছে। তাঁদের পরস্পরের বাড়িঘরেও যাতায়াত ছিল। ফলে পরস্পরের সংসারের কথা জানার কোন অসুবিধা ছিল না তাঁদের। সতীশবাবু ওরফে সতু, সংসারে বা পাড়াপড়শিদের কাছে যে নামে উনি পরিচিত। সুরভির কাছে সতুদা। বিগত ষাটের দশকের বাংলার প্রেম সংস্কৃতির এটা একটা মোক্ষম সম্পর্ক বিন্যাস ছিল যে ছোট বোনের বন্ধু ও বান্ধবীর দাদা। সুরভি তাই ছিল। কিন্তু গত দুই দিন ধরে তাঁর কথাবার্তায় আমি গোবিন্দ সেরকম সম্পর্কের চিহ্ন কোথাও খুঁজে পেলাম না। হতেই পারে যে তেমন সম্পর্ক ছিল না। এসব নিয়ে এই বয়সে জিজ্ঞেস করার মত রসিকতা স্ত্রীর সঙ্গে করাই যায়। সাহস করে একবার তা করেই দেখলাম। ফল ভাল হলো না বা উলটো ফল হলো—এসব বলার আর পরিসর থাকলো না। উলটে আমি এক অচেনা বিবরে নিক্ষিপ্ত হলাম। সুরভি এমন রসিকতা নিয়ে মোটেও চটে যায় নি। বরং কিছুটা দম নিয়ে ঘটনাটা শুনিয়ে দিল।
—এটা শুধু তোমাদের পুরুষ মানুষের ধারণা নয় এটা নারী পুরুষ উভয়ের অনেকেই ভাবতে পারতো। কিন্তু না,প্রকৃতই তেমন কিছু ঘটে নি। বরং ঘটনা কিছু অন্যরকম ছিল বলে একটা ধারনা তৈরি হচ্ছিলো। লিপির বান্ধবীদের মধ্যে আমি ছাড়া আরও দু একজন ব্যাপারটা জানতো। সতুদা আমাদের একই কলেজের ছাত্র তখন। ঝকঝকে ছাত্র নেতা। সেই বছরটাই ছিল তার পাস আউট ইয়ার, যে বছর আমরা কলেজে ঢুকলাম। তুখোর কথাবার্তা বলা বামপন্থী এই ছাত্র নেতার অনেক ছাত্রী ফ্যানও ছিল। কিন্তু তাঁর কোনো প্রেমিকা ছিল বলে শোনা যায়নি। বরং সেই একটা বছর আমরা তিনজন,অর্থাৎ আমি লিপি আর সতুদা একসঙ্গে হেঁটেই কলেজে গেছি অনেকদিন। অনেকদিন ফিরেও এসেছি একসঙ্গে। কিন্তু পাস আউটের পর সতুদা সত্যি হারিয়ে যেতে থাকলো। আগে বাড়িতে গেলে মুখোমুখি হলে কথা বলতো। এটা সেটা জিজ্ঞেস করতো। কিন্তু সতুদার ফাইনাল পরীক্ষার পর ওদের বাড়ি গেলে দেখতাম নিজের পড়ার ঘরে নিবিষ্ট মনে বই পড়ে যাচ্ছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে হু হা ছাড়া উত্তরও দিত না। রেজাল্ট বের হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিরও তেমন চেষ্টা করলো না। আশ্চর্যের ব্যাপার রাজনীতি করবে বলে চেনা জানা সকলেই একপ্রকার নিশ্চিত থাকলেও সতুদা রাজনীতির পথও মাড়ালো না। অথচ আমাদের এই অঞ্চলটাকে বামপন্থীদের ঘাঁটি বলা হতো । ছাত্র রাজনীতির পর এখান থেকেই অনেক জননেতা তৈরি হয়েছে তখন।
এরমধ্যে লিপি একদিন কলেজ ফেরত আমাদের বাড়িতে এসে আমার পড়ার ঘরে বসে সতুদাকে নিয়ে খুব কান্নাকাটি করলো। বললো, ছোড়দাটাকে নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি । কী যে করি!
উদ্বাস্তুদের দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকেই যৌথ পরিবারে ভাঙনের শুরু। সতু, লিপির বড় দাদারা তখন যে যার মত কেউ বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। কেউ কেউ হবে হবে করছে। উপরে দুই দিদি ছিল যাদের বিয়ে তাদের বাবা জীবিত অবস্থাতেই দিয়ে গেছেন। এখন এই সংসারে বোঝা বলতে সতু, লিপি আর তাদের বৃদ্ধা মা। উদ্বাস্তুদের দ্বিতীয় প্রজন্মেও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য এক কর্মমুখর জীবন যাপনই দৃশ্যমান ছিল। তারমধ্যে কর্মবিমুখ সতু এক মারাত্মক ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়ালো। আর তাকে নিয়েই বাড়িতে অশান্তি। আর পড়াশোনাও করলো না সে। সারাদিন বাড়িতে বসে শুধু বই পড়া,লেখালেখি করা,—এসব-তো তখন এই সব পরিবারে বিলাসীতা মনে করা হতো। তাদের অগ্রজরা এসব মেনে নিতে পারলো না। দুর্গাপুর স্টীলে একটা চাকরী সতুর এক অফিসার মেসোমশাই ঠিকঠাক করা সত্ত্বেও সতু সেখানে গেল না। কেন গেল না, সেটা কেউ সতুর কাছ থেকে বের করতে পারছে না। শেষ পর্যায়ে একদিন লিপি রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সতুর ঘরে ঢুকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসলো –কীরে ছোড়দা তুই এমন পাগলামী করছিস কেন? চাকরীটা নিচ্ছিস না কেন? মানুষ চাকরী পায় না, আর তুই পাওয়া চাকরী নিয়ে এগুলো কী করছিস—দেখছিস না বাড়ি শুদ্ধু সবাই কেমন রাগারাগি করছে। —অনেক সাধাসাধির পর সতু বলে বসলো,— তোদের ছেড়ে আমি দুর্গাপুর যেতে পারবো না। স্তম্ভিত লিপি কথাটা শুনে রেগে গিয়ে বললো–কী বলছিস এসব। মানে কি এসবের—তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে—এসব কথা বাড়ির কারোর কানে গেলে কী হবে বলতো? আর ছেড়ে যাওয়া কীসের—আমি আর মা’তো এখানেই থাকবো– – তুই সপ্তাহে সপ্তাহে আসবি— ছাড়তে হবে কে বলছে—।
কথা বলতে বলতে লিপি খেয়াল করেনি সতুর চোখ থেকে জলের ফোঁটা পড়ছে সামনে খুলে রাখা বইয়ের উপর। কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিলো গলার কাছে একটা কিছু যেন আটকে আছে লিপির । এখন এই জলের ফোঁটা দেখে সে আর থাকতে না পেরে কাছে গিয়ে সতুর মাথায় হাত রাখতেই সতু সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল।
সুরভির কাছে লিপির ওই দিনের বর্ণনাটুকুই এই বিষয়ে শেষ কথা ছিল। সঙ্গে অবশ্য নিজের একটা আক্ষেপ জুড়ে দিয়েছিল। বলেছিল—ছোড়দাটাকে বুঝতেই পারলাম না আজ অবধি।
এরপর লিপির কাছে বন্ধুত্বের খাতিরে এবিষয়ে আর সুরভি কোনো কথা জিজ্ঞেস করতে পারে নি। সুরভি তারপর আর ওদের বাড়ি তেমন গেছে কিনা মনে নেই। লিপির সঙ্গে কলেজে বা কলেজ ছাড়ার পরও যোগাযোগ ছিল। লিপি গ্রাজুয়েশনের পর মাস্টার্সও করেছিলো। সুরভি আর পড়তে পারে নি। বিয়ের আগে পর্যন্ত বাচ্চাদের একটা স্কুলে কিছুদিন চাকরি করেছে। ওই সময় থেকেই তাদের যোগাযোগ ক্ষীণ হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু পাড়ার সমবয়সী দু’একজন বান্ধবীর কাছে এই জিনিসটারই আরেকপ্রস্থ বয়ানে শুনতে পেল। যেমন সতু নাকি লিপির জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে। বা লিপি নষ্ট করে দিয়েছে সতুর জীবন । মানুষের এমন ধাঁচের কথা পল্লবিত হতে সময় লাগে নি। কথাগুলো তাই দিন দিন শক্তি সঞ্চয় করে গেল যতদিন সতু আর লিপির বিয়ের বয়স ছিল বা অঞ্চলটিতে শহরতলী ভাবটা বজায় ছিল। কিন্তু ওদের বিয়ের বয়স -পার হওয়া বা অঞ্চলটির নগরায়ন সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত কথাগুলো আর রইলো না। হারিয়ে গেল। এখন কে আর কার খোঁজ রাখে।
বর্ণনার এই পর্যায়ে এসে আমি এক অচেনা বিবর থেকে অনেকগুলো প্রশ্ন আর সংশয় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সুরভির বর্ণনার ভেতর থেকে একটি লুপ্ত আখর যেন মুখ দেখালো।
একই পাড়ায় থাকার সুবাদে সতীশবাবুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ আটকানো যায় না। মাঝে মাঝে হয়েই যায়। দেখাসাক্ষাৎটা আড্ডায় রূপান্তরিত হয় না সবসময়। কিন্তু একদিন দেখা হতেই সতীশবাবু চেপে ধরলেন, বললেন—কী হলো গোবিন্দবাবু আরতো কথাবার্তা হলো না তেমন—একদিন চলুন না আবার স্টেশনের দিকে যাই, আড্ডা দিই– নাকি। ভদ্রলোক এমন ভাবে বললেন যে উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না। সুরভিকে বলেই গেলাম একদিন। সুরভিকে বলার মধ্যে এটাও বললাম যে তোমার সঙ্গে লিপির মিসিং-লিংকটা জানা কি দরকার নয়। সুরভি চোখ বড় বড় করে পালটা প্রশ্ন করে বসলো—তোমার ঐ মিসিংলিংক এর কী দরকার শুনি?
সেদিন সতীশবাবু আগে থেকেই স্টেশনে এসে বসে ছিলেন। খালি হাতই দেখলাম। খবরের কাগজে মোড়া কোন বস্তু নেই। সময়টা একটু আগে বলে তখনও চুমকির মা’এর চা দোকানটাও খোলা। আমরা চা খেতে খেতে গল্প করছিলাম। আজ আর চুমকিকে দেখা গেল না। জানা গেল চুমকি সকালে আসে না। ইস্কুলে যায়। শুনে ভাল লাগলো। চুমকির মা এক সুযোগে জানিয়ে দিল যে অনেকবার নাকি সতীশবাবু আমার খোঁজ করেছেন তার দোকানে এসে। মনে মনে আমার বেশ অপরাধ বোধ হলো। আসবো কথা দিয়ে না-আসার জন্য। আমি সতীশবাবুর কাছে ভদ্রতাবশত না-আসার জন্য মাফ চেয়ে নিলাম। সতীশবাবু উত্তরে হাসি মুখে বললেন—মাফ করতে পারলাম না। কারণ অন্যায়টা কার সেটা বুঝতে পারিনি এখনও। হা হা।
এইসব কথাবার্তায় পরিবেশটাকে একটু হালকা করে নিয়ে সতীশবাবু একসময় বললেন আজ আপনি বলবেন আমি শুনবো। সুরভি আমার বোন লিপির বন্ধু এটা নিশ্চয়ই জেনেছেন। তার মানে আপনার স্ত্রী আমাদের খুব চেনাজানা একজন। আমাদের ছাত্রজীবনের কথাও শুনে থাকবেন হয়তো। বলুন—।
খুব আলাপী-মানুষ না হওয়ার কারণে আমি কোথা থেকে আজ শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। সতীশবাবুর এই কথাতে একটা সূত্র পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম—রাজনীতিটা করলেন না কেন, এতো তুখোর একজন ছাত্র নেতা—পার্টির লোকেরা কি আপনাকে টানে নি?
—টেনেছে, অনেকবার চেষ্টা করেছে পার্টিতে ঢোকানোর জন্য। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্যও অনেক চাপ দিয়েছে। পড়াশোনার জন্য আর্থিক সহায়তাও কিছু দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি যাই নি। কারণ দলীয় রাজনীতির সীমাবদ্ধতা বা ভূমিকা আমার পছন্দ ছিল না। আপনি এমন একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্নটা করলেন যে তার উত্তর দিতে গিয়ে সেই আমাকেই অনেকটা বলতে হবে—।
—অসুবিধা কি, বলুন না। আমার বলার সময় কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? আপনি বলুন।
—জানেনতো আমরা ভারতবর্ষীয়রা গুরুবাদে আস্থাশীল। ভারতীয় রাজনীতিতে যারা নিজেদের প্রগতিবাদী বলে দাবী করতো তারাও এর বাইরে ছিল না। এখানেও একটু ভিন্ন পোশাকে গুরুবাদ কায়েম ছিল। বলতে পারেন গুরুবাদ খারাপ কি। বামপন্থী, প্রগতিবাদী রাজনীতি, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা, তার মানুষজন—ইত্যাদি সম্পর্কেত একটা শিক্ষামূলক ব্যবস্থা থাকা ভালই। গুরু হিসেবে শিক্ষক থাকলেই বা ক্ষতি কি? ক্ষতি নেই ঠিক। কিন্তু শিক্ষক বা গুরু আর গুরুবাদ দুটো আলাদা বিষয়। শিক্ষক বা গুরুর শিক্ষা নিয়ে চলতে গিয়ে আমি অধিত বিদ্যাকে আরো গভীর বিশ্লেষনে নিয়ে যেতে পারি বা প্রয়োজনে তাকে বর্জনও করতে পারি। এই স্বাধীনতাটা আমার থাকে। কিন্তু যদি আমি গুরুবাদী হই তবে আমি বাঁধা রইলাম গুরুপ্রদত্ত শিক্ষাসূত্রের কাছে, যাকে অপরিবর্তনীয় বলে আমাকে আগেই স্বীকার করে নিতে হয়েছে। মানে চিন্তার স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট বয়ান বা ব্যাখ্যাকে শেষ সত্যের আকারে বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে।
বিষয়টা অনেক ব্যাপক বিস্তৃত—আপনাকে কিছুটা আইডিয়া দেয়ার জন্য বললাম আরকি। মানে আমার বক্তব্য বোঝানোর স্বার্থে। আমার কথা ভুলও হতে পারে। আপনি প্রশ্নও তুলতে পারেন। সব দিকটা খোলা রেখেই বলছি যে ওই সময়টা ছিল, মানে ষাট দশকের প্রথমার্ধটা, আমাদের দেশের কম্যুনিষ্ট পার্টির ভাঙনের সময়। আর আমাদের এই উদ্বাস্তু অঞ্চলগুলোতে তখন এদেরই দাপট। কংগ্রেস বা জনসঙ্গও ছিল । বা ছিল অন্যান্য কিছু বামপন্থী সংগঠনও । কিন্তু এই উদ্বাস্তু জনসমষ্টি সৃষ্টির মূল কারণ যদি দেশভাগ হয়ে থাকে তবে, এই দেশভাগে বিশেষভাবে কম্যুনিষ্ট পার্টির ব্যাখ্যা বা ভূমিকাটা আসলে কী ছিল, সে প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট কেউ দিতে পারতো না। এ বিষয়ে পার্টির দলিলাদি পাওয়াও খুব সহজ ছিল না। কিন্তু আশু কর্তব্য হিসেবে তখন সংগঠন বাড়ানোর দিকেই সবার নজর ছিল। কারণ উপরি পাওনা হিসেবে এই রকম লক্ষ্য লক্ষ্য উদ্বাস্তু মানুষ তখন হাতের কাছে, যাদের ভিতর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই এতটাই ভরবেগ সম্পন্ন ছিল যে, তাদের নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন সংঘটিত করা আপেক্ষিক ভাবে সহজ ছিল। ফলে সংগঠন বাড়ানোর একটা জোয়ার চলছিল। ফলে পার্টির ভাঙনের ধাক্কা এখানেও পরিমাণ মতোই লেগেছিল। আমি দাদা এই জোয়ারে যেমন গা ভাসাতে রাজি ছিলাম না, তেমনি ভাঙনের ধাক্কার দায় নিতেও রাজি হতে পারিনি। আমি জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই উদ্বাস্তু মানুষ দেখি। আমাদের পরিবারের আমরা ছোট দু ভাইবোন ছাড়া বাকি সকলেই প্রত্যক্ষ উদ্বাস্তু। আমি একদিকে যেমন এর রাজনৈতিক ইতিহাসটা দেখতে চাইছিলাম তেমনি দেখতে চাইছিলাম এই বৃহৎ সংখ্যায় চলে আসা বাঙালি হিন্দুদের সামাজিক ইতিহাসের দিকটাও। আর সত্যি বলতে কি আমার ওই যুবা বয়সে এই সকল জিনিশের প্রতি আমার আকর্ষণ, আগ্রহ, আমাকে কিছুটা দলছুট করে ফেলে। ফলে আমি অনেকের স্নেহ মমতা সহানুভূতি হারিয়েছি। এটা আমার কাছে খুব ভারী মনে হয়েছিল। পরিবারের মধ্যেও কিছুটা শিকড়-শূণ্যতার বোধ কাজ করতে শুরু করেছিল আমার।
—আপনার কলেজে ছাত্র সংগঠন তাহলে কম্যুনিষ্টপার্টির ছত্রছায়াতেই চলত।
—অবশ্যই। বললাম না এই অঞ্চলের কলেজে যেটা হয়, বাইরে যাদের দাপট কলেজের ভেতরেও তাদেরই দাপট থাকবে। আর বড় কথা হলো বাইরের যে মানুষগুলো আমাদের দেখভাল করতো মানুষ হিসেবে তারা অসম্ভব দরদী সব ভাল মানুষ ছিলেন। ফলে আমাদের উৎসাহ উদ্যমের অভাব ছিল না। এর পেছনে অবশ্যই একটা স্পষ্ট না হওয়া আদর্শবাদ কাজ করতো। মুষ্কিলটা হলো পার্টিটা ভাগ হওয়ার সময়। সেই সময় অন্তর্দ্বন্দ্ব এমন ভ্রাতৃঘাতি হয়ে উঠলো যে আদর্শ বিষয়টা ঝরে গেল প্রথমেই। আর তার জায়গাটা দখল করে নিল ক্ষমতা। এই ‘ক্ষমতা’ শব্দটির তাৎপর্য বুঝতে পরবর্তী জীবনে আমার অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। এদিকে বাম ডান সব রাজনীতিতেই ক্ষমতা দখলের কথা বলা আছে। আর সেটা শ্রমিক কৃষক তথা মেহনতি মানুষের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল । এটা একটা মহাকাব্যিক প্রহেলিকা। তার ভেতর কী সত্য লুকোনো থাকে হয়তো কেউ কেউ জানে বলে মনে করে। তবে সবাই জানে না। সেই সময়ের ঘাত প্রতিঘাতের ভেতর ক্ষমতা দখল নিয়ন্ত্রণ আধিপত্য—এই শব্দগুলো আমাকে আর টেনে রাখতে পারে নি। ফলে এই সব কিছু থেকে বেরিয়ে আসতে হলো একদিন।
আসলে এই যে কথাগুলো বললাম বা বলতে চেষ্টা করলাম, এগুলো একটা বৃহৎ বয়ানের কণা মাত্র কথা। সত্যি বলতে কি এগুলো আর বলতেও ভাল লাগে না। প্রাসঙ্গিকতায় এসব এড়াতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু অনেক সময় নিরুপায়।
—আপনি কি চাকরি করতেন?
—হ্যাঁ শেষ পর্যন্ত একটা চাকরি আমি পেয়েছিলাম।রাজ্য সরকারী চাকরি। খুব দরকারও ছিল সেই চাকরির। মন দিয়ে সেটা করলামও শেষ পর্যন্ত। এখন নেহাৎ একজন পেনশন ভোগী।
—এখন কী করেন—মানে সময় কাটে কী করে?
—এখন, ঠিক এখন—মানে কিছুকাল যাবত দেখছি যে তথ্যাদির সহজলভ্যতা একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কিছুই আবার নতুন করে সন্ধানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশ সমাজ রাজনীতি ব্যক্তিমানুষ—এককথায় আমার ছোট্ট ব্যক্তি পরিসর থেকে আমি কিছুটা ভাবনা নিয়ে আছি আর কি। আগে যেমন একজন রাজনৈতিক নেতা যখন ভাষণ দিতেন তখন সেই বক্তব্যকে যাচাই করার উপায় খুব বেশি ছিল না। ফলে একটা জ্ঞানতাত্বিক আধিপত্যের অধীনে থাকার একটা ব্যাপার ছিল । এখন সেটা, মানে অধীনতাটার ব্যাপারে আমার কাছে অনেক বিকল্প তৈরি হয়েছে বলে মনে করি।ফলে আমি আমার মতো যাচাই করে নিতে পারি।—এসব নিয়েই আছি আর কি।
আচ্ছা গোবিন্দবাবু একটা কথা আমার প্রথম দিন থেকেই—মানে আমাদের সাক্ষাতের শুরু থেকেই মনে হচ্ছিলো যে, আমার বিষয়ে আপনার আগ্রহের কারণটা কীভাবে তৈরি হলো—বা আপনার প্রশ্নের উত্তরে যা বলছি বা কখনো বিনা প্রশ্নেই যা বলেছি তাতে আপনার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে কি? আর উদ্দেশ্যপূরণ হলেও সেই উদ্দেশ্যটা কী রকম—জানতে ইচ্ছে করে। মনে কিছু করবেন না। একটা সময়, মানে ছাত্রজীবনে আমাদের একটা বিষয়ে সতর্ক থাকতে হতো যে, নিজের রাজনৈতিক ভাবনা চিন্তা যেখানে সেখানে প্রকাশ না করার ব্যাপারে। কারণ ছিল পুলিশ বা পুলিশের চর। এখন আমি জীবনের শেষ প্রান্তে। কোনো রাজনীতি বা সাংগঠনিক তৎপরতায়ও নেই। ফলে সেই আশংকাও করি না। আর আপনাকেও ছদ্মবেশী পুলিশ ভাবছি না। হা হা হা—। মনে কিছু করলেন না তো?
—স্বাভাবিক আপনার প্রশ্ন বা জিজ্ঞাস্যগুলো। অবশ্যই মনে কিছু করছি না। বরং আপনাকে প্রথম প্রথম দেখে মনেই হয় নি আপনার ভেতর এত কথা এখনও আছে বা এখনও আপনি অনেক কথারই জন্ম দিয়ে চলেছেন। আপনার মস্তিষ্কের সক্রিয়তার প্রশংসা না করে পারছি না মশাই। আপনার জিজ্ঞাস্যগুলোর উত্তর দেব, তবে আজ আর নয়, অন্যদিন। আজ এখন বাড়ি ফিরব।
—হ্যাঁ হ্যাঁ প্রায় দুটো বাজে। চলুন যাওয়া যাক। আমিও আজ আমাদের ওই বাড়িতে যাব, মানে আপনাদের পাড়ায়।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম লিপির মিসিং-লিংকটা উদ্ধার হলো না-তো। কথাতো সেই দিকে যায়ইনি । সুরভি জানতে চাইলে কী বলবো?
মানসিকতার দিক দিয়ে সুরভি আমার চেয়ে অনেক শক্ত ধাতের। ঘোর বাস্তববাদী। সংসারে থাকতে থাকতে এই সত্যগুলো ক্রমান্বয়ে আমাকে জানতে হয়েছে। সবসময়ই একটা লাস্ট ডিফেন্স হিসেবে তাঁর উপরে ভরসা করেছি। আজও করি। লিপির বিষয়ে কথাটা প্রথম শুনে মানসিক ভাবে আমি কিছুটা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেদিন আড্ডা দিয়ে ফিরে এসে মিসিং-লিংকের উল্লেখ করা মাত্র সুরভি কেমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে গেল যে আমি না বললে তুমি মিসিং-লিংক কোথায় পাবে! তুমি ভেবেছো সতুদা তোমাকে বলবে বা তুমি সতুদাকে জিজ্ঞেস করে এসব জানবে! সত্যি তোমার ম্যাচুরিটি এখনও হলো না। তোমাকে-তো প্রথমেই বলেছি সতুদা অন্যরকম মানুষ। যাকগে,তুমি কিন্তু এসব আবার জিজ্ঞেস করতে যেও না যেন। আমি বাধ্য ছেলের মতো বলে উঠলাম—না না, জিজ্ঞেস করবো না।
ইতোমধ্যে অনেক কটা দিন পার হয়ে গেছে। আমি সারাদিনের রুটিন অনুযায়ী ওষুদ পথ্য বাজার ঘাট এবং সংসারে সেকেন্ড ম্যান হিসেবে দিনাতিপাত করে চলেছি। সতীশ তলাপাত্রের বলা কথাগুলো নিয়ে মাঝে মাঝে মনে মনে নাড়াচাড়া করি। বয়স বা যে কোন কারণেই হউক আমার আগ্রহে একটু ভাঁটা পড়তে শুরু করেছে। আসলে বরাবরই আমি কিছুটা এই টাইপেরই। খাদ একটু গভীর হলেই আমি মুখ ফিরাই। সারাজীবন প্রমোশন না নিয়ে ব্যাংকের কেরানিগিরি করাটাও আমার সেই বৈশিষ্ট্যের কারণেই হয়তো বা। আসলে আমাকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই। যে কোন রক্ষণশীল সমাজে আমি একজন আদর্শ মানুষ। সুরভি আমার এই প্রকৃতি তথা আমাকে যতখানি জানে আমি সুরভিকে তার অর্ধেকও মনে হয় জানি না। এই বয়সেও সুরভি আমার কাছে কখনও কখনও রহস্যময় ঠেকে। আমি বলি না সে সব। কিন্তু আমার ধারণা সুরভি আমার ব্যাপারে সবসময় খুব নিশ্চিত থাকে।
আসলে সুরভির মত মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কিন্তু সেটা হয়ে গেল। আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় পরিবারে সুরভির মত কাঠ বাঙাল মেয়ের বিয়ে হয় না। নেহাত চাকরির টানে কলকাতা এসে না পড়লে আমার বীরভূমীয় রাঢ় বাঙলার ঐতিহ্য এভাবে টাল খেয়ে যেত না। সম্ভবত আমাদের বংশে আমিই প্রথম প্রেম করি এবং সেটা এক বাঙাল ললনার সঙ্গেই। আর সেটা যে আমার পরিবার পরিজনরা একেবারেই মেনে নেবে না কখনো, সেটাও আমার ধারণার বাইরে ছিল। এখন বুঝি সেটা ছিল আমার নির্বুদ্ধিতা। ফলে ধীরে ধীরে আমি বিচ্ছিন্ন হতে হতে একেবারে বাইরেই থেকে গেলাম। শেষপর্যন্ত মা যতদিন বেঁচে ছিলেন সিউড়ির বাড়িতে বছরে দু তিন বার গেছি বটে। কিন্তু মায়ের চিরবিদায়ের পর আর ওমুখো হই নি। আমার এই মেটামরফসিসটা ঘটেছিল কলকাতা আর সুরভি—এই দুপক্ষীয় প্রভাবে। আর একদিকে বলা ভাল আমার আচ্ছন্ন চোখদুটো ফুটেছিল কলকাতা আর সুরভির সাহচর্যে। নারী বলতে আমি একরকম বুঝতাম। প্রথম জীবনে আমার চোখে দেখা নারীর সঙ্গে সুরভির কোনো মিল ছিল না। তবু আমি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সেটা কতটা যৌবনের টানে বা কতটা ভালবাসার টানে সেটার বিচার আমি কোনোকালেও করে উঠতে পারিনি। সুরভির সংস্কারমুক্ত উদারতা, স্নেহ, ভালবাসা, এগুলো সবই আমার কাছে অনাস্বাদের এক আশ্চর্য স্বাদ বয়ে এনেছিল। তবে স্বীকার করা ভাল যে এইসব মানবিক গুনের মূল্য আমি তখন অনুভব করতে পারিনি। আর এমন না যে আমি খুব সংস্কারমুক্ত হয়ে উঠেছিলাম, তাও না। কারণ বিয়ের পর আমি ওর বাচ্চাদের স্কুলের চাকরিটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাই নি। তার কারণ কি আমাদের পরিবারের রীতিতে মেয়েদের চাকরি-তো অনেক দূরের কথা, সঙ্গতি থাকলে ছেলেদের চাকরিও সেখানে ভাল চোখে দেখা হতো না বলে? চাকরি বলতে অন্যের চাকর হয়ে থাকাটা অভাগাদের কাজ। আমাদের রাঢ়ীয় বনেদিয়ানার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া মেয়েদের বাড়ির পুরুষ ছাড়া কদাচ বাইরে যাওয়া ঘোর অনাচারের সমতুল ছিল। এই সূত্রে বিবাহোত্তর জীবনে প্রথম মন্ত্র এটাই ছিল যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংসারে সন্তান আনয়ন করো। সন্তান ছাড়া স্বামী স্ত্রী বেশিদিন বসবাস করতে থাকলে তাদের মন উড়ু উড়ু হয়ে পড়ে। সন্তানই একমাত্র শিকড় যে কিনা সংসার ধরে রাখে। আসল কথাটা একটু অন্যরকম যে, সন্তান কোলে থাকলে স্ত্রীর মন স্বামীমুখী, সংসারমুখী থাকে। স্ত্রীলোকের মন কখনো বিশ্বস্ত হয় না। তাকে উপযুক্ত বাঁধনে বেঁধে রাখতে হয়।
মাঝে মাঝে এটা ভাবি যে সুরভি আমাকে মেনে নিয়েছিল কী দেখে।একদিন মনে আছে তাঁকে আমি এটা জিজ্ঞেসও করে বসেছিলাম। উত্তরে সুরভি শুধু বলেছিল, পুনর্জন্মের এক অবাক বিস্ময় আছে তোমার চোখেমুখে। আমি সেই কথার মর্ম তখন বুঝতে পারিনি। আমি-ত বিশ্বাস করি সুরভি আমার মনোভাব জানে সব। কিন্ত বিয়ের প্রথম বছরেই সন্তান বা তার পরের বছর দেড়েকের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে সুরভির কি কোনো বক্তব্য ছিল না? একদিন শুধু বলেছিল— খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না? আসলে পরপর দুই সন্তান নিয়ে তাঁর কাজের চাপ যে কতখানি বেড়ে গিয়েছিল সেটা আমিই জানি। আর আমি শুধু জানিই। তাঁকে সাহায্য বলতে গেলে কিছুই করিনি বা করতে পারিনি। এখানেও আমার পূর্ব সংস্কার কাজ করেছিল কিনা কে জানে যে, পুরুষ মানুষের ঘরে আবার কাজ কীসের—ঘরেতো তার সেবা পাওয়ারই কথা! আসলে সাংসারিক কোনো কাজে তখন লাগতে না পেরে আমার যে অসহায়তা চোখে মুখে ফুটে বেরোত তা সুরভির চোখ এড়ায় নি। ফলে আমাকে সে নিরস্ত রাখতেই চেষ্টা করতো সবসময়। দরিদ্র উদ্বাস্তু পরিবারের বড় হওয়া একটি মেয়ের কঠিন হওয়া প্রথম শর্ত ছিল । আমার সঙ্গে যখন সুরভির পরিচয় হয় তখন কলকাতার সন্নিহিত অঞ্চলের উদ্বাস্তুরা সবে প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠেছে। নিজেদের উদ্যোগে স্কুল কলেজ প্রতিষ্টা করে তাতে তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষাদীক্ষার কাজ পূর্ণমাত্রায় চালু করে দিতে পেরেছে। সুরভি আসলে সেই দ্বিতীয় প্রজন্মের একজন যে, তাদের পূর্বতনদের যাবতীয় বেদনার সুরটুকু ধরে রাখতে পেরেছিল এবং আমাকে তার অংশীদার করে তুলতে পেরেছিল।
বিগত সত্তরের দশকে প্রেম করা বলতে যা সাধারণত বোঝাতো তার কিছুই আমাদের মধ্যে ছিল না। একজন ব্যাংক কর্মী ও মাঝে মাঝে আসা একজন ব্যাংক গ্রাহকের মধ্যে যতটুকু দেখা সাক্ষাৎ বা কথা সম্ভব ছিল তাই হতো সাধারণত। শুরুতে আলাপটা হয়েছিল একটা ব্যাংক একাউন্ট খোলা নিয়ে। তখনকার সময়ে একটি মেয়ের গলার স্বর, বাকভঙ্গী, জড়তাশূন্য এক দৃঢ়তা দেখে আমি কিছুটা পৃথক মনোযোগ দিয়েই তার কাজটা করে দিয়েছিলাম প্রথম দিন,মনে আছে। এবং সেটা কীভাবে যে, আমাদের মধ্যে একটা আলাপের সূত্র হয়ে গেল বুঝতে পারিনি। চেহারা ছবি পোশাক পরিচ্ছদে বাহুল্য বর্জিত একটি মেয়ে কীভাবে যে মাসের নির্দিষ্ট দিনে টাকা জমা করা বা তোলার জন্য ব্যাংকে আসবে বলে আমি অপেক্ষা করতে শুরু করেছিলাম সেটা বুঝতে পারিনি। সেই নির্দিষ্ট দিনে ব্যাংকে এলে দেখা হয়, দু’একটা কথাও হয়, এটুকুই। বাইরে দেখা হয় অনেক পরে।
ব্যাংক ছুটির পর একদিন আমার নির্দিষ্ট মেসবাড়ির কাছাকাছি রাস্তায় বাস থেকে নামার পর তার সঙ্গে দেখা। সুরভি ঠিক আমার নেমে আসা বাসটিতেই উঠবে বলে হাত তুলে প্রায় দৌড়োচ্ছিলো। ধাবমান মেয়েটি কাছাকাছি হতেই মুখোমুখি আমাকে দেখে দৌড় থামিয়ে প্রায় চিত্রবৎ হয়ে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো শুধু—আপনি? এদিকে থেমে থাকা বাসটা আর দাঁড়ায় নি। কী সব বলতে বলতে চলে গেল। মূল আলাপটার শুরুও সেখান থেকেই। সেদিন আমি তাকে তাদের বাড়ির কাছে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলাম। পরে অবশ্য মাঝে মাঝে আমি সুরভিকে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য আবদার করলেও সুরভি সেটা হতে দেয় নি। বলেছিল পাড়াতে এখন সবাই নকসাল হয়েছে। পাড়ার সব ব্যাপারই এখন দেখে তারা। বেপাড়ার কেউ পাড়ার মেয়েকে বাড়ি পৌঁছানোর ছলে পুলিশের হয়ে টিকটিকিগিরি করবে এটা তারা মানবে না। তুমি বিপ্লবের দুশমন বা শ্রেণীশত্রু হয়ে যেতে পারো। এই কথা শোনার পর আমার মুখ দেখে সুরভি মুখ টিপে হেসেছিল। আমার কবজিতে হাত রেখে আমার পালস বিট দেখছিল। সুরভি বলেছিল, ভয়ের কিছু নেই, আমি উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ে—।
কিন্তু আমি মোটেও সাহসী না। ফলে আর আবদার করিনি কখনো। সুরভির কথায় ভরসা রেখেছি শুধু।
৩
যাই হোক, সপ্তাহ তিনেক পর একদিন সত্যি সত্যি লিপির সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে এক বিকেলবেলা দরজা খুলে দেখি এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। চোখে বেশ পাওয়ারের চশমা। কিছুটা গম্ভীর মুখে মধ্য বয়সের ছাপ। জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা এটা কি গোবিন্দবাবুর ফ্ল্যাট?
—হ্যাঁ বলুন, আমিই গোবিন্দ বাবু।
—নমস্কার, আচ্ছা সুরভি আছে কি?
—আছে।
—একটু ডাকা যাবে তাকে?
—হ্যাঁ ডাকা যাবে। আপনার পরিচয়?
—আমি লিপি তলাপাত্র। লিপি বললেই হবে।
আমি কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে বসলাম—আপনি কি সতীশবাবুর বোন লিপি?
—হ্যাঁ সতীশবাবুর বোন। বলে একটু হাসলেন।
—আরে আসুন আসুন, বাইরে কেন, ঘরে আসুন।
সাধারণত এই রকম কলিংবেলের পর কথোপথন তৎক্ষণাৎ শেষ হওয়ার কথা । কিন্তু আজ কিছুটা সময় নেয়া হচ্ছে দেখে পায়ে পায়ে সুরভি উঠে এল দরজার কাছে। আমার আড়াল থেকে মুখ বের করে লিপিকে দেখে প্রায় আঁতকে ওঠা গলায়—আরে তুই??
এরপর একচোট কান্নাকাটি জড়াজড়ি করে দুই বন্ধু যতক্ষণ না স্থির হয়ে সোফায় বসল ততক্ষণ আমি ঠায় দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
অতঃপর একসময় আমিও তাদের গল্পে কিছুটা যোগ দিলাম। লিপির সঙ্গে কিছু সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলে আমি বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। মনে মনে ভাবলাম ওরা একটু একা একা কথা বলুক।
সেদিন লিপি চলে যাওয়ার পর আমি বাড়িতে ঢুকে দেখলাম সুরভি বই পড়ছে না। টিভিও দেখছে না। ব্যালকনিতে চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে আছে। আমি ফ্রেস হয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম—কী গো, ব্যাপার কী, চুপচাপ বসে আছো—বাল্যবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে মন খারাপ হলো নাকি?
—না, এমনি বসে আছি।
—লিপি হঠাৎ আমাদের বাড়িতে—কী বললো?
—একটু চুপ করে বসতো—কথা বলতে ভাল লাগছে না এখন।
সেদিন সত্যি সত্যি লিপি বা লিপির ওই হঠাৎ করে আসার বিষয়ে কোনো কথা আর হয় নি। কিন্তু দু দিন পর সুরভি লিপির কথা বলেছিল। কথা বলতে গিয়ে অদ্ভুত ভাবে সুরভির গলা ধরে আসছিলো। কথার মধ্যে লিপির মিসিংলিংক সে ধীরে ধীরে বর্ণনাও করেছিল। সেটা একটা শিকড়ছেঁড়া মধ্যবিত্ত সংসারের গল্প। যে গল্পটার পরতে পরতে ছড়ানো ছিল সতুর হেনস্থা বা লিপির উপর অবিচার ।—লিপি তাঁর জীবনটা ছোড়দার জন্য বিসর্জন দিল–বাইরে থেকে এটা মনে হলেও সবটা আসলে তা নয়। এখানে বিসর্জন এর অর্থ বদলে গেছে। এখানে বিসর্জনের স্থলে বরং ভালবাসা শব্দটা দিলে যেন ঠিক হয়। লিপির জীবনে উৎপন্ন ভালবাসার বোধটা সতুদাকে কখনো অতিক্রম করে যেতে পারে নি। সে চেষ্টা লিপিও করে নি।
এই উদ্বাস্তু পরিবারটিতে কয়েকটি মৃত্যুর পর পরই দৃশ্যের বদল হতে শুরু করে। একসময় মায়ের মৃত্যু পর ওদের দুই ভাই বোনের মাথার উপরে আর কেউ রইলো না। সতু দুর্গাপুরে চাকরি করতে যায় নি। সেই নিয়ে বাড়ি শুদ্ধু নানা রকম বিরুদ্ধতা ছিল। যদিও সে-সব পাত্তা না দিয়ে সতু নিজের মতোই চলছিলো। এর মধ্যেই মায়ের হঠাৎ মৃত্যু। প্রাথমিক শোক ও শ্রাদ্ধাদির কাজ মিটে যাওয়ার পর বাড়িতে থাকা দুই বিবাহিত দাদা জানিয়ে দিল যে লিপির বিয়ে পর্যন্ত তার খাওয়া পরার দায়িত্ব তারা নিতে পারে, কিন্তু সতুকে তার নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। সংসারে থাকতে হলে তাকে অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে । তাকে এজন্য তিন মাস সময় দেয়া হলো। কারণ তাদের নিজেদের সন্তানাদি নিয়ে তারা খুব আর্থিক চাপে আছে। এই ঘোষণা শুনে সতু একেবারেই অবাক হয় নি। সে মনে মনে প্রস্তুতই ছিল। ইতোমধ্যে সে গোটা দুই চাকরির পরীক্ষা দিয়ে রেখেছে। আরো দেবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। লিপি তার মাস্টার্স পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট টিউশন করতে শুরু করেছিল। এবার সতুও শুরু করে দিল টিউশন ।
এই শ্রেণীর উদ্বাস্তু পরিবারগুলো দেশত্যাগের আগে আর্থসামাজিকতার নিরিখে সামন্ত ব্যবস্থারই প্রতিভু ছিল বলে ধরা যায়। শুধু মাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে দেশভাগোত্তর সময়কালে তারা অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়েছিল ঠিকই। এছাড়া সেখানে তাদের মূলত কৃষি-জমি নির্ভর আর্থিক নিরাপত্তা ছিল বলে ধরা যায়। ফলে সংসার নামক ছোট ছোট সংগঠনগুলোর মাথার উপর ছাতার মত একজনের অধিষ্ঠান হেতু সংসারের নিয়ন্ত্রণ সাবলীল রাখতে অসুবিধা হতো না। জমিদারী প্রথা বিলোপের আন্দোলনে তখনকার রাজনীতির সঙ্গে কখন যে ক্ষমতামুখী ধর্ম জেহাদীদের মেলবন্ধন ঘটে গেছে সেটা অনেক সাধারণ গৃহস্থ টের পায় নি। কেউ কেউ হয়তো পেয়েছিল। তবে সবাই নয়। কিন্তু বিপর্যয় যখন ঘাড়ের উপর এসে পড়লো তখন তারা সকলে টের পেল একযোগেই। র্যাডক্লিফ সাহেবের দাগানো সীমান্ত পার হওয়ার সময় অনেক কিছুই তারা ফেলে এসেছিল। কিন্তু পারেনি পারিবারিক সামন্ততন্ত্রের কাঠামোয় নিহিত মূল্যবোধগুলি। সতুর দাদু মারা যাওয়ার পর সেটা একটু ভেঙ্গেছিল। তখনও মেয়েরা রক্ষণীয়া হিসেবে বিবেচিত ছিল। এক-হাঁড়ি প্রথাটির জন্য ছিল শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু সতুর বাবা মারা যাওয়ার পর সেটাও ভেঙ্গে গেল। এক-হাঁড়ি বর্জিত হলো। মেয়েরা আর রক্ষণীয়া থাকলো না বা থাকা সম্ভব হলো না। সতুর মা মারা যাওয়ার পর তলাপাত্র মশাইয়ের ঘামে শ্রমে গড়ে ওঠা একসময়ের ভদ্রাসনটি অদৃশ্য রেখায় রেখায় বিভক্ত হয়ে পড়লো। ফলে সতুর সঙ্গে লিপিও কার্যত কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ল। কারণ সেদিন সতুর প্রতি দাদাদের আচরনের প্রেক্ষিতে লিপি সংসারের অন্য নারী সদস্যদের থেকে পৃথক হয়ে দাঁড়ালো। সে দাদাদের ঐ ঘোষণা মানতে পারলো না। ক্রমে নীরবে সে সতুর পক্ষে এক অনিশ্চয়তার জীবনই বেছে নিয়েছিল। সংসার ভাঙ্গাটা তখন আর বড় কথা নয়। উদ্বাস্তুরাতো ভাঙনেরই ফসল। ফলে যাবতীয় ভাঙন ততদিনে তারা গ্রহন করতে শিখে গেছে।কিন্তু ভাই বোনের সংসারকে শুধু সাদা চোখে দেখতে তারা তখনও কেন যে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পারে নি,লিপি বুঝে উঠতে পারে নি। উপরন্তু ভাঙনের কালে যাবতীয় ভাবনার জগতটিও ভাঙনের কোলেই ঝুলতে থাকে বলে একদিকে তাই বেঁচে থাকার একটা চেষ্টা আর অন্যদিকে তাদের সম্পর্ক নিয়ে নানা অনুমানের গল্প-কথার জন্ম চলতে থাকে। তাকে আর কে আটকায়!
খুব বিশদ না হলেও সুরভির অভিমত এমন বয়ানেই থিতু হতে চেয়েছে।
কিন্তু পারিবারিক একটা সন্দেহের বাতাবরন তখন থেকেই তৈরি হচ্ছিলো। সতু ও লিপির দাদারা একসময় সতুকে তার পৈত্রিক বাড়ি থেকে তাড়িয়েই দিল। তাদের বক্তব্য অবিবাহিত ভাইবোন এই ভাবে এক সঙ্গে থাকা চলবে না। কেউ একজন বিয়ে করো। নতুবা ছেলে হিসেবে সতুকেই বাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকতে হবে। মানুষে নানা কথা বলছে। সে-সব কানে আসছে। তাতে দাদাদের পারিবারিক জীবন নানাভাবে ব্যহত হচ্ছে। ততদিনে সতু ও লিপির একটা আর্থিক সুরাহা অবশ্য হয়ে গেছে। লিপি একটি স্কুলে চাকরি পেয়েছে আর সতু একটি রাজ্যসরকারী কেরাণীগিরি জুটিয়ে ফেলেছে। ফলে সতু না থাকলেও লিপির জন্য দাদাদের আর কোন আর্থিক দায়ভারের ব্যাপার থাকলো না। থাকলো শুধু অরক্ষণীয়া বোনের দায়। কিন্তু লিপি ফুঁসে ওঠে বুঝিয়ে দিল যে, সে নিজেকে নিজেই রক্ষা করতে পারে। দাদাদের এব্যাপারে মাথা না ঘামালেও চলবে। সতু নীরবে চলে যেতে চাইলেও লিপি এটাকে একটা চরম অপমান হিসেবে নিয়ে সতুকে আটকাতে চেয়েছিলো। কিন্তু সতুর বক্তব্য ছিল—নারে লিপি এটা করিস না—এদের মুখতো আর বন্ধ করতে পারবি না—মাঝখান থেকে তুই মেয়ে হিসেবে বিপদে পড়ে যাবি। আমাদের সমাজ এই বিষয়ে কতটা হৃদয়হীন হতে পারে তুই ভাবতে পারবি না।
কিন্তু সতু যত কথাই বলুক লিপি এই অপমান সহজে মেনে নিতে পারলো না। অপ্রচল হলেও তাদের সম্পর্কের যে বিরল সত্তাটি তাদের মধ্যে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে সেটাকেই একটা কুৎসিত ইঙ্গিত করা—এটা সে ভুলে কী করে! সতু চলে যাওয়ার পর দাদারা তার বিয়ের জন্য প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করতে গিয়ে বিষয়টাকে আরো জটিল করে তুললো। একসময় লিপি তাদের পৈত্রিক পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কের ইতি টেনে দিয়ে একাকী থাকাই সাব্যস্ত করে নিল। সতুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করার প্রশ্ন নেই। কলকাতা শহরেরই বিভিন্ন স্থানে ভাড়া বাড়িতে থেকে সে তার চাকরি করে যেতে লাগলো। লিপির সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়মিতই ছিল।
লন্ডন স্টোর্স থেকে একদিন একটা ভদকার পাঁইট কিনে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে মাথার মধ্যে সুরভির মুখ থেকে শোনা কথাগুলো যেন লিপির জবানে কানে বাজতে থাকলো। সাধারণ্যের বিবেচনার অনেক বাইরে এই যে সম্পর্কের একটা নির্মাণ ঘটে গেল, তাকে রক্ষা করে বেঁচে থাকার শক্তি এরা কোথায় পেল—! সম্পর্কের আলো অন্ধকারতো মানুষই নির্মাণ করে—এ বিষয়ে এদের দুজনের কারোর মুখ থেকে এখনও কিছু শোনা যায় নি। আমি শুনতে চাইলেও এগুলো কি কাউকে বলার যোগ্য কিছু! আর আমি শুনতে চাইতেওতো পারি না। এটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ হয়ে যায় না?
অনেকদিন হয়ে গেল সতীশবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই । দেখা যাক যদি আজ পাওয়া যায়। ব্যাগের মধ্যে কিনে নেয়া জিনিসটা দিলে হয়তো খুশি হতে পারেন।
স্টেশনে এসে চুমকির মায়ের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে সতীশবাবু ঘরেই আছেন। ক’দিন বেরোচ্ছেন না। আরো বললো—কাকা মাঝে মাঝে এরকমই করেন। রান্না খাওয়া করেন না। সারাদিন ঘরেই থাকেন। যখনই খোঁজ নিই দেখি হয় হয় বসে বসে বই পড়ছেন না হলে শুয়ে শুয়ে। অদ্ভুত মানুষ আপনার বন্ধু। বয়স্ক মানুষ চিন্তাও হয় । আমি আবার ওনার ঘরে ঠিকে কাজ করি । না পারতে খবর দিই ওনার বোন, ওই ইস্কুলের দিদিমনিকে। খবর পেয়ে উনি এসে খাইয়ে দিয়ে যান। আবার আমাকে বলেও যান যেন একটু লক্ষ্য রাখি।
চুমকির মা কথা বলতে বলতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো— আপনি কি কাকার ঘরটা চেনেন? আমি বললাম— না, কখনো যাওয়া হয় নি।
আমার কথা শুনে সে চুমকিকে আমার সঙ্গে দিয়ে দিল ঘর দেখিয়ে দেয়ার জন্য।
অবসরের পর সতীশবাবু এই ওয়ান বি এইচ কে ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। বছর সাত আট হলো। সেদিন নেশার ঘোরে বলছিলেন ভাড়া বাড়ি। বোধ হয় দীর্ঘকাল ভাড়া থাকার ফল।
নগরায়নের দৌলতে এই সব উদ্বাস্তু অধ্যুষিত কলকাতার সন্নিহিত অঞ্চলগুলো ভূ-সম্পত্তি হিসেবে ক্রমশঃ লোভনীয় হয়ে উঠতে লাগলো। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে প্রমোটারী ব্যবসার প্রসারও শুরু হয়ে গেল। সতীশবাবুর দাদুর ভিটেটুকু তাই প্রমোটারের নজর কাড়তে দেরি হলো না। প্রমোটাররা সবুজ সংকেতের অপেক্ষা করে। পেয়ে গেলে তারাই সকল আইনী ওয়ারিশদের একসঙ্গে বসিয়ে তাদের কাজ সেরে নেয়। তখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন সতীশবাবুর এক দাদা। সেই বৃদ্ধ দাদাই একদিন এই প্রস্তাব সকল ভাইবোনেদের বা তাদের ওয়ারিশদের দিল যে, রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে এই জীর্ন বাড়ির বোঝা আর বওয়া সম্ভব না। সকলে সম্মতি দিলে প্রমোটরের হাতে এর একটা হিল্লে হয়। বাড়িটির বয়স অনুমান করে বাস্তবকে মেনে নিয়ে এবার আর কেউ দ্বিমত করলো না। এমনকি বলা হলো যে সতুও তার ভাগ পেয়ে নিজস্ব ফ্ল্যাটে এসে ইচ্ছে করলে থাকতে পারে। তাই হলো। তাদের জমি যে এত বড় আর উঁচু বিল্ডিং ধারন করতে পারে এটা ভাবতে পারেনি কেউ। কিছুদিনের মধ্যে জি প্লাস ফোর পেল্লাই বিল্ডিং দাঁড়িয়ে গেছে সেখানে। তাদের দাদু তলাপাত্র মশাইয়ের অনেক পরিশ্রমের ফসল ভূ-খন্ডটি আর দৃশ্যমান থাকলো না । তার বদলে এই আবাসন। একেক ফ্লোরে চারটে করে ফ্ল্যাট। একসময় সতু তার ভাগ বুঝে নিয়ে ঘর তালা বন্ধ করে চাবি লিপির কাছে রেখে গেল। তাদের জমির উপর গড়ে ওঠা আবাসনে সে আর আপাতত থাকতে এলো না।
কারণ এই অঞ্চল থেকে কিছুটা দূরে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে সে আগে থেকেই সেখানে থাকতে শুরু করেছে। ওটা সে ছাড়তে চায় না। লিপি অনেক বার বলেছে এখানে এসে নিজের ফ্ল্যাটে থাকতে— এখন বয়স হয়ে গেছে—হঠাৎ শরীর খারাপ করলে কে দেখবে—। কিন্তু সতু মানে নি।
দোতালায় সতীশবাবুর এই ছোট্ট ভাড়ার ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখা গেল তিনি বিছানায় শায়িত। মনে হতে পারে তিনি অসুস্থ। কিন্তু না। বই পড়ছেন। বিছানার অর্ধেক জুড়ে বই। ঘরের দেয়ালে র্যাকে শুধু বই আর বই। আমাকে দেখে উনি উঠে বসলেন। বললেন—মশাই ক’দিন যাবত আপনার কথাই ভাবছিলাম। যাক এসে গেছেন—খুব ভালো, খুব ভালো। ভালো জিনিস মানুষের জীবনে খুব কম । তাই হঠাৎ ভালো’র দেখা পেলে এখনও উজ্জীবিত বোধ করি। ঘরে একটাই আরাম কেদারা। আপনি আরাম করে এটাতেই বসুন। কী সৌভাগ্য আমার—।
চুমকি চলে যাচ্ছিলো দেখে ওকে ডাকলেন—কী দিদিভাই বুড়োদের রেখে চলে যাচ্ছিস যে বড়ো—। আয়, একটু এদিকে আয়।
চুমকি তার সেই গা মোচড়ানো ভঙ্গীতে ঘরে এসে বললো—কী বলবে বলো তাড়াতাড়ি, আমার ইস্কুল আছে।
—জানি তো তোর ইস্কুল আছে—দিদিভাই নিচের ওই দোকান থেকে আমাদের জন্য একটু চা আর বিস্কুট নিয়ে আয় দেখি ।
চুমকির এনে দেয়া চা বিস্কুট অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়ে গেছে। কথার মধ্যে আমার চোখ বার বার থরে থরে রাখা বইয়ের দিকে চলে যাচ্ছিলো। সেটা লক্ষ্য করে সতীশবাবু একবার বলে ফেললেন—বই দেখছেন?
—হ্যাঁ বই দেখছি—ভাবছি বইয়ের পেছনে আপনার শ্রম আর মনোযোগের বিষয়টা।
—বই একটা অভ্যেস বলতে পারেন আমার। কেউ কেউ এটাকে বদ অভ্যাসও বলে থাকেন। যাই হউক, এটা আর আমি ছাড়তে পারিনি। এখন এই অবসর সময়ে বই-ই আমার মানসিক আশ্রয় বলতে পারেন। এর মধ্যে কিন্তু কোনো পন্ডিতি নেই বা বই পড়ি বলে আমি অনেক কিছু জানি তাও না। আপনি বই নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমাদের কথাবার্তাগুলো ভুলে যাবেন না। আপনি এসেছেন এখন আর আমার বইয়ের দরকার নেই।
—না না তা কেন—কথাবার্তাতো হচ্ছেই। তা আপনি কি রান্না নিজেই করেন?
— হ্যাঁ এটাও আমি নিজের প্রয়োজনেই রপ্ত করে নিয়েছিলাম। সব ব্যবস্থা আছে। এখন আলস্য লাগে বলে মাঝে মাঝে লিপির ওখানেই চলে যাই।খেয়ে আসি।
—আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছিলাম।
—কী জিনিস?
ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়ানো পাঁইটটা বের করে বললাম
—দেখুনতো এটা পছন্দ হয় কিনা।
জিনিসটা হাতে নিতে নিতে সতীশবাবু সারা মুখে একটা আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো।
—বা! খুব ভাল করেছেন। ক’দিন বের হচ্ছিলাম না বলে আনাও হচ্ছিলোনা। কিন্তু ইচ্ছেটা ছিলই। খুব ভাল হলো।
সতীশবাবু দেরি না করে দুটো কাচের গ্লাস বের করে ঢেলে নিলেন কিছুটা। বললেন—আপনিও একটু নেবেন আজ।
আন্তরিকতা খাঁটি হলে তা স্পর্শ করে। মানুষটির আন্তরিকতাটা খাঁটি তাই স্পর্শ করে। যতদূর জেনেছি মানুষটি নীরব শ্রেণীর মানুষ। নীরবেই একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। হয়তো নীরবেই একদিন এই যাত্রাপথ শেষও হয়ে যাবে । এই সমাজে এই নাগরিকতায় এই বিচ্ছিন্ন বাঁচাটা আজ খুব দুর্লভ নয় হয়তো। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন সেটা সম্ভব হতো না। বিচ্ছিন্ন বাঁচাটা সমাজ সন্দেহের চোখে দেখতো। এখনও দেখে। কিন্তু নাগরিক শর্তাবলীর ক্রম- দৃঢ়তা এটা কে একটা সীমা পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখে। সতীশবাবু সেই সামাজিক আঁচড়গুলো চেনেন জানেন, মুখোমুখিও হয়েছেন বোঝাই যায়।
গ্লাসটা শেষ করে সতীশবাবু একটা সিগারেট ধরালেন আমার অনুমতি সাপেক্ষে। বললেন— সিগারেটটা এখন আর বেশি টানি না। তবে মাঝে মধ্যে টানতে হয়। আমাদের ওই বাড়িতে গেলে আমার এই অসুবিধেটা খুব হয়। লিপির বারন। সেটা আমার স্বাস্থ্যের জন্যই। আমার ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে আমাকে দেখাশোনার জন্য বলতে গেলে আমার চেয়ে ওকেই বেশি ভুগতে হয়েছে এযাবত। আর একবার যা সে বারন করে তা আর ফেরানো অসম্ভব । ছোট থেকেই সে ভীষণ একগুঁয়ে । তার উপর কর্মজীবনে একজন শিক্ষিকা হওয়ার দরুণ তার কথার খুব বেশি এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। মদের ব্যাপারে আপত্তি কম। তবে প্রকাশ্যে খাওয়া চলবে না। আমি ওই ডাক্তারখানার গাড়ি বারান্দার নিচে এসে ধূমপান করতাম ওই কারণে। তখন কে জানতো যে আমাকেও কেউ লক্ষ্য করে। আর সেটা শুধু একদিন না—বলতে গেলে দিনের পর দিন। হা হা মশাই, সেই পর্যবেক্ষক যে আপনি, যার সঙ্গে একদিন পরিচয় হবে, কথা হবে—এত সৌভাগ্য আমারও তা হলে ছিল—ভাবতে ভাবতে অবাকই লাগে।
কী একটু ঝিম ঝিম লাগছে না? আর একটু ছোট্ট করে নিই কী বলেন।
—নিন।
সতীশবাবু দুই গ্লাসেই ঢেলে নিলেন। আমি বললাম আজ আপনি খাবেন কোথায়?
—এই বেলা খাব না। রাতে লিপির ওখানে গিয়ে হয়তো খেয়ে আসবো।
—মদ্যপানের পর কিছু না খাওয়াতো শুনি ঠিক না। খালি পেটে –
—আমার অভ্যেস আছে। অসুবিধা হয় না।
আমার স্ত্রী সুরভির কাছে আপনার বা লিপির অনেক গল্প শুনেছি। শুনেছি আপনাদের কলেজ-জীবনের কথা। আপনাকে বলা হয়নি এরমধ্যে একদিন লিপি আমার ফ্ল্যাটে সুরভির খোঁজে গিয়েছিল। দুই পুরনো বন্ধুর সাক্ষাত—খুব আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিল তারা।
—হ্যাঁ, জানি। আমিই লিপিকে আপনাদের কথা বলি। শুনে সে-ই একদিন যাবে বলেছিল। যাক সে যে শেষপর্যন্ত গিয়েছিল এটা আর শোনা হয় নি। কী আশ্চর্য দেখুন আমাদের এই দক্ষিণের উদ্বাস্তু অঞ্চলটা কিন্তু খুব বড় নয়। একসময় ছোটবেলায় হেঁটে বা সাইকেলে এর সব জায়গাতেই আমরা সহজে যেতাম আসতাম। কিন্তু কী বিচিত্র মানুষের জীবনযাপন প্রণালী—বিশেষত আমাদের মত উদ্বাস্তুদের যে, একটা সময়ের পর কেমন যেন আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে এত ঘরবাড়ি আর নতুন মানুষের সমাবেশ ঘটতে লাগলো যে, আমরা শুরুর দিকের মানুষগুলো ক্রমশ হারাতে শুরু করলাম। না, তবে এতটা বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হয়তো ঠিক হবে না আমার বা আমাদের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে অনেকটা যেন ‘নিজেরই মুদ্রাদোষে একা হতেছি আলাদা’—রকমের ব্যাপারও আছে। আমি একটা দীর্ঘ সময় আমাদের এই অঞ্চলের বাইরে থেকেছি। বাড়িতে থাকতে পারিনি বলে। আমার ক্ষেত্রে সেটাও একটা কারণ বটে। আপনি সুরভির স্বামী। সুরভিও আমার বা লিপির খুব কাছেরই একজন। তাই আপনাকে বলতে বাধা নেই যে আমরা, আমি আর লিপি একটা আচরনগত বা দৃষ্টিভঙ্গীগত কারণে পারিবারিক বা কিছুটা সামাজিক ভাবেও একটা বিরুদ্ধতার মোকাবেলা করতে গিয়েও স্বজন বন্ধুদের থেকে দু’জনই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। এখনও বিচ্ছিন্নই আছি। আপনার সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো এটুকুও হতো না।
—আমি কিছু কিছু আপনাদের কথা সুরভির কাছে শুনেছি। আপনাদের দুঃসময়ের কথাও হয়তো ছিল তাতে।
—হ্যাঁ সঠিক বলেছেন দুঃসময়। আমাদের এক দুঃসময়ই ছিল বটে।
কথা বলতে বলতে সতীশবাবু বাকি পানীয়টুকু কখন যে খেয়ে ফেললেন টের পাই নি। একবার বললেন—মশাই প্রথম দিন আমার ঘরে এলেন আর কিছু খেতে দিতে পারছি না—খুব খারাপ লাগছে—আপনি একটু বসুন আমি কিছুটা খাবার নিয়ে আসি।
উত্তরে আমার আপত্তি খুব শুনলেন বলে মনে হলো না। বেরিয়ে গেলেন।
একা একা বসে থেকে ভাবছিলাম মানুষটির বয়স হয়েছে। শরীরটিও বেশ অশক্তই মনে হয় । একবেলা খাওয়া বা না খাওয়ার মধ্যে থাকা, এটা কি প্রকারান্তরে একটা আত্মহনন নয়? উনি কি এখন লিপির কাছে গিয়ে থাকতে পারেন না—বা নিজের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাদি আর একটু গুছিয়ে করতে পারেন না—। এখনতো আর বিরুদ্ধতা মোকাবেলার প্রশ্ন নেই। তারা-তো এখন এক প্রকার বৃদ্ধ বৃদ্ধা। এখন আর কে কি বলবে। আশ্চর্য মানুষের মন! আমরা আমাদের যৌবনকে আবাহন করি, আহ্লাদ করি, আবার ক্ষেত্র বিশেষে গভীর সন্দেহও করি। শুধুমাত্র সন্দেহ কি—না, আমাদের রীতি নীতি সংস্কার—আমরা যে ভাবে দেখি, ভাবি—চাই সকলেই সেই প্রকারেই দেখুক, ভাবুক। সতীশবাবু অন্যভাবে দেখেছিলেন, লিপিও হয়তো অন্য ভাবে দেখে থাকবে অভ্যন্তরীন সম্পর্কগুলোকে।
একটা কথা আছে যে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে থাকা যায় না। কিন্তু এই বাস্তবতাটা কী, কোথা থেকে আসলো, কে-ইবা তার নির্মাণ করলো বা কবে থেকে—।
নাঃ আমার পক্ষে এই ভাবনার বিষয়টা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। আমি এসব ভাবতে পারি, কিন্তু ওনাকে কি এসব কথা বলতে পারি? শরীর অশক্ত হলেও ব্যক্তিত্বে মোটেই অশক্ত নন তিনি। তবে যখনই ভাবছি যে, এই মানুষ দুটি একটা জীবন প্রায় অতিবাহিত করে দিলেন আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবহীন অবস্থাতে, তখন আমার এক অদ্ভুত কান্নার বোধ কেন যে হলো, কে জানে!
সময়টা আমি খুব খেয়াল করিনি। সতীশবাবু ঘরে ঢুকেই বললেন—আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।
হাত থেকে খাবারের প্যাকেট সামনের টেবিলে রাখলেন, সঙ্গে রাখলেন আরেকটি মদের পাঁইট। পাঁইটিটি রাখতে রাখতে আমার দিকে চেয়ে বললেন—আর একটু লাগবে—কী বলেন?
মানুষটির রসিকতাবোধটা এখনও বেশ তাজা। আমি বললাম আপনি আগে বসুন। একটু জিরিয়ে নিন-তো।
কিন্তু উনি আমার কথা কানে নিলেন বলে মনে হলো না। আবার দুই গেলাসে মদ ঢাললেন। জল মেশালেন। আমাকে একটা গ্লাস দিয়ে নিজেরটা নিয়ে প্রায় অর্ধেক গ্লাস খালি করে দম ফেললেন। বললেন—এবার জিরোবো, দুজনে খাবো, আর কথা বলবো।
উনি যেন ক্রমে একটা উৎসবের মেজাজ পাচ্ছেন। শরীর থেকে বার্ধক্যের চিহ্নগুলো যেন খসে খসে যাচ্ছে । কথার মধ্যে ক্রমে একটা আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ প্রকাশ পাচ্ছে। তারমধ্যে হঠাৎই শুরু করলেন—
—আচ্ছা গোবিন্দবাবু, আপনি কি কিছু মনে করবেন যদি একটু ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলি?
—না না মনে করার কী আছে—প্রায় সমবয়সী আমরা—কিছুটা বন্ধুত্ব হয়েছে যদি ধরি তবে আর অসুবিধে কি—বলুন।
—আপনি কি ভালবেসে বিয়ে করেছেন নাকি বিয়ে করে ভালবেসেছেন?
—হা হা, বেশ অদ্ভুতভাবে বললেন তো!
—হাসলেন যে—কথাটা কি লজিক সম্মত হয় নি?
— না না তা কেন —অবশ্যই লজিকসম্মত। হ্যাঁ, ভালবেসেই বিয়ে করেছি—আর বিয়ে করেও ভালবেসেছি। সুরভির সঙ্গে আমার বিবাহ-পূর্ব পরিচয় ছিল প্রায় বছর চারেকের ।
—বেশ, —ভালবাসার অনুভুতি কি আপনি কখনও অন্তত নিজের কাছে বর্ণনা করেছিলেন?
—না না, বর্ণনা ঠিক বলা যাবে না, তবে অনুভবে ছিল।
—অনুভবের ভাষারূপ দেখেন নি তাহলে?
—না, দেখিনি।
—এখানে দুটো কথা বলা যায় যে, অনুভব বলে যে জিনিসটির কথা আপনি বলছেন সেটা আসলেই একটা ভাষারূপ। ভাষা ছাড়া অনুভব তৈরি হয় না। আর ভাষা যেহেতু একটা বাস্তবতা তাই সে বস্তু ছাড়া চলতে পারে না। আর এখন যদি বলি ভালবাসার জন্য একটি বস্তু দরকার, আর আপনার ক্ষেত্রে সেই বস্তুটি একজন সুরভি নামের মহিলা। বা সুরভি নামের একজন মহিলার জন্য সেই বস্তুটি হলো গোবিন্দ সুর নামের একজন পুরুষ।
—ভালই লাগছে আপনার কথাগুলো। তবে সত্যি বলতে গেলে খুব পরিষ্কার করে বুঝতে না পারলেও —তবে হঠাৎ এই সব কথা কেন—বুঝতে পারছি না—একটু বলবেন কি?
—হ্যাঁ বলবো, বলবো বলেইতো—আসলে সরাসরি আপনার মত একজন সজ্জন বন্ধু মানুষকে কী করে আমাদের দুঃসময়ের কথাটা না বলে থাকতে পারি। কাউকেই কোনোদিন যা বলিনি—হয়তো না বললেও কিছু হতো না—তবু আপনাকে বলবো আরো এই কারণে যে, আপনি সুরভির হাজবেন্ড—যে আমার বা লিপির খুব কাছের একজন । আর এটা ধরে নেয়া খুব কঠিন নয় যে সুরভি আমাদের ব্যাপারে যতটা জানে তার কিছুটা আপনিও জেনে থাকবেন। আমাদের আপোষহীনতার কথা বা আমাদের দুঃসময় সম্পর্কে কিছুটা জেনেও যখন আপনি বারবার আমার কাছে আসছেন তখন আমার বোধ হয় কিছু বলা দরকার । আমাকে তাতে আপনার পছন্দ বা অপছন্দ হতেই পারে। তবু বলা দরকার।
—আপনার বা আপনাদের সঙ্গে আমার বা আমাদের এই যে দেখা সাক্ষাৎ, সেটা বলতে গেলে খুবই অন্তিম একটা পর্ব। আমার বা আমাদের সম্পর্কে যে সব কথাগুলো প্রচলিত ছিল একসময়, সেগুলো নিয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াজাত যে বর্ণনাগুলো গড়ে উঠেছিল সে-সব আর নতুন করে বর্ণনার সত্যি কোন অর্থ আছে বলে আমার আর মনে হয় না। তবে অপবাদ বা চরিত্রহননের বাতাসে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে নিতে হাঁপিয়ে উঠিনি যে, তা নয়, বরং কখনো কখনো নিজেদের বিনাশ করে ফেলার কথাও ভেবেছি। কিন্তু না, তা করিনি। একটা অজ্ঞানতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারিনি। আর সেটা না করে তার বিনিময়ে একটা সামাজিকতাকে খুব নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি। এই উপলব্ধির কথাগুলোই বলতে গেলে এখন আমার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাকগে ওসব বাদ দিন। কথা এত ব্যক্তিগত হয়ে পড়লে আড্ডা আর জমে না। বরং একটু ছড়ানো যাক কথাগুলো। আচ্ছা আপনাকে যে প্রশ্নটা করেছিলাম, মানে ——আপনি কি ভালবেসে বিয়ে করেছেন নাকি বিয়ে করে ভালবেসেছেন? আপনি একটা উত্তরও দিয়েছেন। কথাটা এখান থেকে আবার শুরু করলে কেমন হয়—
—হ্যাঁ হ্যাঁ শুরু করুন না। আরে আপনার যেখান থেকে ইচ্ছে হয় করুন না, অসুবিধে কি–
—না অসুবিধে কিছু নেই। তবে আর একটা ছোট্ট প্রশ্ন আপনাকে করে নেব তার আগে, যেমন ‘ভালবাসা’ ব্যাপারটা কি খুব প্রয়োজনীয় নরনারীর মধ্যে? মানুষের পরিবার, সমাজ বা অন্যান্য সকল পরিসরে সম্পর্কগুলোকে আমরা স্নেহ মমতা আদর ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকলেও প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর মধ্যে সম্পর্ককে কিছুটা পৃথক করে নিয়ে ‘ভালবাসা’ বলে থাকি। বলছিলাম যে এটার কি খুব প্রয়োজন ছিল? আমাদের সামাজিক বিন্যাসে এর জন্য-তো কোনো আলাদা পরিসর তৈরি নেই। ফলে নৈতিকতার দিক দিয়ে শব্দটি কি খুব বৈধতা পায় ? কেউ হয়তো বলবে যে বৈধতা পাওয়া উচিত। কেউ বলবে উচিত না। আসলে পায় না। আসলে ভালবাসা ছাড়া সমাজ কিন্তু দিব্যি চলতে পারে। কোন অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। স্ত্রী পুরুষের সম্পর্কের মূল বিষয় যৌনতা এবং বংশ রক্ষা। সেখানে ভালোবাসা শব্দটা আরোপিত। আরোপিত ততক্ষণই যতক্ষণ না সেটা নির্মিত হয় সভ্যতার অঙ্গ হিসেবে। সভ্যতা বলতে মানুষের ক্রমবিকাশ। সেই পথে কবে থেকে লিঙ্গ পরিচয়কে খাদ্য আর খাদকের রূপকের ভেতর ঠেলে দিলাম আমরা—বলতে পারেন !
তবে আমাদের, অর্থাৎ আমার আর লিপির মধ্যে এই সম্পর্কের সূত্রটা খুঁজলে দেখা যায়, একটা অনাথবোধ আমাদের দু’জনের মধ্যেই কাজ করছিল। আর সেটা একটা পারিবারিক ইতিহাস। ক্রমে সেটা একটা সমাজেরও ইতিহাস বলে জানতে পেরেছি। বয়ঃসন্ধির সময়ে অনেক সম্পর্কের পুননির্মাণ হয়। আমাদের সেটা হয় নি। আমরা সেই অনাথবোধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি, এটাই আমাদের অপরাধ। বয়ঃসন্ধি পার করেও আমরা হাতে হাত ধরেই থেকেছি বা থাকছি।