সাত্যকি হালদার
এত দিন অবধি কেতাব আলি শরীরে তেমন কোনও সমস্যা টের পায়নি। তে-রাস্তার ধারে তার মুদি
দোকান ভালো চলেছে। দুই মেয়ের ভিতর ফরজানার বিয়ে নিয়ে কিছু দিন উদ্বেগ ছিল। ফরজানা
গ্রাজুয়েট না হয়ে বিয়ে করবে না। শেষ পর্যন্ত সে ঝামেলাও মিটে গেছে। বিয়ে পরীক্ষা শেষ হওয়া
মাত্র ফরজানার পাত্র পাওয়া গেছে আর ফরজানা তাতে আর আপত্তি করেনি। ফলে কেতাব আলি
আর তার বউ সালমা এখন অনেক ঝাড়া হাত-পা। চাপ নেই, দেনা বাকি নেই। এখন বাকি আছে শুধু
হজটা। তাতে দুজনেই যাবে। তার জন্যে খানিক টাকা-পয়সার দরকার। তবে কেতাব আলি ভালো জানে
হজ মানুষের ইচ্ছেয় তত খানি নয় যত খানি আল্লার ডাক।
আল্লা যে দিন চাইবেন সেদিন সরকারি হজ হাউসের এসি-বাস এমনি এসে তার দরজার সামনে
দাঁড়াবে।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। তবে গোল বেঁধেছে অন্য জায়গায়। হপ্তা খানেক হল কেতাব আলির
ঘুম আসছে না রাতে। ঘুম না আসার কারণ অন্য কিছু নয়। তার কাজকর্ম, দোকান ভালো চলছে, এত
দিন রাতে শুলেই ঘুম এসে যেত। রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটতে বেরনোর অভ্যাস। সে টুকু হাঁটা
কাছাকাছিতেই। খানিক এগোলে মসজিদ, তা ছাড়িয়ে হাই স্কুলের মোড়, সেই পর্যন্ত হেঁটে আসা।
সেই হাঁটার সময় দেখা হত তার বয়সি আরও দু-একজনের সঙ্গে। অল্প দুই একটা কথা হত।
তারপর ফিরে এসে বিছানা, এবং ঘুম। তার এই তেষট্টি বছর বয়সে রাতের ঘুম নিয়ে সাধ্য-সাধনা
করতে হয়নি কোনও দিন।
কিন্তু ঝামেলা বাঁধল হপ্তা খানেক আগে। যখন এক দিন ভোর রাতের দিকে স্বপ্নে সে
বেহেস্তের ছবি দেখে ফেলল। ভোর রাতের দিকে তাকে উঠতে হয় একবার। এত কাল এটা ছিল না।
বয়স ষাট ছাড়িয়ে যেতেই শুরু হয়েছে শেষ রাতে ঘুম ভেঙে তাড়াহুড়োয় একবার বাইরে যাওয়ার
উপদ্রব। সেদিন ভোরে সে ফিরে এসে বিছানায় শুতে না শুতে স্বপ্নে বেহেস্তে চলে গেল। সেখানে সে
ছিল প্রায় আধ ঘন্টার মতো। তারপর সকালে উঠে সালমা জানালা দরজা খুলে দিতে তার স্বপ্ন
ভেঙে গেছে।
বেহেস্তে ক জন যায় আর কে যায় না সে সব আলাদা ব্যাপার, কিন্তু বেস্ত-এর স্বপ্নও তো
কম কথা নয়। কয় জনের জন্য সেটুকু বা ঘটে! কেতাব আলি সুখ আর আরামের ভিতর দিয়েই ঢুকে
পড়েছিল সেখানে।
কেতাবের ছোটখাটো মুদি দোকানটা বাড়ি থেকে অল্প দূরে। দোকানে মুদি মাল ছাড়াও হাওয়াই
চটি, বাচ্চাদের খেলনা, অ্যাসপিরিন বড়ি এ সবও মেলে। প্রথম প্রথম দু এক জন সন্ধেয় বাড়ি
ফেরার মুখে কণ্ডোমের খোঁজ করতে আসত। কেতাব তাদের স্পষ্ট না বলে দিয়েছে। সে ধর্মপ্রাণ
নামাজি মানুষ। সকাল সন্ধে দুবার মসজিদে যায়। মসজিদে গিয়ে চেনা পরিচিত কয়েক জনের সঙ্গে
দেখা হয়। তাদের সঙ্গে আল্লাহ্ বিষয়ক কথা হয়। আল্লাহর দুনিয়ার কোনও শুরু নেই শেষ নেই।
যদিও সে সব কথার মধ্যেই কখনও আবার ঢুকে পড়ে লোকাল বাজারে পটল আর সবজির দরদাম,
রাজ্যে সিদিকুল্লা চৌধুরীর মতিগতি, বিজেপি, কদাচিৎ ইরাক আফগানিস্তান প্রসঙ্গও।
সিরাজ তরফদার হাইস্কুলে ভূগোল পড়ায়। কেতাব আলির কাছাকাছি বয়স। দেশকালের খবর
সে-ই যা একটু বেশি রাখে। ক দিন আগে সন্ধের পর মগরিবের নামাজ শেষ করে হেঁটে ফেরার পথে
ভূগোলের মাস্টার বলেছিল, আল্লার দুনিয়ার সঙ্গে আমেরিকার লড়াইটা মনে হয় অনেক দূর
গড়াবে। এই ট্রাম্প লোকটা আসার পর থেকেই চার দিকে শুধু ডিসটার্ব।
তারপর আরও খানিক হেঁটে আলাদা হয়ে যাওয়ার মুখে সিরাজ মাস্টার বলেছিল, তবে বেস্তে
বসে আল্লা দেখতেছেন সবই। ঠিক সময়ে যেখানে যেমন দেয়ার ঠিক টাইট দে দেবেন।
কেতাব আলির মাথায় ঠিক তখনই বেহেস্ত বা বেস্ত কথাটা ঢুকে যায়। এর আগে তার যে
বেস্ত বা বেস্তের উল্টো-দিকে জান্নাম নিয়ে ধারণা ছিল না তা নয়। পৌষ মাসে হাইস্কুলের মাঠে
রাতে ইসলামিক জলসায় বসিরহাট মাদ্রাসার বড় হুজুর তো প্রতি বারই বেস্ত আর দোজখ নিয়ে
জ্ঞান দেন। বেস্তের আরেক নাম জান্নাত। হুজুরেরই কথা। জান্নাত আবার আটটা। শেষ
জান্নাতের নাম ফেরদৌস। হুজুরের কথায়, সাবধান হয়ে চললে আর নামাজ রোজা মানলে ফেরদৌস
বাঁধা। সেখানে একবার পৌঁছতে পারলে আরামের শেষ নেই। এক দিকে সুরা আর অন্য দিকে দুধের
ঝরণা। কোনও দিন বিয়ে হবে না এমন সব হুরিদের সঙ্গে মেলামেশা। কিশোর গেলেমানদের হাতের
সেবা।
আরও অনেকের মতো কেতাবের ধারণা ছিল এমনই। দুনিয়াদারির যেখানে শেষ তার ও দিকে
বেস্ত। কিন্তু স্বপ্নে যে বেহেস্ত থেকে কেতাব আলি আধ-ঘন্টার জন্য ঘুরে আসতে পারল তাতে
কিছু অদ্ভুত ব্যাপারও দেখা হল তার।
স্বপ্নে সরাসরি ফেরদৌস পর্যন্ত যেতে পেরেছে সে। ওই সব নদী ঝরনা হুরিদের এক ঝলক
দেখেও নিয়েছে। কিন্তু মিছিমিছি স্বপ্নে পৌঁছেছে বলেই হয়ত মাদ্রাসা হুজুরের বলা লম্বা আর
টানা চোখের সেই সব হুরি মেয়েরা কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। বরং হুরিরা অনেক বেশি
ব্যস্ত ছিল নুরু মিঞাকে নিয়ে। তাদের এলাকার মেম্বার এবং মাতব্বর কাশেম তথা নুরু মিঞার
এন্তেকাল হয়েছে মাস সাতেক আগে। কেতাব আলির স্বপ্নে দেখা বেস্তে সেই নুরুকে নিয়েই পাঁচ-
সাতটা হুরির যত রকম হুড়োহুড়ি। প্রায় ঢলাঢলি বলা যায়।
শেষের দিকে মেম্বারের কাজকর্মের সঙ্গে জমির দালালি শুরু করলেও নুরুও আদতে ছিল
ধর্মপ্রাণ মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ থেকে শুরু করে পুরো রমজান মাস রোজা রাখা, কলমা পড়া,
ঢাকঢোল পিটিয়ে রমজানের শেষে জাকাত দেওয়া সবই করেছে সে। সিপিএমের আমলেই তার ব্যবসা
আর ধর্মের যত রমরমা। শেষের দিকে সিপিএম ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ায় খানিকটা আতান্তরে
পড়েছিল। তখন কিছু দিন চুপচাপ ছিল। তৃণমূল তাকে নেবে না তা সে জানত। নুরুর তখন মন্দা সময়।
কী করে কোথায় যায়! এক বার কলকাতায় গিয়ে রাহুল সিনহার সঙ্গে দেখা করে বিজেপি করারও
ইচ্ছে প্রকাশ করে এসেছিল। রাহুল সিনহা সব শুনে বলেছে ভেবে দেখি।
কিন্তু শেষে হঠাৎ কী ভাবে কপাল খুলে গেল নুরুর। তৃণমূলই শেষ পর্যন্ত ঢুকিয়ে নিল তাকে।
তারপর আর তাকে দেখে কে! ব্যবসা বেড়ে উঠল চড়চড় করে। জমির ব্যবসা, গরুর করবার। একটা
বউ থাকতে আর একটা কম বয়সি মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল চট করে। আবার হজটাও হয়ে গেল গত
বছর। জীবনের ষোল কলা পূর্ণ হল নুরু মিঞার।
তবে হজ করে এসে লোকটা আর বাঁচেনি। গল ব্লাডারে ক্যান্সার হয়ে ফুট করে মরে গেল দশ
দিনে। রুবি হাসপাতালে শেষ দু দিনে দু লাখ টাকার বিল।
তবে ওই যে। ধর্মের বিধান মেনে চললে যা হয়। কেতাব আলি হিন্দুদের কীর্তনের পাশ দিয়ে
যাওয়ার সময়ও এক বার এ রকম একটা কথা শুনেছিল। ‘একবার কৃষ্ণ নাম যত পাপ হরে, পাতকীর
সাধ্য নাই তত পাপ করে’। তার ধর্মেও এমন ব্যবস্থা নিশ্চয়ই রয়ে গেছে। নামাজ, রোজা, জাকাত,
কলমা, হজ—এই পাঁচ মানলে বেহেস্ত পারমানেন্ট। আগে তুমি জমির দালালি করে এসেছ না কি
বিজেপি করে এসেছ কেউ দেখতেও যাবে না। নইলে নুরু মিঞাকে নিয়ে বেস্তে এত মাতামাতি থাকতে
পারে! চার-পাঁচটা হুরি কেন তাকে নিয়েই পড়ে থাকবে!
নুরু যে কেতাবকে একেবারে দেখেনি তা নয়। নুরু পাত্তা দেয়নি। কিংবা চেনা লোককে চিনতে
চায়নি। কেতাব আলির ধারণা ছিল বেস্ত একেবারে ফাঁকাফাঁকা জায়গা। এখানে ঝরনা, ও দিকে নদী,
কোথাও আখরোট আর খেজুরের বাগান। সাজানো মরুদ্যান। তার ভিতর অল্প কিছু মানুষ
ধীরেআস্তে হেঁটে চলে বেড়ায়।
কিন্তু কেতাবের স্বপ্নে-দেখা বেস্ত একেবারেই ভিন্ন রকম। নদী ঝরনা আছে ঠিকই, কিন্তু
সে সব ঘিরে বিরাট ভিড়। যেন বড় একটা পিকনিক। অনেকটা শীতকালের রবিবারে চিড়িয়াখানার
মতো। কিংবা ব্রিগেডে পার্টি সমাবেশ। ও দিকে বক্তৃতা, এ দিকে রান্না। বেস্তে পৌঁছে কেতাবের
একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা। নুরু মিঞা ছাড়াও আরও দু-চারটে চেনা মুখ এদিকওদিক দেখতে
পেয়েছিল। তারা বেশির ভাগ ওই নুরু গোছেরই। সব তাদের ওই হামিদপুর বা তার আশপাশের। সবাই
বেশ রোয়াব আর মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ওখানে।
স্বপ্নের শেষে এসে দেখা হয়ে গেল খায়রুল চাচার সঙ্গে। খায়রুল চাচা হামিদপুর এলাকার
পুরানো মানুষ। বেশ ক-বছর হল এন্তেকাল হয়েছে। নামাজ রোজা করলেও পয়সা আর ধরাধরির
অভাবে চাচার শেষ পর্যন্ত হজ করা হয়ে ওঠেনি। শেষ বয়সে একা একা সারা রাত নদীর ধার আর
মসজিদের আশেপাশে হাঁটতেন। ছোট্ট একটু রোগভোগের পর তার এন্তেকাল হয়।
নির্জন একটা আখরোট গাছের গোড়ায় চুপ হয়ে বসেছিলেন চাচা। ভিড়ের থেকে খানিকটা দূরে।
কেতাবকে দেখতে পেয়ে একটুখানি ডাকলেন। খুশি হলেন যেন। বললেন, তোমাদের ও দিকের খবর কী
কেতাব। তোমার মেয়েজামাইরা সব ভালো তো!
কেতাব বলল, আপনি বেস্তে থাকবেন তা আমরা জানতাম। আপনার মতো মানুষদের জন্যই তো
আল্লার এই ব্যবস্থা। কিন্তু বাকি যাদের দেখছি…!
চাচা ম্লান হেসে বললেন, বলিসনি রে বাপ। তারাই তো এখানে সব। হুরি পরি গেলেমান সব
তাদের পেছনে। আমরা ওই চুপচাপই থাকি। দু বেলা দুটো খেতে পাই এই পর্যন্ত। …নদীর ধারে
হামিদপুরের হাটটা কি এখনও চলছে?
তা চলছে। কেতাব আলি বলল। তবে এইখানে যে এ রকম অবস্থা তা তো আল্লার কাছে বলতে
পারেন একটু। এই সব নুরুর মতো লোকেরা… এদের পাস্ট ইতিহাস।
খায়রুল চাচা লম্বা শ্বাস ফেললেন। উঠে দাঁড়িয়ে কেতাবের সঙ্গে এলেন বেহেস্তের মেন গেট
পর্যন্ত। তার মাথা নিচু। বললেন, আল্লা এখন বিরাট ব্যস্ত। সব কিছু জানলেও তার এখন এ সব
দেখার সময় নেই। ইরাক নিয়ে, আফগানিস্তান নিয়ে, সিরিয়া নিয়ে সারা দিন ছুটোছুটি। গাদাগাদা
শরণার্থী, রোহিঙ্গা, আই-এস জঙ্গি, আসাদ, তালিবান, কেউ কারও কথা শুনছে না। ও দিকে
পাকিস্তানে ইমরান খান জিতে বসে আছে। তার সঙ্গে হাপিজ সইদের মিলতাল নেই। …আল্লা একা
কদ্দিক কী করবেন! তারে তো কেউ পাশে দাঁড়িয়ে হেল্প করার লোক নেই। ফলে বেস্তে এসে খায়রুল
মিঞা শোয়ার জায়গা পেল কি পেল না, খেল কি খেল না, থাকল না মলো, তা নিয়ে ওনার ভাবারও
সুযোগ নেই। অনেকটা ওই মমতা ব্যানার্জির মতো। বন্যার সময় সারা রাত একা নবান্নে গালে হাত
দিয়ে বসা। আমলা মন্ত্রীরা ঘরে ঘুমোচ্ছে।
আর এই সময়ই সেদিন সকালের আলো ফুটলে ঘরের জানালা দরজা খুলে দেয় সালমা, কেতাবের
বউ। কেতাব আলিকে ডেকে দেয়। বেস্ত ঘোরা শেষ হয়ে যায় কেতাবের। সে খালি গায়ে উঠে বসে।
অনেক ক্ষণ বসে থাকে চুপচাপ।
তারপর থেকে হপ্তা হতে চলল কেতাবের চোখে আর ভালো করে ঘুম নেই।