নিবেদিতা আইচ

আলমারির পাল্লাটা খুলতেই নেপথলিনের ঘ্রাণ নাকেমুখে হামলে পড়লো। বিয়ের শাড়িটা হয়ত এর মধ্যেই কোথাও আছে। চোখ বুলিয়ে দেখলাম আমি। মেরুন রঙের জমিনের ওপর সলমা জরির কাজ। মনে আছে ওকে সেদিন ছুঁতেও ভয় লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল এ পৃথিবীর কেউ নয় সে, অন্য গ্রহের কোনো মানবী।

প্রায় তিন বছর পর বোধহয় খুললাম আলমারিটা। হ্যাঁ, ওর রোগটা ধরা পড়ার পর থেকে আর হাত পড়েনি এটায়। থরে থরে ভাঁজ করা স্মৃতিরা সব সামনে এসে ভিড় করছে। দ্বিতীয় তাকে রাখা প্রগাঢ় নীল রঙের বালুচরিটা প্রথমবার বেতনের টাকা পেয়ে উপহার দিয়েছিলাম। সহজে পরতে চাইতো না জেসমিন । বলতো— যদি নষ্ট হয়ে যায়, থাকুক না স্মৃতি হয়ে।

গোছানো, পরিপাটি সবগুলো তাক। মাড় দেয়া সুতি শাড়িগুলো একসাথে ভাঁজ করে রাখা। সিল্ক আর কাতান শাড়িগুলো রয়েছে অন্য তাকে। কিছু শাড়ি খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রোল করে রাখা আছে। শেষদিকে জেসমিন এসব আর পরতে চাইতো না। রঙচঙে দামী শাড়িগুলো একে একে মেয়েদের দিয়ে দিয়েছে। এই নিয়ে আমি রাগ করতাম আর জেসমিন মুখ টিপে হাসতো। বলতো এমন ছেলেমানুষ তুমি! লোকে কী বলবে? এ বয়সে মানায় নাকি এসব!

এ সংসারটাও এমন পরিপাটি ছিল একসময়, সাজানো, ঝকঝকে তকতকে ঘরদোর ছিল আমাদের। জেসমিন যেদিন বিছানায় পড়লো সেদিন থেকে ঘরকন্নার দায়িত্ব এলো আমার হাতে। ব্যস, এরপর থেকে এমন লক্ষ্মীছাড়া দশা।

সকালবেলা শ্বশুরবাড়ি থেকে ছোট মেয়ে ফোন করেছিল। দুদিন পর ওদের ফেরার ফ্লাইট। ওর তাড়া খেয়েই তো আলমারির চাবিটা খুঁজে বের করতে হলো। একতাড়া গোছার মাঝ থেকে প্রতিটা চাবি তালায় ঢুকিয়ে চেক করতে হলো।

ওদিকে বড়মেয়ে দু’দিন ধরে বলছে কাঁসার থালাবাসনগুলো ওর চাই। জেসমিন কোথায় সেগুলো তুলে রেখে গেছে তার আর হদিশ পাইনি। ওদের অস্থিরতা দেখে কদিন ধরে সারাঘর তোলপাড় করেছি। আজ সন্ধ্যায় আসবে ওরা। মায়ের পুরনো জিনিসপত্র ভাগ বাটোয়ারা হবে দু’বোনের মধ্যে৷

খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে কিছু অপ্রত্যাশিত জিনিসও বেরিয়ে এলো। পানের বাটাটা বের হলো সবচেয়ে নিচের তাক থেকে। একটা সময় এত বেশি পান সুপারি খেতে শুরু করেছিল জেসমিন। সেই তো কাল হলো। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে বলে দিল মুখের আলসারটা আর সুস্থ হবার পর্যায়ে নেই, রক্তের স্রোতের সাথে ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের আরো কিছু অংশে।

তবু আমি চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। অপারেশনের পর কেমোথেরাপিও চললো। যখন যা দরকার সবই করছিলাম শুধু ওর কষ্টটা চোখে দেখতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় যখন শরীরটা নীল হয়ে আসতো আমার মনে হতো কোনো এক জাদুবলে ওর সবটুকু কষ্ট আমি নিয়ে নিই। আমি ওর কাছে গেলে, হাত ধরে পাশে বসলে দূরে সরে যেতো। রাতে একই বিছানায় শুতে দিতে চাইতো না। বলতো— তোমারও হবে।

কত বোঝাতাম। ক্যান্সার ছোঁয়াচে রোগ নয়। তবু জেদ করতো। কখনো আমি রাগ করতাম, বলতাম তবে আমারও হোক, তোমার যন্ত্রণা সব আমারই হোক, তবু তোমার একটু আরাম হোক। আমি অনর্গল বকতে থাকতাম আর ওর চোখ দিয়ে টুপটাপ জল গড়াতো।

এভাবে সাত আট সাইকেল কেমোথেরাপি চলবার পর মনে হলো ওর শরীর আর ধকল নিতে পারছে না। কয়েক ব্যাগ রক্ত দেবার পরেও অ্যানিমিক হয়ে পড়ছিল সে। আমি ধীরে ধীরে হাল ছাড়ছিলাম। মনে মনে হেরে যাচ্ছিলাম। রক্তে সুগার বাড়ছিল আমারও। হাঁটুতে জল জমছিল। তেল, নুন, মসলার হিসেব রাখতে গিয়ে, চেম্বার থেকে হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে ক্রমশ ক্লান্ত হচ্ছিলাম আমি।

একদিন রাতে ওর পাশে শুয়েছি। কেমোথেরাপি দিয়ে আগের দিন বাড়ি ফিরেছে জেসমিন। নির্জীব হয়ে শুয়েছিল বিছানায়। ভেবেছি ঘুমিয়ে গেছে। বাতি নেভাতেই কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো— অনেক হয়েছে, আমাকে এবারে যেতে দাও, একটু শান্তি চাই আমি।
সে রাতে আর ঘুম হয়নি আমার। ওর এমন আকুতি এর আগেও শুনেছি। কিন্তু সেদিন কেন জানি না কেমন অন্যরকম লাগছিল সব। আমি সেদিন বুঝেছিলাম আজ হোক আর কাল, ও চলে যাবে। ও চেয়েছিল। আমিও কি চাইনি!

ঐ মুহূর্তটার কথা ভাবতে গেলে এখন দমবন্ধ লাগে আমার। এই ঘরটা যেন চারদিক থেকে গিলে খেতে আসে আমাকে। ছুটে বেরিয়ে পড়ি কোথাও, খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিই। মেয়েরা এলে বাড়িটা প্রাণ পায়। সময় উড়ে উড়ে চলে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও এসব কথা ভুলে থাকি।

আজ ওরা মায়ের কথা মনে করে করে খুব কাঁদলো। বিয়ের শাড়িটা পেলো না বলে ছোটটা যাবার সময় আফসোসও করলো। আমার ওপর আস্থা রাখতে না পেরে নিজে একবার আলমারিতে তল্লাশি করেছে। বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদায় দিলাম ওকে।

সবাই চলে গেলে ঘরদোর বন্ধ করে আগে আগে শুয়ে পড়লাম আমি। বাতি নিভিয়ে বিছানায় গেলাম। জানি না ঘুম আসবে কিনা। তবু চেষ্টা করা চাই। বালিশের তলায় হাত রাখতেই সলমা জরি শাড়িটা আমার আঙুল ছুঁয়ে গেল।

আমি ফিসফিস করে বললাম— জেসমিন, তোমাকে যেতে দিলাম, এখন ভালো আছো তো?

সেদিন এ বালিশটাই ওর মুখের ওপর চেপে ধরেছিলাম, একেকটা সেকেন্ড যুদ্ধ করেছি নিজের সঙ্গে, যতক্ষণ অব্দি ওর হাত-পা নিথর হয়ে না-আসে।

বালিশের কভারটা ধুতে দিইনি গত একমাসেও। এখনো ঘুমোতে এলে জেসমিনের ঘ্রাণ পাই এতে।