কাজল ঘোষ
আমার মামার বাড়ি ইলইচ্চা। শুদ্ধ বাংলায় যাকে বলে হিলচিয়া। কিশোরগঞ্জের সরারচর উপজেলার একটি ইউনিয়ন। ছোটবেলায় মায়ের আঁচল ধরে কত যে গেছি, তার সবই আজ স্মৃতি। তখন পথঘাট ছিল না। শুকনো মওসুমে পায়ে হাঁটা। বর্ষায় নৌকা। দুই মওসুমের দুই তরিকা। মা অবশ্য বর্ষাতেই যাতায়াতে বেশি স্বস্তি পেতেন। ছোটো বলে আমাকে কোলে নিয়ে এতটা পথ হাঁটা মায়ের জন্য সত্যিই কষ্টের। তবুও মামাবাড়ি বলে কথা। যদিও আমার জন্মের আগেই মামা চিরবিদায় নিয়েছেন। আমি শুধু মায়ের মুখেই মামার গল্প শুনেছি। তবে সব ছাপিয়ে মামার বাড়ির যে স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করে তা হলো— মামাবাড়ির আবহ। বিশেষ করে পুজো শুরুর আগের ক’মাস।
কুমোরপাড়ায় ছিল মামাবাড়ি। আর পুজোর সময় কুমোরপাড়ায় মায়ের মূর্তি গড়তে ধুম পড়ে যেতো। তার দু’তিনটি স্মৃতি আজও মনের দরোজায় কড়া নাড়ে। পাড়াটি কুমোরপাড়া হলেও একমাত্র ঘোষ বাড়ি ছিল মামাদেরটাই। সেই কুমোরপাড়ার বীরু কাকা, ভানুকাকাদের পুজোর দু’তিন মাস আগ থেকেই সেকি ব্যস্ততা। পুজোর দিন গণনায় তাদের পেরেশানি। বায়না করেছে অমুক বাড়ি আর তমুক বাড়ি থেকে। নদীর ঘাটে নৌকো নিয়ে আসবে অমুক দিন। প্রতিমা মায়ের কাঠামো এখনো বেশ বাকি। তখন তো আর এখনকার মতো মোবাইল নেই। হ্যালো বলে কোনো একটি অজুহাত খাড়া করলেই এক/দুদিন সময় বাড়ানো যেতো তেমন সুযোগ ছিল না। কথা মানে, পাক্কা কথা। রাত জেগে পরিবারশুদ্ধ এক চালিতে মাকে সাজিয়ে দেয়া শেষ করে তবেই না জিরোনো।
মামারবাড়ি গেলেই কাজ ছিল পুরো পাড়াজুড়ে হল্লা করা। বাড়ি বাড়ি উঠোনে গিয়ে মাটি ছানা দেখা। প্যাক-কাদায় মাখামাখি করা। একটি অদ্ভুত চিত্র দেখতাম এ সময় কুমোরবাড়িতে। কিছুটা উঠোনে। কিছুটা বাড়ির ভেতরে। কিছুটা অস্থায়ী ঘরে। প্রতিমা মায়ের নানা কাঠামো তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বলা ভুল হবে। গড়া হচ্ছে। বাংলার চিরায়ত মা মানেই হচ্ছে ঐক্য, অর্থাৎ একত্র। পরিবারের সকলেই এক চালার নিচে। অনেকেই আবার একে ‘একচালি’ বলে থাকে। এক চালির নিচে মা তার চার সন্তানকে নিয়ে চলেছে। মায়ের পায়ের নিচে দুর্মুখ অশুর আর বাহন সিংহ। মায়ের ক্ষমায় অশুরও সন্তানতুল্য। অদূরে পেছন থেকে মাকে অনুসরণ করছে শিব। লুকিয়ে তিনি দেখছেন প্রিয়তমা পত্নীর কেমন কাটছে বাবার বাড়ি।
কুমোরবাড়িতে ধীরে ধীরে গড়া হচ্ছে প্রতিমা। কতোই না যত্ন করে মাকে গড়ছেন। খড় যাকে আমরা বলি খেড়। যা দিয়েই মা তৈরি হচ্ছেন একটু একটু করে। ভানু কাকাকে দেখতাম মাটির সঙ্গে পাট আর খড়ের মিশ্রণে আগে মাটি ছানতেন। তৈরি করতেন মাটিকে। প্রথম দিককার এই মিশ্রণকে বলা হয় বুইত্তা। যাতে বাঁশের তৈরি কাঠামোর মধ্য দিয়ে দেবীর আকৃতি দেয়া হতো ধীরে ধীরে। আমার আগ্রহ ছিল সবসময় সিংহ কীভাবে গড়ছেন সেদিকটাতে। দেখতাম পাট দিয়ে সিংহের চুল বানাতে। রং, তুলিতে আস্তরণ দিতে। আর একেকবার রং দিয়ে তা রোদে শুকাতে। পরতে পরতে রং পরে ধীরে ধীরে একসময় পুরো পরিবার হতো। এই মূর্তি প্রতিমা গড়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতাম। এরপর কাকা কি করবেন, আমি একটু করতে চাই। যদিও সাহসে কুলাতো না। যদি কোনো কিছু নষ্ট হয়ে যায়। আর বিস্মিত হতাম। একেক আস্তরণ দেয়ার পর মায়ের মূর্তি একেক রকম লাগত। ধীরে দীরে পূর্ণতা পেত।
যতই দিন যেতো আর আবাহনী গীত বাদ্যে মনে হতো মা যেনো কুমোরপাড়াতেই সবার আগে আসবেন। আর মায়ের মূর্তি গড়া পুরোপুরি না-হওয়া পর্যন্ত ঢেকে রাখা হতো পাতলা কাপড়ে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে আড়চোখে দেখার চেষ্টা করতাম মাকে। পুরো কুমোরপাড়ায় দশ বারোটা মূর্তি গড়ার কাজ চলতো একত্রে। ঘুরে ঘুরে দেখতাম কোন মা কেমন হবে? পুজোর আগ দিয়ে দিনরাত কাজ হতো। এমন হয়েছে রাতে ঘুমিয়েছি কার্তিক, গণেশ তখনও রঙ হয়নি বা লক্ষ্মী সরস্বতীর শাড়ি তখনও মেটে রঙে ঢেকে আছে। সকালে ঘুম ভাঙা চোখে যখন চোখ কচলাতে কচলাতে গিয়ে হাজির হয়েছি, দেখি মা দেখতে অন্যরকম।
কুমোরপাড়ার ছেলে-বুড়ো-মা-খুড়িদের ঘুম নেই। লগ্ন-তিথি হিসাব করে সময় কাটছে। নাওয়া-খাওয়া শেষ। বীরু কাকা আর ভানু কাকাদের ধ্যান-জ্ঞান কেবলই মায়ের মূর্তি গড়া। এঁটেল মাটিকে নিজের করে ছানতেন তারা পুজোর তিন/চার মাস আগে থেকেই। খুঁজে খুঁজে কোনো দূর অঞ্চল থেকে এঁটেল মাটি নৌকায় করে নিয়ে আসতেন। আর মাটি যদি ভালো না-হয় তাহলে তো সর্বনাশ! মায়ের গড়ন ভালো হবে না। আর কোনো অশুচি বা অসামঞ্জস্য কোনো কিছু দিয়ে মায়ের মূর্তি গড়া যাবে না। তাই অনেক খেয়াল রাখতে হয়। মাটি পেলেই সব হচ্ছে, তা তো নয়। তাকে নিজের করে নিতে বা নিজের মতো করে পেতে তৈরি করতে হয়। যাকে বলে ছানতে হয়। মাটিকে জাগান দিতে হয়। জল আর কাদায় ধীরে ধীরে একটি মিশেলে একরকমের মণ্ড বা বুইত্তা বানিয়ে তারপর প্রথম ধাপ শেষ। তারপর খড়কুটো দিয়ে বাঁশের কাঠামোতে প্রলেপ দিতে হয়। এভাবে চলে একটু একটু করে প্রতিমা সৃজনের কাজ। একেবারে শেষবেলায় আমরা মহিশাসুর মর্দিনীকে দেখতে পাই।
মজার বিষয় হচ্ছে সবকিছু শেষ হলেও পুজোর লগ্ন ছাড়া মায়ের চোখ কিন্তু ফুটানো হয় না। অর্থাৎ মায়ের সকল দিক গড়া হলেও কুমার মায়ের চোখ ফোটানো বা প্রাণ দেয়ার কাজটি করতে পারেন না। এর জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় মাহেন্দ্রক্ষণের। কুমোরবাড়ি থেকে মায়ের মূর্তি নিয়ে মন্দিরে স্থাপন করলেও তা থাকে কাপড় দিয়ে বা কাগজে ঢাকা। ঠিক পুজোর লগ্নে ঠাকুর মন্ত্র দিয়ে মায়ের চোখ উন্মোচন করতে বললে কুমার তুলির আঁচরে তা করেন। ঠিকঠিক মায়ের সেই দৃষ্টি যারা দেখেছেন তারাই বলতে পারবেন— একদিকে মায়ের অসুর মর্দিনী রূপ আর অন্যদিকে মায়ের স্নেহাশীলা সন্তান বাৎসল্য রূপ। স্বামী বিবেকানন্দের কথায় বলতে হয়, মাটির মূর্তি গড়ে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া, মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে হয়ে যাই আত্মহারা।
পুজোর মূর্তি গড়ার একটি ভিন্ন দিকও রয়েছে। অনেক কুমোরবাড়িতে মায়ের মূর্তি আগাম তৈরি করে রাখা হয়। যাকে আমরা বলি রেডিমেট। এমনও হয়েছে যে, একবার একটি কাঠামো বিকোয়নি। বিকোয়নি বলা হয়তো ঠিক হচ্ছে না, সে বছর কোনো একটি এলাকায় পুজো কম হচ্ছে। তাই মায়ের কাঠামোটি রয়ে গেছে কুমোরবাড়িতেই। সেই মায়ের তো চোখ ফুটানো হয়নি। মায়ের সেই কাঠামো অপেক্ষায় আছে পরের বছরের জন্য আর কুমোরবাড়ির সকলেরও মন খারাপ। অপেক্ষায় থাকতে হয় ফি বছরের জন্য।