চন্দন আনোয়ার

মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে ইচ্ছামৃত্যু ঘটিয়ে জীবনের যবনিকা টেনে কায়েস আহমেদ কী জানিয়ে গেলেন, এতো বছরেও আমি বা আমরা কেউ উদ্ধার করতে পারলাম না। তাঁর নিজের মনোরোগ বা স্ত্রীর নিরাময়হীন মানসিক ব্যাধির ব্যাখ্যাটাও আমি ঠিক মেনে নিতে পারি না। জীবনপাঠের এমন একজন নিবিড় পাঠক, যার নির্মিত প্রতিটি চরিত্রই কিনা নিরেট বাস্তববাদী ও জীবনবাদী, যে কিনা মানুষের অন্তর্গত রক্তের ভেতরের ভণ্ডামী, প্রতারণা, দারিদ্র্য, ঘৃণা, রিরংসা, পাশবিকতা অর্থাৎ আমাদের সমাজের দেহের প্রতিটি অঙ্গের ছাল-বাঁকল তুলে তুলে দেখেছেন, জীবন-সমাজের এমন একজন বাস্তব রূপকার, এমন একজন বৌদ্ধিক মানুষ জীবনকে এতোটা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখবেন এবং ইচ্ছামৃত্যুর মতো জীবনবিরোধী সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন, কোন যুক্তিতেই ফেলা যায় না এবং মেনে নেয়া কঠিন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার প্রতি বীতরাগ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হয়ে মধ্যপথেই হাল ছেড়ে দিয়ে নিশ্চয়তাকে নষ্ট করার কষ্ট ছিল, পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার বিখ্যাত শেখ পরিবারের ছেলে দেশভাগের কারণে বাবা-মাকে নিয়ে দেশত্যাগ এবং পরবর্তীতে বাবা-মা ফিরে গেলেও নিজে থেকে যাওয়ায় স্কুল জীবনেই নিঃসঙ্গতা ছিল এবং এই নিঃসঙ্গতা আরও প্রগাঢ় হয়েছিল ঢাকা শহরের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে স্বেচ্ছায় সম্পর্ক চ্যুতির কারণে, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানে প্রতি অস্বীকৃতি ছিল, রক্তে-মাংসে বাঙালি কিন্তু আত্মা পাকিস্তানি এমন বৈরীশক্তির রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল মেনে নিতে না পারা কষ্ট ছিল—বিবিধ নেতির বা অস্বীকৃতির সাথে সমঝোতা করে বেঁচে থাকার লড়াইকে গল্পের একেকটা চরিত্রের মধ্যে যখন দেখি, তখন মনে হয়, নিজের জন্য না হলেও, বাংলা কথাসাহিত্যের জন্য কায়েস আহমেদের উচিত ছিল অন্তত আরও বিশটা বছর বেঁচে থাকা। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আত্মহত্যার মধ্যে কায়েস কী জানতে চাইলেন? মানুষের জীবনের রহস্য খুঁজতে খুঁজতে নিজের জীবনভর অসুন্ধানের চরম জবাবটি পাওয়ার জন্যেই কী মরিবার হলো তাঁর সাধ? মানুষের রহস্যময়তা ভেদ করতে না পেরে, তিনি কি পরম জিজ্ঞাসাটি ছুঁড়ে দিলেন প্রকৃতির দিকে? কায়েসের কোনো সাধ আর সাধ থাকে না, তাঁর সব সাধই রূপ নেয় সংকল্পে। তাঁর সংকল্প আর জিজ্ঞাসা পরস্পরের সঙ্গে অচ্ছেদ্য। কায়েস আহমেদের আত্মহত্যা কি তাঁর অনন্ত জিজ্ঞাসা অব্যাহত রাখার শেষসংকল্প?’ (মরিবার হলো তাঁর সাধ)
জীবনের অনন্ত জিজ্ঞাসা ও অসীম রহস্য অনুসন্ধানের জন্য নিজের জীবনকেই কী শেষ পর্যন্ত ল্যাবরেটরিতে ঢুকিয়ে দিলেন কায়েস আহমেদ? বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা বা নির্মাণহীন অর্থহীন জীবন টেনে নেবার গ্লানি কায়েসের ছিল না। তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে সৃষ্টির আনন্দে। নিজের সৃষ্টির প্রতি ছিল অপরিসীম দরদ আর সুতীব্র শৈল্পিক দৃষ্টি। লিখে পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরা বা বইয়ের কলেবর বা সংখ্যা বৃদ্ধি করা কট্টর স্বভাববিরোধী কাজ ছিল। এ কারণে দুই দশকের মতো সৃজনকালের মধ্যে ক্ষীণকায় ৪টি গ্রন্থের মালিক কায়েস। ‘অন্ধ তীরন্দাজ (১৯৭৮)’, ‘দিনযাপন (১৯৮৬)’, ‘নির্বাসিত একজন(১৯৮৬)’, ‘লাশকাটা ঘর (১৯৮৭)’ এবং সম্প্রতি আবিষ্কৃত, অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত রোগা উপন্যাস ‘কতিপয় মৃত স্বপ্নের চোখ’। প্রায় অনুল্লেখ্য কয়েকটি কবিতা ও প্রবন্ধ আছে। এই স্বল্পপুঁজির সৃষ্টিকর্মই কায়েস আহমদকে বাংলা কথাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান দিয়েছে। স্বাতন্ত্র্যই একমাত্র কারণ। লেখক হিসেবে কায়েস আহমেদের স্বতন্ত্র একটি পথের সন্ধান পেয়েছিলেন। অসময়ে চলে যাওয়ায় পথ খুব বেশি দূর এগোয়নি। লেখক সত্তার পূর্ণ বিকাশ হয়নি। তারপরেও বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে কায়েস আহমেদের স্বাতন্ত্র্যের স্বীকৃতি সর্বমান্য।
বিশ শতকের পঞ্চাশ থেকে আশি এই চার দশকের দশকের জাতীয় জীবনের ভাঙা-গড়ার ইতিহাসের সাথে গড়ে উঠেছে কায়েস আহমেদের শিল্পীসত্তা। দেশভাগ, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইাতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃতির অবিশ্বাস্য পরিবর্তন তাঁর শিল্পীমানসকে রক্তাক্ত ও জিজ্ঞাসু করে তুলেছিল। বিশেষত, দেশভাগজনিত সৃষ্ট মানববিপর্যয় এবং ব্যক্তিজীবনে দেশহারা হবার বেদনা কায়েস আহমেদকে বহুলাংশে অতীতমুখী করেছে। তিনি আজীবন নিজেকে উন্মুল উদ্বাস্তুই ভেবেছেন। পাকিস্তান আমলে পিতার মৃত্যুর খবরে পাসপোর্ট করতে গিয়ে জানেন, তিনি পাকিস্তানের নাগরিকই নন। বস্তুত, কিশোর বয়সে দেশহারা কায়েসের মনোজগতে নিজের বাস্তুভিটা ও হুগলির স্মৃতি কখনোই ম্লান হয়নি। বরং তাঁর লেখার জায়গা-জমিনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে ঐ জনপদের মানুষের জীবনযাপনের বাস্তবতা। এই বাস্তবতা নিরেট বাস্তবতাই, ভক্তি, সম্মোহন বা আবেগের তিলবিন্দু স্থান নেই। নির্মিত চরিত্রগুলোর মধ্যে প্রায়শ নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ দেখতে পাই, যে রূপ আমাদের তথাকথিত সম্ভ্রম বা সম্মানের খুঁটিকে উপড়ে ফেলার জন্য টান মারে। মানুষের জন্য মানুষ, এই বিশ্বাসকেও এককোপে কয়েক খণ্ড করে আলগোছে আমাদের সামনে ফেলেন কায়েস। শ্বাসশূন্য জীবনের ভেতরে বাতাস প্রবেশের সব রাস্তাই বন্ধ। আমাদের লাশকাটা ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে প্রহরী দায়িত্ব পালন করেন কায়েস নিজে। লাশের ময়নাতদন্তের ভয়ঙ্কর বীভৎস দৃশ্য ও রক্তপাত দেখতে আমরা তখন বাধ্য। মানুষের প্রতি, সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের সমস্ত অঙ্গীকার বা দায়বোধের ভেতরে লুকিয়ে থাকা স্বার্থপরতা, কৃতঘ্নতা, ভণ্ডামী, প্রতারণা, বর্বরতার ছবি কাটা লাশের মতোই আমাদের চোখের সামনে বীভৎস ও ভয়ঙ্কর রূপে উপস্থিত হয়। ।
মোট ৭টি গল্প নিয়ে কায়েস আহমেদের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্ধ তীরন্দাজ’। ‘অন্তর্লীন চখাচখী’, ‘যাত্রা’, ‘বন্দী দুঃসময়’, ‘খণ্ড রোদে শালিক ফড়িং’, ‘বিবমিষা’, ‘অন্ধ তীরন্দাজ’, ‘সম্পর্ক’, ‘গন্তব্য’—এই গল্পগুলো আধুনিক জীবন ও মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার লেখ্যদলিল। আধুনিক জীবন ও নাগরিক চৈতন্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ নিরাময়হীন রোগের মতো, ইচ্ছে করলেই এর থেকে মুক্তি মেলে না। প্রথম গল্প ‘অন্তর্লীন চখাচখী’র নায়ক পল্টু গ্রামের মেয়ে দোলাকে ভালোবেসে শক্ত বন্ধন গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বস্তুত, পল্টুর অন্তর্গত রক্তের ভেতরে সক্রিয় এই বিচ্ছিন্নতাবোধ। জীবনের অপার ঐশ্বর্য ও মধুময় পৃথিবীর সৌন্দর্য-পিপাসু ও কল্পনা বিলাসী যুবকের মনে অস্থিরতা, হতাশা, ক্লেদ, নিঃসঙ্গতা বাসা বেঁধেছে। এমনি কি মৃত্যুচিন্তার মতো আত্মবিনাশী চিন্তাও উঁকি মারে মনোজগতে। গ্রন্থের প্রথম গল্পেই কায়েস জানিয়ে দিলেন, তাঁর সময়ের ময়নাতদন্তে তিনি কতোটা দক্ষ। সময় যতোটা এগিয়েছে মানুষ তার তুলনায় অনেক পেছনে পড়েছে। অস্পর্শী সময়ের অতলসন্ধানী চরিত্রগুলোকে কায়েস সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছেন। স্বীকার-অস্বীকার, গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে যায় প্রতিটি চরিত্র। ‘যাত্রা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের কোনো নাম নেই। অর্থাৎ বিরূপ বিশ্বে মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন কতোটা খেলু চরিত্রটির নামহীনতাই তার প্রমাণ। কোন প্রকার কার্যকারণ ছাড়াই নামহীন মানুষটি ট্রেন থেকে নেমে পড়ে অচেনা ও অনির্ধারিত একটি স্টেশনে। এই গন্তব্যহীনতা আধুনিক মানুষের ভিন্নতর জটিলতা। কোথায় পৌঁছাবে এবং ঠিক গন্তব্য কোথায় মানুষটি নিজেও জানে না। দুটো বিশ্বযুদ্ধ ও বিজ্ঞানের অভাবনীয় বিকাশ মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীন অস্তিত্বকে এক অর্থে শূন্য ঘোষণা করা হচ্ছে। মানুষের জীবন ও ভাবনার সমস্ত দায় ও দায়িত্ব এখন বিজ্ঞানের কাঁধে। মানুষকে এখন আর কিছুই ভাবতে হয় না। তার কোনো নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই, গন্তব্য নেই। জীবন ছড়িয়ে পড়েছে গন্তব্যহীন বিচিত্র পথের সন্ধানে। কয়েক হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মানুষের সমাজ বা রাষ্ট্র ভাবনাকে দুটো বিশ্বযুদ্ধ এসে এক প্রকার খারিজ করে দিয়েছে। প্রতিটি মানুষ এখন বিশ্বনাগরিক। ব্যক্তির অস্তিত্ব যেখানে স্রেফ ধুলোবালি। ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটিও বৈশ্বিকতার ফাঁদে বন্দি। নিদারুণ এক দুঃসময়ের ফাঁদে পড়েছে মানুষ। এই দুঃসময় যুবসমাজকে অক্টোপাসের মতো চতুর্দিক থেকে আঁকড়ে ধরেছে। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের মানবিক ও সমাজিক বিকাশ। অসীম হতাশায় আক্রান্ত যুবসমাজের মধ্যে প্রবাহহীন নদীর বদ্ধ পানির মতো পচন ধরেছে। তাদের মধ্যে ভালো সুস্থ কোনো চিন্তা বা কাজের তাড়া বা প্রেরণা নেই। কখনো কখনো আত্মপীড়নের মুখোমুখি হয় বটে, কিন্তু এই আত্মপীড়ন স্রেফ পীড়নই থাকে, প্রতিবাদের ভাষা পায় না। ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ গল্পে ভাড়াটে খুনি চারজন সামর্থ্যবান যুবক। তারা মানুষ খুন করে শুধুমাত্র টাকার প্রয়োজনে। ওরা নিজেরাও জানে, মানুষ খুন জঘন্যতম কাজ কিন্তু এ জানাটার কোনো মূল্য নেই। যে সময় বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে এই যুবকেরা, সেখানে মানুষের ভেতরের পবিত্র সুন্দর মানুষের অস্তিত্ব থাকার অর্থই হচ্ছে সময়ের জটিল-কূটিল ফাঁদে আরও জটিলভাবে জড়িয়ে পড়া। সমাজ মানেই মায়া-মমতা, বিশ্বাস-ভালোবাসা, পারস্পরিক নির্ভরতার অঁটুট বন্ধন—এসব অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে বিশশতকের সমাজে। সমস্ত আলো পড়েছে নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, বিবমিষা, বিচ্ছিন্নতা, স্বপ্নহীনতার উপরে। এই সময়বাস্তবতা যুবকসমাজের অস্তিত্বে অপ্ররিাধ্য শক্তি নিয়ে উপস্থিত। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার আর্তিও জোক বা কৌতুক বলে মনে হয়। কোন দিকে তারা যাচ্ছে, গন্তব্য ঠিক কতো দূর, ফেরার সম্ভাবনা অবশিষ্ট আছে কিনা, এসব প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর নেই। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে চলে যাওয়ায় কতিপয় বিবেকহীন, স্বার্থান্ধ, সম্পদ ও ক্ষমতা লোভী মানুষ যুবসমাজের পথনির্দেশক বা জীবন নিয়ন্ত্রণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যুবকরা জানে, যার টাকায় খুন করতে যাচ্ছে সেই মানুষটির তুলনায় যাকে খুন করবে সে ভালো মানুষ। কিন্তু ওদের কিছুই করার নেই। সামান্য কিছু টাকার প্রয়োজনে এই খুনটি করা ওদের জন্য জরুরি। পরপর তিনবার খুন করতে ব্যর্থ হয়ে হতাশা যুবকরা। এই হতাশার ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে যুবসমাজের আত্মপীড়নের পরিষ্কার ছবি।
আমাকে মেরে ফেল আল্লার কসম, তোরা এখানে খুন করে রেকে যা, আর বাঁচতে ভাল্লাগেনা, আমাকে মেরে ফেল্ পচা, তোর পায়ে পড়ি, আমায় …’ ওরা তিনজন থমকে দাঁড়িয়ে যায়, সগুকে দেখে। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকা সগুকে ভারী বিশ্রী দেখাচ্ছে। চাঁদের দিকে মুখ তুলে অবিকল একটা ঘোড়া চেঁচাচ্ছে যেনো। তবু পচা, নিতাই কিংবা নাড়ূ কেউ কোন কথা বলতে পারে না। সমস্ত মাঠটা ওদের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে থাকে।
নিতাই, নাড়ু, সগু, পচা এই সব ভাড়াটে খুনি যুবকরাই আমাদের জীবন, সমাজ, দেশ বিনির্মাণের মূলশক্তি। কিন্তু এই শক্তি এখন পতনশীল, পচনশীল। এই শক্তির দ্বারা নতুন মানুষের নতুন সমাজ প্রত্যাশা করা অর্থহীন। ‘বন্দি দুঃসময়’ গল্পে যুবসমাজের অস্তিত্বহীনতার প্রতীক হিসেবে সঙ্গমকে তুলে ধরা হয়েছে। এই মানুষের আর কিছুই করার নেই সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে সন্তান উৎপাদনের মতো ভয়ঙ্কর কাজটি করা ছাড়া। ভয়ঙ্কর বলছি এ কারণে, যে নবজাতক আসবে, সেও একই দুঃসময়ের ফাঁদে বন্দি হয়ে একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। জীবনের অস্তিত্বহীনতা ও অর্থহীনতার চূড়ান্ত এক দৃষ্টান্ত এই গল্পটি। ‘গন্তব্য’ গল্পে ধর্ষণরত যুবতীর মুখে থুতু ছিটিয়ে হত্যা করে চাকরিচ্যুত হতাশাগ্রস্ত এক যুবক। জীবনের অস্তিত্বহীনতা বা অর্থহীনতা কতোটা গভীর খাদে নেমে গেলে একজন যুবক এতোটা আদিম রূপ ধারণ করতে পারে, ভাবা যায়! এই দৃষ্টান্ত আরও শক্তিশালীরূপে উপস্থিত ‘বিবমিষা’ গল্পে। গল্পটির নামকরণেই জীবনের চরম অর্থহীনতাকে নির্দেশ করে। বাস্তব প্রয়োজনের তুলনায় অতি তুচ্ছ আয়ের জীবনকে সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে ভয়াবহ সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, এমনকি সঙ্গমের মতো স্বাভাবিক কাজটিকেও ছাড় দিতে হয়। এই রকম অল্প আয়ের মানুষকে দিনশেষে নিজগৃহে ফিরতে হয় ফেরারি আসামীর মতো ভয় আর জিজ্ঞাসাচিহ্ন বুকে নিয়ে। অর্থহীন জীবনকে টেনে নেবার গ্লানিতে পা দুটি পাথরের মতো ভারী হয়ে ওঠে।
শালিক-ফড়িংয়ের জীবনের মতো ভাষাহীন চিন্তাহীন সৃষ্টিহীন মানুষের অস্তিত্ব এখন বাতাসে উড়ে। ‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা’— জীবনানন্দীয় ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে ‘খঞ্জ রোদে শালিখ ফড়িং’ গল্পটিতে। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার আত্মহত্যাপিয়াসু মানুষটি ঠিক কী করণে আত্মহত্যার জন্য এতোটা অস্থির আমরা জানি না। এরকম কার্যকারণহীন একটি আত্মহত্যা ‘বিবমিষা’ গল্পটির বিষয়। বিপন্ন প্রজাতির প্রাণির মতো আধুনিক বিশ্বে মানুষের অস্তিত্ব এতোটা বিপন্ন আর অর্থহীন যে, বাঁচা-মরার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। মৃত্যুর কোনো কারণ নেই। বরং বেঁচে থাকাটাই একটা বিস্ময়। ‘রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি’ মৃত্যুই স্বাভাবিক।
কায়েস আহমেদের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘নির্বাসিত একজন’-এ দুটি গল্প ‘নির্বাসিত একজন’ ও ‘জগদ্দল’। তৃতীয় গল্পগ্রন্থ ‘লাশকাটা ঘর’-এ ১৪টি গল্প—‘পরান’, ‘মহাকালের খাঁড়া’, ‘দুই গায়কের গল্প’, ‘নিয়ামত আলীর জাগরণ’, ‘লাশকাটা ঘর’, ‘গগণের চিকিৎসা তৎপরতা’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’, ‘নিরাশ্রিত অগ্নি’, ‘প্রতীক্ষিত লণ্ঠন’, ‘গোপাল কামারের তলোয়ার’, ‘নচিকেতাগণ’, ‘প্রতারক জোস্না’, ‘ফজর আলীর গল্প’ ও ‘পারাপার’।
বৈরী সময়ের ফাঁদে পড়া মানুষের জীবনের অস্তিত্বের সংকট, অর্থহীনতা, লক্ষ্যহীনতা, বিচ্ছিন্নতা, ভেতর-বাইরের অবক্ষয়, মৃত্যুচিন্তা, নস্টালিজিয়া কায়েস আহমেদের প্রথম গ্রন্থ ‘অন্ধ তীরন্দাজ’-এর গল্পগুলোর বিষয় হয়েছে। কাল-বাস্তবতার সাথে জড়িয়ে থাকা এসব অনুষঙ্গগুলো তাঁর ‘নির্বাসিত একজন’ ও ‘লাশকাটা ঘর’ গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোরও বিষয় কিন্তু এই বিষয় হওয়ার মধ্যে পার্থক্য ঘটেছে। ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ গল্পগ্রন্থের প্রতিটি চরিত্রই অসীম হতাশায় নিমজ্জিত, দিশেহারা, গন্তব্যহারা। দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের আর তেমন কিছুই করার নেই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা ব্যক্তিগত ক্রোধ-ঘৃণা বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশেও কুণ্ঠিত। ভেতরে ভেতরে তারা এতোটা ভঙ্গুর, ক্ষয়িষ্ণু। বাস্তবে, তারা যে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত এবং ক্রমশ বিনাশমুখী, এই বোধের ছিটেফোঁটাও তাদের মধ্যে নেই। আত্মজিজ্ঞাসাহীন, প্রতিবাদহীন পরিস্থিতিকে নির্বাক্যে মেনে নেয়া ও মানিয়ে নেওয়া নির্বাক প্রাণিবিশেষ। যে রাজনীতি, সমাজ-অর্থনীতি তাদের জীবনযাপনের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে ফেলছে, সেদিকে তাদের সামান্য ভ্রূক্ষেপ নেই। প্রথম গল্পগ্রন্থের এই অসম্পূর্ণতার কারণ তরুণ লেখকের অভিজ্ঞতার ঘাটতি। এসব মানুষের বাঁচা-মরা, জীবন-জীবিকার সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, শোষকশ্রেণির ক্ষমতা ও অর্থনীতির সমৃদ্ধি জড়িত, এই সংযোগ প্রতিষ্ঠা করতে কায়েস আহমেদ ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন ‘নির্বাসিত একজন’ ও ‘লাশকাটা ঘর’-এর গল্পগুলোয়। অধিকাংশ গল্পের চরিত্ররা নিষ্পেষণ ও নির্যাতনের স্বরূপ উপলব্ধি করে শোষক ও শোষণের প্রকৃত চেহারা বুঝতে পারে। এই বুঝে ফেলাটাই শেষ নয়। নিঃস্ব বঞ্চিত অসহায় মানুষগুলো এবার প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পেয়েছে। এরা আর নীরব নির্বিকার নয়, ঘাড়গুঁজে নিয়তি বলে সব কিছু মেনে নেয় না। সামর্থ্য না থাকলেও শক্তিশালী শোষিতের মুখোমুখি দাঁড়ায় অন্তত। সময়ের অভিঘাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, লড়াই করে, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও কায়েসের চরিত্রগুলো সাধ্যমতো লড়াকু। অর্থাৎ লেখক হিসেবে কায়েস আহমেদ পরিণত হচ্ছেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ও শোষণের অন্যান্য আন্তঃসম্পর্কগুলো তাঁর গল্পের চরিত্র নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়েছে। দেশভাগের ষড়যন্ত্র, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, সংখ্যালঘুর আত্মপীড়ন ও নকশালবাড়ি আন্দোলনের মতো বিষয়গুলো কীভাবে নিরন্ন অসহায় সাধারণ মানুষের জীবনে অলঙ্ঘনীয় অভিশাপ হয়ে ওঠে, কায়েস আহমেদ তার প্রতিটি গল্পের চরিত্রায়ণে লাশের ময়নাতদন্তের মতো উপস্থাপন করেন।
সম্পূর্ণ সাজানো একটি নাটক তৈরি করে দেশভাগের মতো ভয়ঙ্কর খেলা খেলেছে ক্ষমতাপ্রিয় যে সকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তারা বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তথা জনজীবনের বাস্তবতার কথা ভাবেন নি। ভাবেননি, সাধারণ মানুষের জীবনে কী অবিশ্বাস্য দুর্গতি বা বিষময় পরিণত ডেকে আনবে ধর্মের নামে এই বিভক্তি? দেশভাগের রাজনীতি এবং দেশভাগ জনগণের মধ্যে শুধু বিভেদই সৃষ্টি করেনি, চিরকালের জন্য পরস্পরের শত্রুতে পরিণত করেছে। দেশভাগ ও দাঙ্গার ভয়াল গ্রাসে কোটি কোটি মানুষ দেশ হারিয়ে বাস্তুভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে উদ্বাস্তু হয়ে নির্বাসিত জীবনের অভিশাপ বহন করে চলেছে। এই অভিশাপের সঙ্গে যোগ হয়েছে সংখ্যালঘু হওয়ার অভিশাপ। ‘নির্বাসিত একজন’ একজন গল্পের বিষয় দেশভাগের ট্রাজেডি। ‘রিফিউজি হবার স্বাধীনতা’ মানুষকে শুধু রিফিউজি করেনি, ধর্মীয় দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে খুন করার মতো পাশবিকতায় লিপ্ত হয়, যার নৃশংসতা ও বর্বরতা বন্যপশুকেও হার মানায়। অর্থহীন স্বাধীনতার ফাঁদে পড়া মানুষ খোকা এই গল্পের নায়ক। দাঙ্গাবাজরা ওর মাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে বোনকে আহত করে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃস্ব অসহায় করে ফেলে। বিপরীতে দেখা যায়, বোন সম্পর্কে কুৎসিত মন্তব্য করায় আজন্ম প্রতিবেশি অজিত নামে এক হিন্দু যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে খোকা নিজে। এমন তুচ্ছ কারণে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটার কথা ছিল না। বস্তুত, দেশভাগ ও দাঙ্গা খোকাকে আততায়ী বানিয়েছে। হাসান আজিজুল হকের ‘পরবাসী’ গল্পে ঠিক একই দৃশ্যে দেখি। হিন্দু দাঙ্গবাজরা মাথার সিঁথিতে সিঁদুর লেপে মিছিল করে এসে সম্পূর্ণ নিরপরাধ দিনমজুরের বশিরের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে স্ত্রী-সন্তানকে পুড়িয়ে কয়লা করে ফেলে। ঐ দিনমজুর সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে দেশত্যাগ করে পাকিস্তানে প্রবেশের মুহূর্তে সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মধ্যে সীমান্তে ধূতি পরিহিত একজন হিন্দুর মুখোমুখি হয়। এই হিন্দু আবার নিজদেশ পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। দেখা যায়, স্ত্রী-সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ স্বরূপ সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বশির। কিন্তু হত্যার পরেই তার বোধোদয় ঘটে, কতো বড় ভুল সে করেছে। বশির নিজেই স্বীকার করে যে সে আর মানুষ নেই।
দেশভাগ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ ও পাকিস্তানি দুঃশাসন বাঙালির জাতীয় জীবনকে শুধুমাত্র দুর্বিষহ বাস্তবতার মধ্যেই ফেলেনি, চতুর্দিক থেকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছিল। এই বাস্তবতা ও অস্তিত্বের সংকট থেকে উত্তরণে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিরাট একটি স্বপ্ন। এই বিরাট স্বপ্নকে বাস্তব রূপে পেতে এমন দৃঢ় প্রত্যয়, মনোবল আর অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিয়ে বাঙালির যমরাজ্য পাকিস্তানে বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। ‘নচিকেতাগণ’ গল্পটি বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন ও মুক্তিযুদ্ধের অনিরুদ্ধ লড়াকু চেতনার অসাধারণ শৈল্পিক প্রকাশ। কোনো প্রলোভনই পুরানের নচিকেতাকে ব্রহ্মজ্ঞান লাভের প্রার্থনা বা বর থেকে বিচ্যুতি ঘটাতে পারেনি যমরাজ। যমরাজ্যরূপী ধর্মরাজ্য পাকিস্তানের ধর্মের প্রলোভন, বর্বর নিষ্পেষণ বা হত্যাযজ্ঞ কোনো কিছুই বাঙালির স্বাধীনতার দাবিকে দমন করতে পারেনি। বিরাট প্রত্যাশা জেগেছিল মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রে প্রত্যেকটি মানুষ স্বাধীন জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা পাবে; ধর্ম বা অন্য কোনো কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি হবে না; নতুন রাষ্ট্র হবে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক; প্রত্যেকটি মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিকাশের সুযোগ পাবে; এসব স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের নামটিই শুধু খোলনচে হয়ে রইল, বাকি সবকিছুই ফিরে গেছে পাকিস্তানি ঐতিহ্যে। বিশেষ করে, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে অঙ্কুরেই বিনাশের মুখে পড়ে। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও মহানায়ককে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে কারণ ছিল এই লক্ষ্য পূরণ। নেতৃত্ব শূন্য রাষ্ট্রের ক্ষমতার দখলে নিল যে শাসকশক্তি, সেই শক্তির আদর্শ ছিল পাকিস্তান, পাকিস্তানি ঐতিহ্য। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীও ধর্মাদর্শকেই জাতীয়তাবাদ ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। খোদ পাকিস্তানিরা যা পারেনি, দেশীয় নব্য পাকিস্তানপন্থিরা তাই করে ছাড়ল। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের বিরাট স্বপ্ন রূপান্তরিত হলো চরম হতাশা, নৈরাজ্য ও অরাজকতায়। বিশেষ করে, যুবসমাজ চরম হতাশায় ডুবে গেল, যারা বাংলাশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন রাষ্ট্র পুনর্গঠনের মূলশক্তি। স্বপ্নদ্রষ্টা যুবকেরা স্বপ্নহীন হয়ে পড়ে। গন্তব্যহীন জাহাজের নাবিকের মতো দিশেহারা একটি প্রজন্মের হাতে নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠে কীভাবে? বস্তুত, পাকিস্তানি ঐতিহ্যপন্থি শাসকগোষ্ঠী অস্ত্র-অর্থ বা অন্য কোনো প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে পরিকল্পিতভাবে এই যুবসমাজকে পচন ও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ‘গগনের চিকিৎসা তৎপরতা’ গল্পটিতে ‘চাঁদের গায়ে দগদগে ঘা’ এবং এই ঘা সারানোর জন্য গগনের চিকিৎসা তৎপরতার মধ্যে যুবসমাজের পচনকে প্রতীকী করেন কায়েস। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বিমূঢ় বাস্তবতায় স্বপ্নহীন যুবসমাজের হতাশা, পতন, অনিশ্চয়তা আর আত্মবিনাশের গভীরতা উপলব্ধি করা যায় ‘জগদ্দল’ গল্পের কয়েকজন যুবকের আলাপচারিতায় :
বাসুর গোঙায়, কি করবি অখন, কইলি না—তার মাথা আবার ঝুঁকে আসে।
—কি করতে চাস, তুই-ই ক
—তরা যা করবি।
দীপক উঠে দাঁড়ায় এবার। বাসুর সামনে একটু নুয়ে জিজ্ঞেস করে, ঠিক?
—বাসু তেমিন মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেই বলে, ঠিক।
—আমরা গাড়ি হাইজ্যাক করুম।
—পারিব না।
—ব্যাংক লুট করুম।
—পারবি না।
—মাইয়া হাইজ্যাক করুম।
—পারবি না।
দীপকের গলা চেড়ে যায়: চিতায় আগুনে ঝাঁপ দিয়া মরুম।
—পারবি না।
ভূপেন ঢুলতে-ঢুলতেই হাসে, বলে, হাত মারুম।
—পারবি, কিন্তু এইখানে না, লোকজনে দেখবো।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে উল্টোপথে চলায় এবং শাসনব্যবস্থায় পাকিস্তানি নীতি গ্রহণ করায় এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। ক্ষেত্রবিশেষে নিজভূমে তারা অবাঞ্ছিত এবং সরকার ও সমর্থকগোষ্ঠীর করুণার পাত্র। তাদের জীবন, সম্পদ, বাস্তুভিটা, এমনকি নারীর সম্ভ্রম পর্যন্ত নিদারুণ অনিশ্চয়তা, ভয়-ভীতি-ত্রাসের ফাঁদে বন্দি। পাকিস্তান আমলে যে সংখ্যায় সংখ্যালঘু দেশত্যাগ করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই সংখ্যা বাড়ে বৈ কমেনি। আবার যারা দেশত্যাগ করছে তারা স্রেফ উদ্বাস্তু। এই সময়-বাস্তবতা ‘পরাণ’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তুভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’, ‘লাশকাটা ঘর’ ‘জগদ্দল’ প্রভৃতি গল্পে উঠে এসেছে। ‘পরাণ’ গল্পের হরেন্দ্র মাঝির জীবনোপলব্ধি আমাদের মর্মাহত করে। অর্থহীন স্বাধীনতা তাকে পাকিস্তান আমলের চেয়ে আরও বিপদে ফেলেছে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পতিত মানুষটি ‘ভগবান কপালে যা রাখছে ওইবো’ বলে দেশত্যাগে অস্বীকৃতি জানায়। তারপরেও অন্তহীন জিজ্ঞাসা, নিরাপত্তহীনতা আর ভয় দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান আততায়ী হয়ে আমৃত্যু তাকে তাড়া করে ফিরবে। এই তাড়া সংখ্যালঘু জীবনের নিয়তি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শেকড়হীনতার যন্ত্রণা আরও স্পষ্টরূপে উপস্থিত ‘লাশকাটা ঘরে’ গল্পটিতে। অস্তিত্বের অস্বীকৃতির মধ্যে মানুষ বাঁচে কী করে? তাই প্রতিমুহূর্তে দেশত্যাগের তাড়া ও ভয় বুকের ভেতরে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তুভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’ গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে পরিদর্শনে গেলও কায়েসের মূল উদ্দেশ্য তৃণমূলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাস্তব পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখা। এই দেখতে গিয়ে মুখোমুখি হন নির্মম বাস্তবতার। এক সময় হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে এখন কয়েক ঘর হিন্দু। তারাও চলে যাবার তাড়ার মধ্যে আছে। যে কোনো মুহূর্তে দখল হয়ে যাবে তাদের বাস্তুভিটা। না গেলে নানা কৌশলে ফাঁদে ফেলে বাধ্য করা হবে দেশত্যাগে।
খেতে খেতেই নাম পরিচয় হলো পরস্পরের। খানিকটা হাসি, খানিকটা হাত বা মাথা নাড়া, ‘কী যে বলেন, না, না আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন’—এই ধরনের দুচারটি বাক্যতে বিমলবাবু সহজ হয়ে আসেন, সন্দেহের পর্দা সরে যায়, ‘কী আর কমু, দ্যাশ-গ্রামের অবস্থা ভালো না, আত্মীয়স্বজন সব ওই পারে, যে কোনদিন চইলা যাইতে পারি, পারি না খালি বাবার জন্য, এমুন বৃদ্ধ, দুর্বল, অক্ষম মানুষ নিয়া এতো দূরের পথ কেমনে যাই, বাবা দেহ রাখলেই যামু গিয়া। কেমনে থাকি কন, নিজের জায়গা জমি তা-ও রক্ষা করা দুষ্কর, জীবনের উপর দিয়াও হামলা গেছে পথে, ঘরে ওইলো ডাকাতি, এমুন কইয়রা ভয়ে ভয়ে মানুষ বাঁচে কেমনে!’ (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে)
জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদে পড়া সংখ্যালঘু মানুষের বুকের ভেতরে সর্বক্ষণ ভয়-আতঙ্ক কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে। ভয়ে-ত্রাসে মানুষগুলো ধীরে ধীরে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পদবাচ্য হারিয়ে ক্রমশ ইতর শ্রেণিতে রূপান্তরিত হয়। সময়-বাস্তবতার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পিত পুরুষের পৌরুষত্বের প্রকাশ ঘটে তখন ভয়াবহ ও কুৎসিত পথে। ক্ষুদ্রায়তনের উপন্যাসে (অবশ্য ছোটগল্পও বলা যায়) ‘দিনযাপন’-এ বাসুদেব যেভাবে স্ত্রী সর্বানীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়, ইতর শ্রেণির প্রাণির সঙ্গমও এতোটা ভয়াবহ ও কুৎসিত হয় না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায়, ‘শুধু বাসুদেব বা সর্বানী নয়, ঐ বাড়ির সমস্ত মানুষ কায়েস আহমেদের হাতের হ্যাঁচকা টানে ইতর শ্রেণীর জীবে পরিণত হয়েছে, তাদের আর মানুষ বলে চেনবার উপায় নেই।’
বাসুদেব এক গলা টেনে এইমাত্র ফিরল—‘আমি বুঝি না, না’?
চোখে জল এসে যায় সর্বানীর। গালের জ্বলুনি মগজ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু সে কোনো কথা বলে না, দু হাতে গাল ঢেকে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথার চুল ভেঙে গড়িয়ে পড়েছে, আঁচল লুটোচ্ছে, এক দিকের স্তনচক্রের আভাস বাসুদেবকে আরো ক্ষিপ্ত করে। ‘আমি বুঝি না, না? রাইত দিন ঠাকুরপো, ঠাকুরপো! ক্যান অতো মাখামাখি ক্যান…’ টলমল পায়ে বাসুদেব এগোয়, আত্মরক্ষার জন্য সর্বানী সামনে ঝোঁকে। বাসুদেব প্রহার করে না, আঁচল ধরে টান দেয়। ‘আঁ’? এই ‘আ’ শব্দটি দিয়ে সে বাক্যটিকে সম্পূর্ণ করে। নিরুত্তর সর্বানী প্রতি মুহূর্তে চপেটাঘাতের আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। বাসুদেব ক্ষিপ্র হাতে সর্বানীর বস্ত্রহরণ করে।
মধ্যম পুত্রটির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, ঘুম চোখে ম্যাড়মেড়ে হলদে আলোয় বাসুদেবের কংসমূর্তি চাপা গর্জন, এবং উলঙ্গ মাতৃদর্শনে সিঁটিয়ে পড়ে থাকে সে।
‘তরে খুন কইরা ফালামু’– বাসুদেব ন্যাংটো সর্বানীকে হ্যাঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসে। অতঃপর ঘাড়ে রদ্দা মারলে সর্বানী তার শরীরে বাসুদেবের প্রত্যাশিত ভঙ্গিটি এলে দেয়। বাসুদেব মেঝের ওপর সর্বানীকে কুকুরের মতো রমণ করে।
বাসুদেবর এই সঙ্গমক্রিয়া পশুত্বকে হার মানিয়েছে। এই সঙ্গম মূলত তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। বাসুদেবের এই ঘৃণা বা অবিশ্বাস সর্বানীর চেয়ে নিজের প্রতিই বেশি। যে কোনো যুদ্ধে বিজয়ের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে শত্রুপক্ষের নারীর সম্ভ্রমহানি ও ধর্ষণ। তাই যুদ্ধের চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় শত্রুপক্ষের নারীকে অধিকারের মধ্য দিয়ে। এই অধিকারের মধ্যদিয়ে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করা হয়। শত্রুপক্ষের নারীগণকে দখলের মধ্য দিয়ে যুদ্ধজয়ের পূর্ণতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাসুদেবও একটি যুদ্ধের মধ্য আছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে বাসুদেব পরাজয় মেনে নিতে রাজি নয়। এই অপারেজয় পৌরুষত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় সর্বানীর উপরে। অস্তিত্ব বিনাশ ও পরাজয়ের মুখে পতিত মানুষটির বিজয়ের এই একটিই জায়গা। এই যুদ্ধক্ষেত্রে তাই এতোটা বলশালী আর আগ্রাসী। দেশভাগের ট্রাজেডির শিকার বাসুদেবের মতো মানুষেরা নিজ দেশে রাতারাতি সংখ্যালঘু হয়ে যে ফাঁদে পড়েছে, সেই ফাঁদ থেকে বেরুবার কোনো পথই খুঁজে পায় না। ধর্মের নামে দেশভাগ হয়েছে বটে, ভারত ও পাকিস্তান বলে দুটি রাষ্ট্র হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের একাংশ বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে, এসবই হয়েছে বটে, বিনিময়ে এই উপমহাদেশের মানুষ হারিয়েছে বিশ্বাস ও মনুষ্যত্বের পবিত্র বন্ধন। ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের হাতে পড়ে সমাজতন্ত্রের বিপ্লব বা অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ সবই নষ্ট হয়েছে। স্কুল মাস্টার ও বামপন্থী রাজনীতির সক্রিয়কর্মী মনতোষ, যে কিনা মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন দেখে আসছে, সেই মানুষটি দেশভাগের পরে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে, ‘এই দ্যাশে মানুষ আছে নাকি! এই সাব-কন্টিনেন্টে মানুষ একটাও নাই, অ্যারা হয় হিন্দু নয়তো মুসলমান, মানুষ কই! মানুষ থাকলে কি দ্যাশ ভাগ হইতে পারতো?’ যে দেশ সংখ্যালঘুদের নিজের নাগরিকই মনে করে না, অবাঞ্জিত অতিরিক্ত মনে করে, দেশত্যাগের জন্য বিচিত্র রকমের পথ উন্মুক্ত রেখেছে, সম্মানের সাথে না গেলে তৈরি করা ফাঁদে ফেলে বাধ্য করছে দেশত্যাগে, অথবা নিজের মাতৃভূমি বলে জোর খাটিয়ে থেকে গেলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা পাচ্ছে, তার উপরে করুণা ও তাচ্ছিল্যের তীব্র বাণ, সেই দেশে মনতোষের রাজনীতি করা দেশ নিয়ে ভাবা অনধিকার চর্চা তো বটে, এক প্রকার হাস্যকরও বটে। তাই স্ত্রী জয়ার তীব্র কটাক্ষের মুখে পড়তে হয় মনতোষকে। ‘থাকি হ্যাকেগো দ্যাশে, হ্যাগো মাথা গরম, কুনসুম কি অয় কওন যায়? আমরা অইলাম গিয়া ইন্দু মানুষ, আমাগো অতো মাথা ব্যথা ক্যান? হ্যাগো দ্যাশ হ্যারা যেম্নে মনে লয় চলোউকগা, তোমার অতো রাজনীতির আউস ক্যান?’ নিজদেশে পরবাসী জীবনের দীর্ঘশ্বাস ও ক্রোধ যুগপৎভাবে ফুটে ওঠে জয়ার কথায়। জয়া নিজেকে শুধু পরবাসী ভাবেনি, অবাঞ্ছিতও ভাবে। দেশ নিয়ে কথা বলার অধিকার পর্যন্ত হারিয়েছে। দেশ মায়ের মতো, সেই মাতৃকুল হারা মানুষগুলোর মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা সত্যিই করুণ। দেশভাগের জীর্ণ মতবাদ ও দেশভাগ শুধুই ইতিহাস হয়ে থাকেনি, কোটি কোটি মানুষকে দেশহারা, বাস্তুহারা ও উদ্বাস্তু করে চিরতরে ভেতরে-বাইরে পঙ্গু ও নিঃস্ব করে দিয়েছে।