পাপিয়া ভট্টাচার্য
সেগুন কাঠের পুরোনো পালংকটা খুলে নিয়ে যাবার পর এতবড ঘরখানায় প্রায় হা হা করা একটা শূন্যতা। সেই ফাঁকা ঘরের এক কোনে এক কোনে রাশিকৃত বিছানা বালিশের স্তূপ মাথায় নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সিন্দুকটা। এতক্ষণ যথা সম্ভব গায়ের জোর দিয়ে ওটাকে ঠেলাঠেলি করে সরাবার চেষ্টা করছিল স্বামী স্ত্রীতে, হীরু আর তনিমা।
একসময় হাল ছেড়ে বলল, ‘এ তো নাড়ানোই যাচ্ছে না গো বউদিমণি। একে নামানো আমাদের দুজনের কম্মো নয়। কম করে পাঁচ ছজন লোক লাগবে।’
‘হুম, সেই তো গো। এত কি আছে সিন্দুকটায় বলো তো? ‘ঋতি চিন্তিতভাবে বলল।
হীরু মাথা চুলকে নিল একবার, ‘সে আপনাদের সিন্দুক, আপনারা জানেন নি, আমি কি করে বলি বলুন দিকি।’
অপ্রতিভের মতো হাসল ঋতি, তাই তো! নয় নয় করে বাইশ বছর আগে সে এসেছে এ বাড়িতে। দেশের বাড়ির এই পাঁচ নম্বর ঘরে বছরে দুবার করে আসা তো হয়েইছে। অরিত্রর মা যতদিন ছিলেন, ততদিন তো আরো বেশি। আর এতদিন পরে সে দুম করে এইকথা বলে বসল, তাও একজন বাইরের লোকের কাছে! এখন মনে পড়ল, শাশুড়িমাকে আগে আগে দু একবার দেখেছে, পুজোর সময়ে সিন্দুকের ডালা তুলে কি সব বের করে নিয়ে যেতে। রূপোর বাসন টাসন সম্ভবত। পুজোবাড়ির ব্যস্ততা তখন চরমে, ভালো করে তাকিয়ে দেখার কথা মনেও হয়নি কখনও, কি আশ্চর্য!
এছাড়া বরাবর দেখে আসছে সিন্দুকটা সবসময় পাতলা একটা কম্বল দিয়ে ঢাকা, আর তার ওপর রাজ্যের চাদর বালিশ ব্যাগ জলের বোতল টুকটাক কত কি রাখা থাকে। পুজোর সময় ঘরে আড্ডা বসলে জায়গার অভাবে সে নিজেই তো কতবার সিন্দুকটার একদিকে পা ঝুলিয়ে বসে। তারই কোনোদিন ওই মস্ত একখানা তালা দেওয়া সিন্দুকের ব্যাপারে কৌতূহল হয়নি, আর ওরা স্বামী স্ত্রী তো এই বছর কয়েক হলো দেখভাল করতে এসেছে বাড়িটার, যাকে বলে কেয়ারটেকার, ওদের এতশত জানার কথা কি!
এ বাড়ির লোকজন এক এক করে সবাই এখন বাইরে। পড়াশোনা বা চাকরিসূত্রেই সব বাইরে যাওয়া, সময়ের নিয়মে বাসস্থানও সবারই অন্যত্র হয়ে গেছে। শেষ অবধি ছিলেন অরিত্রর মা। এই একা থাকা নিয়ে রাগারাগি করলে হেসে হেসে বলতেন, ‘তাড়া কিসের, না পারলে তো যেতেই হবে।’
শক্তপোক্ত মানুষ, বয়সও সত্তর ছুঁল না, হঠাৎ একদিনের স্ট্রোকে চলে গেলেন। সেও বছর দুয়েক হলো। এখন পুজো বা বিশেষ কোনো সময় ছাড়া সারা বছর গ্রামের এই বাড়ি ফাঁকাই পড়ে থাকে। এত বড় বাড়ি পরিষ্কার আর আগলে রাখার জন্যে ওরাই আছে শুধু। তালা বন্ধ ঘরের সিন্দুক বৃত্তান্ত ওদের জানার কথা নয়।
দেওয়াল জুড়ে থাকা কাঁচের আলমারি থেকে ঠাকুরের কাঁসার বাসন, শ্বেত পাথরের দুটো থালা, সেই সঙ্গে পেতলেরও কিছু, ধুনুচি, পঞ্চপ্রদীপ জাতীয়, যা চট করে বের করতে হয় বলে এখানে থাকে, সেসব তনিমার হাতে দিল ঋতি। ‘সাবধানে নিয়ে যাও। আপাতত ঠাকুর দালানের তাকেই থাক। পুজোর সময় এসে সবাই মিলে ঠিক করা যাবে কোথায় কি রাখা হবে। সিন্দুকটাও নয় ওঘরেরই একপাশে থাকবে এখন।’
‘তাহলে আর কিছু নেই তো বউদি? ‘হীরু বলল। ‘এই তোষক টোষক সব পরে এসে নামিয়ে নিয়ে যাব’খন আমি। বাবরদা একটু পরেই আলমারির পাল্লা টাল্লাগুলো খুলতে আসবে !’
‘আজই? সন্ধ্যে হয়ে এল তো!’
‘এতগুলো ঘর তো বউদিমনি। কত জিনিস বলুন দিকি। আস্তে আস্তে গুছিয়ে রাখতে তো হবে। হাতে মোটে দুটি দিন সময়। শনিবার সকালেই তো সব মিস্ত্রী মেশিনপত্র চলে আসবে।’
জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে তনিমা বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, ‘আপনিও আর থাকবেন নি দিদিভাই, নেমে আসুন। ঘরের যা অবস্থা! কখন যে কি হয়!’
বিকেল পড়ে আসছে। পশ্চিমের জানলায় শেষ বেলার নরম একটা আলো। জানলা ঘেঁষে থাকা ঝাঁকড়া গন্ধরাজ গাছটার ছায়ায় আরো তাড়াতাড়ি অন্ধকার নামছে ঘরে। ‘এক্ষুনি আসছি’ বলেও কতক্ষণ হয়ে গেল চওড়া জানলাটায় বসে আছে ঋতি। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ মানে চৈত্রমাস শুরু হয়ে গেছে। এখনও গ্রামের বাতাসে হালকা সিরসিরে ভাব এই শেষবেলায়। বাইশ বছর ধরে যতটা না এই সংসার, মনে হয় এই ঘর, এই চওড়া জানলাটা তারও কিছু বেশি তার কাছে। যখনই সে দেশের বাড়ি আসে, সব কাজের ভেতর ছটফট করে কখন এই জানলাটায় এসে বসবে একা।
গতবারই তো রাত সাড়ে বারোটায় সন্ধিক্ষণ পড়ল, সব কাজ মিটতে রাত আরো গড়িয়ে প্রায় শেষের দিকে। সন্ধিপুজোর পর বাড়ির সারাদিনের উপোসী এতগুলি মানুষের সরবত জল খাবার দেওয়া, চামুণ্ডা স্তব পাঠের উত্তেজনায় গলা ভেঙে ফেলা পুরোহিত তন্ত্রধারকদের গরম আদা ঘির ব্যবস্থা, তার সঙ্গে দালান ভর্তি প্রসাদ বিলি… সব মিলিয়ে বিশাল এক পর্ব। একসঙ্গে হুড়মুড়িয়ে লাইন দিয়ে খেতে বসছে সবাই, দম ফেলার ফুরসত নেই। মাঝ রাত্রির সন্ধিপুজো দেখতে সুন্দর, কিন্তু দিনটা পার করা বাড়ির লোকেদের কাছে মস্ত চিন্তার।
এই জানলায় তারপরও ভোর অবধি বসে ছিল সে। একটাই সুবিধে যে দেশের বাড়িতে এলে সে এঘরে একলাই থাকে। ছেলেরা সবাই প্রায় বাইরের টানা দালানের ঢালা বিছানায়। বছরে এই একবারই সবাই একসঙ্গে হয়, ফলে জ্যেঠতুতো খুড়তুতো ভাইরা মিলে অনেক রাত্রি অবধি আড্ডা দেয়।
এই বেশ ভালো, অরিত্র থাকলে বিরক্ত হতো। তাদের বাইশ বছরের নিঃসন্তান দাম্পত্য জীবনে ওই একটা অনুভূতিই প্রবল, বিশেষ করে তার প্রতি অরিত্রর। কেউ ভুল বা ঠিক নয়, শুধু একটা সম্পর্ক ধরে রাখে যে বোঝাপড়া, সেটাই তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে নি কোনোদিন। সে চুপ করে দেখছিল দূরের মাঠে এখানে ওখানে হঠাৎ হঠাৎ ঝিকিয়ে উঠছে আলো। লোকে বলে যে জলাজমিতে নাকি আলেয়ার আলো ছুটে বেড়ায়, সত্যি কি! নাকি উল্কার খসে পড়া! এসব ভেবে কাঁটা দিচ্ছিল গায়ে, প্রতি রাতেই দেয়। তখন জানলার পাশেই জমাটবাঁধা অন্ধকার হয়ে গাছগুলো তাকিয়েছিল তার দিকে, মাঝে মাঝে ডাল নাড়িয়ে ঠান্ডা বাতাস দিয়ে ক্লান্তি মুছিয়ে দিচ্ছিল। তার একটা ভুলভাল বিয়ে যে বহুবার ভেঙে যেতে যেতে টিকে গেল এতদিন, ঋতির তো মনে হয়, তার পেছনে এই বাড়ি আর এই জানলার একটা বিশাল ভূমিকা আছে। কেউ যদি তাকে জিগ্যেস করে, সে নির্দ্বিধায় বলবে তার যা কিছু জড়িয়ে থাকা, যতটুকু টান, সব এই সাতপুরোনো বাড়িটার সঙ্গে। সেও থাকবে না আর।
এখন গন্ধরাজের ডালটা ঢুকে পড়েছে জানলা দিয়ে, পাশেই উঁকি দিয়ে দেখছে আমলকি গাছটাও। দুটো গাছেই অজস্র নতুন নরম কচি কচি পাতা, ওদের বাসন্তী সাজ শুরু হয়েছে। আহ, গন্ধরাজের বাড়ানো হাতটা ছুঁল ঋতি। কিছুতেই সে তাকাতে পারছে না ওদের দিকে, কি এক অপরাধবোধে, লজ্জায় সরিয়ে নিচ্ছে চোখ। এইসব গাছ তার হাতে লাগানো। গাছ লাগাতেই সে ফি বর্ষায় একবার গ্রামে আসে, কখনও একা একাই৷
একটু আগেই ঋতি হীরুকে জিগ্যেস করছিল, ‘আমার এই গাছগুলো, হীরু?’
হীরু মুখ নিচু করে বলল, ‘কি করবেন বলুন।’
পাঁচ নম্বরের জানলার পাশের এই গাছগুলো পেরিয়ে তীর্থসায়রের ঘাট, তার ওপারে আকাশটা যতদূর গোল হয়ে নেমে এসেছে, ততদূর সবুজ ধানক্ষেত। আশ্বিনে পুজোর সময় নীলের নিচে ওই সবুজই সে এত বছর দেখে আসছে। কখনও হালকা নরম সবুজ চারা, কখনও বা ঘন সবুজের মুখে দুধ জমছে সবে। বর্ষা আর শরতের মাঠ যেরকম আলাদা হয়। রথে প্রতিমার কাঠামোয় মাটি পড়া আর পুজো এই দুটো সময় গ্রামের বাড়িতে আসে ঋতি, শাশুড়ি মা চলে যাবার আগে এবং পরেও। সঙ্গে আনে প্রচুর গাছের চারা। পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে সে যেখানে যতটুকু জমি পায়, গাছ লাগিয়ে বেড়ায়। দস্তুরমতো মিটিং করে তাদের সাথে, এবার বৃক্ষরোপণ উৎসব কোথা থেকে শুরু হবে। ‘আজ আমাদের বিক্ষরণ উৎসব,’বলে বাচ্চাগুলোও উল্লাসে হইহই করে ঘোরে তার সঙ্গে। নিজের সন্তান নেই ঋতির, এরাও তার গ্রামে আসার এক আনন্দস্থল। যদিও তার লাগানো সব গাছ বেড়ে উঠতে পারে না, গরু-ছাগলে খেয়ে যাওয়া ছাড়াও সে গ্রাম ছাড়লেই তাদের শরিকদের কেউ কেউ চারাগুলো তুলে ফেলে দেয় শুনেছে।
বাড়িটা কাল সকালে ভাঙা শুরু হবে। প্রায় দুশো বছরের পুরোনো বাড়ি, মাঝে মাঝে এটা ওটা সারানো হলেও শরিকি বাড়িতে যা হয় ‘শুধু পুজোর কটা দিন থাকা তো, যেমন চলছে চলুক ‘করে তত কি যত্ন পেয়েছে ও! ফলে এখানে ওখানে বুড়ো হচ্ছিল আর বুড়ো হলে অবহেলাই প্রাপ্য।
মাসখানেক আগে বাজ পড়ল পুবদিকের ছাদ ঘেঁষা বিশাল শিরীষ গাছের মাথায়। সেইসঙ্গে বিশাল এক ফাট ধরল এক দিকের ছাদে। জোড়া তাপ্পি দিয়ে এ বাড়ি সারিয়ে লাভ নেই, বলে বাড়ির মৃত্যু পরোয়ানায় সাক্ষর দিয়ে দিল সবাই।
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এল ঋতি। সারি সারি ঘরের সামনে লম্বা টানা বারান্দা জুড়ে বিছানা পড়ত পুজোর সময়। কত লোক পুজোবাড়িতে! সব ঘরকে ডাকা হতো নম্বর দিয়ে। এত ঘর দালান সব নিয়ে এত বছর আশ্রয় দেওয়া বাড়িটা এবার সত্যিই অতিবৃদ্ধ হলো তাহলে! আর বুড়ো হলে তাকে সরে যেতেই হয় একদিন না একদিন।
পুরোনো বিশাল চুন-সুরকির এই বাড়ি সারাতে যা খরচ, সারাবছর কিছু না-কিছু লেগেই আছে, তার চেয়ে ছিমছাম কয়েকটা নতুন ঘরের দোতলা করে নেওয়া অনেক ভালো, আলোচনায় বসে বলল সবাই।
আর মাত্র কদিন পরেই সেই বাড়ির সূচনাপর্ব। প্রথমেই পুরাতনকে বিদায় দেবার পালা। ভাড়া করা বিশাল মেশিন আসবে সব সরিয়ে দিতে। কি নাম যেন বলল হীরু, জেসিবি না কি! যাকগে, নাম জেনে কি লাভ, বাড়িটাই যখন রক্ষা করা গেল না!
সিন্দুকের চাবিটা বিস্তর খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না। তখন অবধারিতভাবে ‘অপদার্থ, সংসার করাই উচিত নয় এসব মেয়েদের, আরো কত কি যে নষ্ট করবে’ ইত্যাদি শুনতে হলো ঋতিকেই। অথচ সিন্দুকটার অস্তিত্বই মনে রাখে নি ওরা কেউই।
শেষে তালাবন্ধ সিন্দুক ওদের ভরসায় একই অবস্থায় রইল। গাড়িতে তাদের তুলে দিয়ে তনিমা বলল, ‘কাঁদবেন নি দিদিভাই। আমরা তো এখন থাকি, জানি৷ ছাদ ফেটে জল পড়ছিল কত জায়গায়। ছুঁচো ইঁদুরের বাসা হচ্ছিল। বাজ না পড়লেও এবাড়ি আর কতদিন টিকত ঠিক নেই, হয়তো পুজোর সময় ভরা হাটেই ভেঙে পড়ল। কেলেঙ্কারি কাণ্ড হতো। তার চেয়ে নতুন ঘরবাড়ি হবে ওই জায়গায়, কত সুন্দর লাগবে বলুন দিকি।’
গাড়ি ছাড়ার মুহূর্তে হীরু ছুটে এল, ‘ওরা এসছে দাদা। দরজা জানলাগুলো কিনবে যারা। কথা বলে যান।’
অরিত্র ক্লান্তভাবে হাত নাড়ল, ‘কোনো দরকার নেই। যা করার তোমরাই করো। সব সারা হলে আসছি তো, দেখা যাবে।’
একগাল হাসল হীরু, ‘নিশ্চিন্তে যান দাদা। মেশিনের কাজ তো, দু’চার দিনে হুড়মুড় করে ভেঙে দেবে সব। আপনারা আসার আগেই গারবেজ সব পরিষ্কার করে রাখব’খন।’
ঋতি পেছন ফিরে তাকিয়ে রইল। একসময়ের পূর্বপুরুষের বড় সাধের বাড়ি এখন গারবেজ। তার বুকে তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো কিছু একটা বিঁধে গেল। কি যেন একটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল, কি যেন হলো না। তারপরই খেয়াল হলো। বলা হলো না তো অনেক দিয়েছিলে একদিন, অনেক দুঃখ বেদনার সঙ্গে অনেক হাসি আনন্দ, অনেক জন্ম মৃত্যু, কত উৎসব কত ঘটনার সাক্ষী তুমি, তোমার শুরুর দিন ঘিরে কত লোকজন….! আমরা আসব বলে তুমিই তো অপেক্ষা করতে সারা বছর, সন্তানের জন্যে বাবা মার অপেক্ষার মতো। তোমার শরীর ভেঙে আসছে দেখেও আমরা যত্ন নিই নি, আর এখন কেমন নিঃশব্দে চলে যেতে হচ্ছে। ঠিক যেন এক পরিণত মানুষের জীবনচক্র।
গাড়ি এগিয়ে গেছে অনেকটা। সে সজোরে আঁকড়ে ধরল পাঁচ নম্বরের দেওয়াল। ক্ষমা করো ক্ষমা করো, অনেক দিয়েছ একদিন, আমরা সময় থাকতে বুঝিনি। যাবার আগে ক্ষমা করে যাও। পুরো পথ সে এঘর ওঘর, প্রতিটি দরজা জানলা, টানা দালান যা তারা আর দেখবে না কোনোদিন, সবাইকে আলিঙ্গন দিল, আদর দিল। ফিসফিস করল, যাও এবার, সবাইকেই তো যেতে হয় কোনো না কোনো সময়! কষ্ট পেও না।
মাঝে ছটা মাস কেটেছে। এই কমাসে পৃথিবী আমূল বদলে গেছে। এক ভয়ংকর অতিমারির প্রকোপে দীর্ঘদিন গৃহবন্দী মানুষজন এখনও বাড়ি থেকে বেরোতে তত ভরসা পাচ্ছে না, নেহাত নিরুপায় না হলে। সেই যে তারা ফিরে এল দেশের বাড়ি থেকে, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ ছিল সেটা, নানা জল্পনা কল্পনায় তখনই দূরের কোনো এক অচেনা ভাইরাস ঘুরছিল, সে একবারে দুম করে ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে। মৃত্যুমিছিল, চরম আতঙ্কের মধ্যে থেমে গেল বাইরের জীবন। তার পোশাকি নাম দেওয়া হলো লকডাউন৷ প্রথম কমাসের গভীর উৎকণ্ঠা আর দরজার বাইরেই সেই গুপ্তঘাতকের কড়া নাড়ার আওয়াজের অপেক্ষায় শঙ্কিত থাকার পর খুব সামান্য হলেও যেন একটু ছন্দে ফিরছে জীবন।
দেশ থেকে ফোন এল হীরুর। লকডাউন শুরুর মুখে মিস্ত্রীরা সব নিজেদের বাড়ি ফিরে গেছল, এখন ফিরছে আবার। অনুমতি দিলে বাকি কাজ শুরু করে ওরা। বর্ষাও শেষ হয়ে এল। ঠাকুর গড়ারই বা কি হবে! শ্যাম মিস্ত্রী এসেছিল খোঁজ নিতে। প্রতিমার কাঠামোর জন্যে খড় কিনতে হবে। আপনারা পারলে একবার আসুন।
ছমাস আগে সেইসময় কাজ শুরুর দুদিন পরই সব বন্ধ হয়ে গেছল। আধভাঙা হয়ে পড়ে থাকা বাড়ি আমফানের ঝড়ে বৃষ্টিতে আরো শেষ। এখন আর অল্পই বাকি কাজ, দুচার দিনেই শেষ হয়ে যাবে। জ্যেঠতুতো দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হলো, পরের সপ্তাহেই যাওয়া দরকার।
এতদিন সবার একটা ঘোরের ভেতর কাটছিল। অতিমারির সেই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া জীবনে একটা পুরোনো বাড়ির থাকা না থাকা একেবারেই তুচ্ছ। আজ এই ফোনটা, বিশেষ করে ঋতির মনে আবার আগের বিষাদ ফিরিয়ে আনল। যেন দীর্ঘ দীর্ঘ সময়, কোনো মুমূর্ষু প্রিয়জনের শেষ সংবাদের প্রতীক্ষায় আছে। মাঝের অস্থির সময়গুলো এক মুহূর্ত শান্তি দিচ্ছে না।
সে যখন খুব সাবধানে নিজের আর্জি পেশ করল, তখন অরিত্র প্রথমে স্বভাববিরুদ্ধ শান্ত ভাবেই বলল, ‘এসময়টা তো বেড়াতে যাবার সময় নয়। কোভিড এখন গ্রামে গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে। শুনছি বাইরে থেকে কাউকে আলাও করছে না গ্রামের লোক। খুব সাবধানে যেতে হবে, প্রচুর ঝামেলা হবে, প্রচুর খরচের ব্যাপার। কাজেই দাদা আর আমিই সকালে গিয়ে রাত্রেই ফিরে আসব কলকাতায়।’
এত ভালো কথার পরও ঋতি যখন গুটি গুটি গাড়িতে উঠে বসল, রেগে চেঁচামেচি শুর্য করল অরিত্র, ‘উফফ, সারাজীবন জ্বালিয়ে খেল আমাকে। আরো তো বউরা আছে, সবাই কত সাবধানী, উনি বুঝবেন না! ইচ্ছে করে শয়তানী করছে!’
অন্যসময় এর চেয়ে কম ডোজেই কাজ হয়ে যায়, কিন্তু আজ ঋতি হেসে হেসেই বলল, ‘আমার আর সাবধান হয়ে কি লাভ, মরলে কাঁদারও লোক নেই৷ বরং সেরকম কিছু হলে তোমার একটা উপায় হবে। তাছাড়া পুজোর আগে প্রতিবারই তো একবার আমিই যাই দেশে।’
তারপরও বাছা বাছা শব্দ প্রয়োগ করেছিল অরিত্র, ঋতি মাথা নিচু করে বসেই রইল।
ইঁট-সুরকি সব এখনও সরানো যায় নি। পাহাড় প্রমাণ হয়ে ছড়িয়ে আছে। প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন বিশাল জমিদারবাড়ি ভেঙে পড়ার খবর ছড়িয়ে গেছে আশেপাশের গ্রামেও। এই করোনাকালেও মুখোশ এঁটে বা না এঁটে লোকজন ভিড় করে বাড়ির অন্তিম পর্বের সমাপ্তি দেখতে আসছে। জানলা দরজা থেকে কড়ি বর্গা, কেনার ইচ্ছে নিয়েও বেশ কিছু জন। খবর পেয়ে শ্যাম মিস্ত্রীও সাইকেল চালিয়ে হাজির হয়েছে। প্রতিমা গড়া শুরু করতে আর কত দেরি করবে সে!
দালানের পাশ থেকে শিউলি ফুলের মৃদু গন্ধ ভাসছে হাওয়ায়। এবার মহালয়া কত আগে, মাঝের আশ্বিনে সব শুভকাজ বন্ধ বলে পুজোও হচ্ছে না। কিন্তু প্রকৃতির পাঁজিতে তো মল মাস বলে কিছু নেই, তাই শিউলি তার সময়মতো ফুটে আছে আলো হয়ে।
এতসব আয়োজনের পরও অত বড় জায়গাটা কি যে শূন্য হয়ে আছে! গাড়ি থেকে নেমে ভেঙে ফেলা বিশাল বাড়ি আর এদিকের অক্ষত দুর্গাদালানের মাঝের উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনটি মানুষেরই চোখে জল।
এতদিন অন্য এক ভয়ংকরের মধ্যে এসব মনেই ছিল না, প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটার পর ঋতির খেয়াল হলো, ‘তনিমা সিন্দুকটা কোথায়? দালানে নেই তো? ‘
‘ওই তো উদিকের সদর উঠানে। মেশিনে নামিছিল তো, আর সরানোর টাইম হয় নি।’
এই প্রথম দিনের আলোয় গোটা সিন্দুকটা দেখল ঋতি। গাঢ় সবুজ রঙ, তার ওপর লাল সিঁদুরগোলা দিয়ে স্বস্তি চিহ্ন আঁকার অবশিষ্ট রয়ে গেছে এখনও। ওই স্বস্তি চিহ্ন বলে দেয় এ বাড়িতে এর প্রথম আসার দিনটি কত মধুর ছিল। এখন বাস্তুচ্যুত হবার বিষণ্ণমুখে ভারী তালাটা ঝুলছে।
‘উঠোনে ফেলে রেখেছ কেন! ঠাকুর দালানে রাখতে বলেছিলাম তো!’
তনিমা চুপ করে আছে। ঋতিও থেমে গেল৷ এমনিতেই করোনাকাল সব মানুষকে নানাভাবে ফুরিয়ে দিয়েছে। ছোটখাটো ব্যাপারে এত প্রতিক্রিয়া এখন মানায় না। সব আগের মতো হবে না আর।
‘তালাটা ভাঙতে হবে তো! সিন্দুকটায় হাত বুলিয়ে বলল ঋতি।
তনিমা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, ‘ওরাই নামিছে দিদি, মিস্ত্রিরা। আমি তখন ছিলুম নি। আমরা কেউ ছিলুম নি দিদিভাই। নাওয়া খাওয়া করতে ঘর গেছলুম। কেরেন মেশিন দিয়ে নামাতে গিয়ে পেছনটা একটু ভেঙে গেছে।’
‘হুম। পুরোনো জিনিস, হবেই।’
ঋতি পেছন দিকে ঘুরে গেল এবং আঁতকে উঠল পরক্ষণেই।
হা হা খোলা পেছনটা, ভাঙা। সে বিচলিত হয়ে বলল, ‘কি সর্বনাশ! এ যে পুরো ভাঙা! এরকম হলো কি করে? এই যে এদিকে শোনো একবার! ও দাদা দেখুন! হীরু কোথায়?’
জ্যেঠতুতো দাদা দিব্যেন্দুও দেখে চমকে গেছেন, ‘একি, এ তো পরিষ্কার ভেঙেছে কেউ। ড্রিল দিয়ে ফুটো করেছে মনে হচ্ছে৷ কি ছিল তুই জানিস তো অরিত্র?’
‘না না, আমিও জানি না ঠিক। শুনেছিলাম রূপোর তামার বাসন পত্র ছিল কিছু। চাবি তো মায়ের কাছেই থাকত। মায়ের যে হঠাৎ করে স্ট্রোক হয়ে যাবে ওরকম…! আর ঋতিও একটা ওয়ার্থলেস, মায়ের কাছে জেনে নেয় নি।’
‘তুমিও তো তাই তাহলে। তোমাদের বাড়ি, তোমাদের সিন্দুক, তোমার মা, এত বছরে জিগ্যেস করোনি? ‘ঋতি এবার ফোঁস করে উঠল, উঠোন ভর্তি লোকের কথা খেয়াল না করে। ভাঙা সিন্দুকটা তার ধৈর্য টলিয়ে দিয়েছে।
‘হ্যাঁ এখন আমাদের বাড়ি, আমাদের সিন্দুক! তাহলে পরের বাড়ি ভাঙা হচ্ছিল বলে কেঁদে ভাসাচ্ছিলে কেন! সর্বক্ষণ ভাবরাজ্যে বিচরণ করছেন! ন্যাকামো যত!’
দাদা অরিত্রের পিঠে হাত দিলেন, ‘কি হচ্ছে কি! থাম না। তোরা যখন শেষবার এলি, তখনই তো তালাটা খুলবি। কি? চাবিই খুঁজে পাওয়া গেল না? সে আবার কি? কাকিমা তো আর চাবি কাঠিটা সঙ্গে করে নিয়ে যান নি? অত বড় তালা ঝোলানো পুরোনো লোহার সিন্দুক, লোকের তো নজর পড়বেই। এখন খোঁজ নিতে হবে কি করে কি হলো! হীরু কোথায় গেল?’
চেঁচামেচি শুরু হলো। লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। কিছু তো ছিলই, নাহলে এতবড় লোহার তালা থাকবে কেন! হীরু একবার বলছে কিছুই ছিল নি, একবার বলছে সে থাকেনি তখন। দুচারবার এসব বলে এখন সে থমথমে মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে।
‘কিচ্ছু ছিল না ভেতরে? শুধু শুধুই তালা ঝোলানো অত বড়! হয় কখনও!’
‘আমি কিছু দেখিনি। ‘হীরু রাগ রাগ গলায় বলল। ‘এতমাস ধরে এই ভাঙা বাড়ি পাহারা দিয়ে রাখা চাট্টিখানি কাজ নাকি? আর সে কি আজকের কথা? সেই চোত মাসে যেদিন জেসিবি মেশিন এল, সেদিনই তো। বাবরদারা তো এখনও বলল, কেরেন দিয়ে নামানোর সময় পড়ে পেছনটা অমন গত্তো হয়ে গেছে। দু চারটে কাগজপত্র ছিল, বের করে ফেলে দিয়েছিল। আমি কুড়ি রেখেছি। অধকেরি পাড়ার ছেলেরাও তো তখন কাজ করছিল, ডেকে জিগেস করুন না। সেই থেকে পড়ে আছে।’
সেদিন নামানোর সময় কে কে ছিল, কিছুতেই পরিষ্কার করে জানা গেল না৷ মাঝে দীর্ঘ একটা বিষাক্ত সময় গেছে বা যাচ্ছে। ভাইরাস তো শুধু এই বাড়িকেই খায়নি, গোটা গ্রহ টাকেই প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে৷ এখন সামান্য পুরোনো সিন্দুক নিয়ে বেশি মাথা ঘামানো যাবে না। তারপরও ‘ই কিছু জানে না, উ কিছু দেখে নি, ‘বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা তুলে বেশ একটা রাগারাগি বাঁধার উপক্রম। দেখা গেল এ ব্যাপারে রাজমিস্ত্রী থেকে জোগাড়ে, হীরু তণিমা, সবাই একজোট। সবাই ‘আমি জানি
নি, আমি দেখি নি ‘করে যাচ্ছে। এমনকি দুচার বার বলার পর সবাই হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে, রেগেও যাচ্ছে।
দিব্যেন্দু চোখের ইশারায় একপাশে ডেকে নিল অরিত্রকে। ‘শোন, ঋতিকে বুঝিয়ে বল, এ নিয়ে ঝামেলা করে আর কিচ্ছু লাভ নেই। আমরা না থাকায় ভেঙ্গেছে ওরা। মাঝে এতদিন কেটেছে, এখন স্বীকার করবে কেউ? এসব আগে ভাবা উচিত ছিল। এই করোনা আমফানের পর মানুষের অবস্থা খুব খারাপ। এখন বেশি বললে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হবে। যা-ই থাক, সেসব তো আর পাবই না, মাঝ থেকে বাড়ি এইভাবে ফেলে রেখে মিস্ত্রি মজুররা কাজের লোকেরা সব পালাবে। এরপর বাড়ির কৌলিক পুজোটাও তো তুলতে হবে। এদের সাহায্য ছাড়া পারব? ‘
অরিত্র তাচ্ছিল্যের শব্দ করে বলল, ‘শুনবে ভেবেছ? ঝামেলা পাকানো স্বভাব।’
ঋতি তাও মিনমিন করে বলল, ’না দাদা, পড়ে গিয়ে ওই জিনিস অমন করে ভাঙ্গে কখনও? পরিষ্কার কোনো কিছু দিয়ে ফুটো করা…’
‘বেশ করেছে ‘, এবার অরিত্র রেগে গেছে খুব। ‘দাদা ঠিক বলেছে, যা করার আমরা আসার আগেই করে ফেলেছে, কোনো প্রমাণও নেই কে করেছে। এখন দেখো, সব কাজ টাজ থামিয়ে কেমন জটলা পাকাচ্ছে, এবার বলবে কেউ কাজ করবে না। গ্রামে ঘরেও এখন সব পার্টি। শেষে ক্ষমা চাইতে হবে ওদের কাছে। প্রেস্টিজ বাড়বে ? ‘
‘অত ভারি সিন্দুকের ভেতরে কি ছিল, জানা হবে না কোনোদিন! নিজেদেরই ভুলে। ‘ঋতির প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা, কিন্তু পরিবেশ থমথমে হয়ে গেছে বুঝতে পারছে সেও। বহু কষ্টে সামলে নিল নিজেকে, ‘কই, কোথায় রেখেছ তনিমা, দেখাও তো!’
তনিমা এতক্ষণে ছুটে এসেছে, ‘এই যে দিদিভাই, ঠাকুরদালানে ঝোড়ায় করে। তবে সব ছেঁড়া কাগজ!’
‘হ্যাঁ সব রেখে দিয়েছে তোমার জন্যে, যাও গিয়ে দেখো! কোনো দরকার নেই ওসব ঘাঁটাঘাঁটির, ভেতরের জিনিস হাওয়ায় উড়ে গেল আর এখন উনি ছেঁড়া কাগজ দেখতে চললেন! ‘গলা নামিয়ে বলল অরিত্র, তাকাল কটমট করে। যেন ও বারবারই বলেছিল সেদিনই সিন্দুক খুলিয়ে কিছু করার কথা!
হাঁটু মুড়ে বসে একটা একটা করে দেখছিল ঋতি। কত বছর আগের পুরোনো হিসেব নিকেশের খাতা, অরিত্রের বাবা মায়ের বিয়ের ছবি, গোটা দুই ময়লা ভাঁজ করা কয়েকপাতার পাতলা চটি বইয়ের মতো। ভাঁজে ভাঁজে ছেঁড়া। যারা ভেঙেছে, তারা যা নেবার নিয়ে এগুলো অপ্রয়োজনীয় দেখেই ফেলে গেছে।’
ঋতি পাতা উলটে ঝুঁকে পড়েছে জিনিস কটার ওপর। দেখছে আর মুখটা হাসিহাসি হয়ে যাচ্ছে। দাদা মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘কি, পাওয়া গেল কিছু? কাকু কাকিমার দলিল-দস্তাবেজ নাকি, ঋতি?’
‘হ্যাঁ মস্ত দলিল দাদা। এর বদলে দুচারটে তামা রূপোর বাসন যাওয়া সেরকম ক্ষতি নয়। ‘দুটো প্রায় ঝুরঝুরে চটি বই যত্নে ধরে উঠে দাঁড়াল ঋতি।
‘আমাদের দাদু ঠাকুমা আর বাবা মায়ের বিয়ের সময় লেখা পদ্যের বই। প্রিয়ভাষিণী সুধাহাসিনী মঙ্গল ময়ী, আঁধার ঘরের প্রদীপ করে কত সুন্দর কত আদর করে বধূবরণ! আগে খুব সাবধানে জেরক্স করে নিতে হবে, নইলে পড়া যাবে না।বাড়ির সবার নামে নামে লেখা। ছোটদের নামেও। এই দেখুন দাদা, বড়মা, ছোটমা, ভালোমা, নতুনমা… সবারই কি সুন্দর ডাক! এটা আমাদের সবাইকেই কিন্তু পড়তে হবে। দেখুন, কত সুন্দর করে আমন্ত্রণ জানিয়ে নতুন বউ আনত আগে! অবশ্য তারপরও কত প্রদীপ নিভে যেত! কিন্তু সে তো এখনও যায়, বরং আরো বেশি করে যায়।’
ঠাকুরদালান থেকে নেমে এল ঋতি। অন্যমনস্ক একটু।
‘তবে দেখুন দাদা, এসবের শেষেও কিছু একটা থেকে যেত কিন্তু। একটা বাঁধন, পারস্পরিক একটা নির্ভরতা। এখন সেই ভুলভাল কাঁচা ভাষায় পদ্য লেখা নিয়ে মেতে ওঠা বিয়েবাড়িও নেই। আর বাঁধনও আলগা হতে হতে সবাই যেন বিচ্ছিন্ন পরস্পরের থেকে!’
তারপর কি ভেবে হাসল আবার, ‘একটা কথা বলব দাদা, আপনাকে কিন্তু রাখতেই হবে। আপনি তো সামনের বছর ছেলের বিয়ের ঠিক করছেন। একদম এইরকম একটা কপি আমি আমাদের গীতের বিয়েতে ছাপাব। আপনাদের আমাদের সবার নামে নামে।’
অরিত্র হঠাৎ মনে পড়ার ঢঙে ফিরে এল, ‘একটা জিনিস মনে পড়ল এইমাত্র, সিন্দুকে একটা বিশাল রূপোর চামর ছিল, আমাদের ছোটবেলার মা দুর্গাকে সন্ধিপুজোর সময় ওটা দিয়েই…। হাতলের কাছে ফেটে গেছল, সারানো হয়নি বলে আর বের হতো না। আর একটা রূপোর সাজি, দিদার জিনিস, মায়ের বিয়েতে দিয়েছিল। যাহ, ও দুটো সলিড ছিল দাদা, রূপোর যা দাম এখন!’
‘দাম হলেই বা কি! তুমি কি ওগুলো বিক্রি করতে নাকি? ‘ঋতি বলে ফেলল, আর দিব্যেন্দু ‘একেই বলে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ছিল যখন, গ্রাহ্যও করেনি। সব লোপাট হতে এখন বসে বসে ভাবছে! ‘
তবে অরিত্র এসব কিছুই শুনতে পায়নি। দুটো জিনিস মনে পড়ার পর সে ভুরু টুরু কুঁচকে আরো কি ভাবছে।
তনিমা চা করে এনেছে, বলল, ‘একবার উদিক করে যাবেন নি দিদিভাই? আসল জিনিসই তো দেখলেন নি।’
বাড়ি ভেঙে মিশে গেছে মাটিতে, সিন্দুক ফাঁকা করে দিলে তোমরা, আবার আসল জিনিস! এসব বলতে ইচ্ছে করছিল, না বলে সে চলল তনিমার সঙ্গে। ইঁটকাঠের পাহাড় হয়ে আছে। সেসব সরিয়ে এগোতে এগোতে থেমে গেল ঋতি। হাঁ করে তাকিয়ে আছে একগাদা পাখির কিচিরমিচিরে ভরা গাছটার দিকে। অতিমারির কালে নাকি পৃথিবীটা নিজেকে অনেক শুদ্ধ করে নিচ্ছে।
তনিমা বলল, ‘গন্ধরাজ টাকে বাঁচানো গেল নি দিদিভাই, ঘরের বড় গা ঘেঁসে ছিল। আমলকিটা কিন্তু আমাদের ঘরের লোকের জন্যেই…। মিস্ত্রীদের কত করে বুঝিয়ে, তবে রক্ষে করা গেল। তাই উ দুক্ষু করছিল, বউদিমণির লাগানো গাছ বলে আমি চেষ্টা চরিত্তির করে বাঁচালুম গাছটাকে, আর আমাকেই কিনা সবাই মিলে দুষছে।’
দূরে হীরু মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে। ঋতি যেমন আবেগপ্রবণ, আগের সময় হলে তনিমাকে এক্ষুনি জড়িয়েই ধরত হয়তো, কিন্তু এখন সবদিক থেকেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কাল।
হীরু ওখান থেকেই বউকে বলল, ‘আর বরষা পড়তেই যে গন্ধরাজের চারা একটা লাগিছি, সেটা দেখালে নি?’
তার গলায় গাঢ অভিমান। ঋতি হাসল, ‘তাই, হীরু? তো চলো, কোথাও লাগিয়েছ দেখে আসি।’