রাহুল দাশগুপ্ত
অদ্ভুত একটা বাড়ি। সারাদিন টিভি চলে এই বাড়িতে। রাত বারোটা থেকে ভোর ছ’টা, শুধু এই সময়টুকুই বাদ।
মামাবাড়িতে এলেই এই বাড়িটির ব্যাপারে আমি কৌতুহলী হয়ে উঠি।
একদিন দিদিমার কাছে জানতে চাইলাম, কারা থাকে এই বাড়িতে?
দিদিমা আমাকে খেতে দিচ্ছিলেন। মিহি চালের দুধ সাদা ভাতে নারকেল দিয়ে করা মুগের ডাল ঢেলে দিচ্ছিলেন।
দিদিমার হাতের রান্না যেন অমৃত। যদিও ইতিমধ্যে তিনি সত্তর পেরিয়ে গেছেন। শুধু দিদিমার হাতের রান্না খাওয়ার
লোভেই বারবার আমি মামাবাড়িতে আসতে চাই।
দিদিমা বললেন, একজন বৃদ্ধ। আর একজন বৃদ্ধা।
ওরা সারাদিন টিভির সামনে বসে থাকেন?
কি করবেন? ওদের একমাত্র ছেলে কিছুদিন আগে মারা গেছে। দু’জনেই খুব ভেঙে পড়েছিলেন। এখন কিছুটা সামলে
উঠেছেন। সময় ওদের কাটতে চায়না। তাই টিভি চালিয়ে রাখেন…
সেদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দিদিমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সেই বৃদ্ধার। দিদিমাকে তিনি বললেন, তোমার নাতি
এসেছে বুঝি?
দিদিমা হেসে বললেন, হ্যাঁ।
ভারি সুন্দর দেখতে। ঠিক যেন একটা রাজপুত্র।
দিদিমা মৃদু হাসলেন। খুব বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। বৃদ্ধার ছেলেও খুব রূপবান ছিল। সেকথা তাঁর মনে পড়ল।
ওকে আজ সন্ধায় পাঠিয়ে দিও না। বৃদ্ধা বললেন। আমরা দু’জনে একটু গল্প করবো। বুঝতেই তো পারো, সময় আমাদের
কাটতেই চায়না…
দিদিমা রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, পাঠিয়ে দেব।
দেবে তো? একটু যেন কাতর শোনালো বৃদ্ধার গলা।
চিন্তা করো না। দিদিমা বললেন। আমি বাড়ি গিয়েই বলছি। আধ ঘন্টার মধ্যেই ও চলে যাবে।
বৃদ্ধা আশ্বস্ত হলেন। দিদিমা বাড়ি ফিরে এসেই গোটা ঘটনাটা আমাকে জানালেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমি কি যাবো?
অতি অবশ্যই যাবি। দিদিমা বললেন। আমি কথা দিয়ে এসেছি যে!
তাহলে রেডি হই?
হ। দিদিমা বললেন। মনে রাখিস, ওরা খুব ভালো মানুষ। আর ওদের মনে খুব দুঃখ। একটু আনন্দ পেতেই তোকে কাছে
পেতে চাইছেন।
আধঘন্টার মধ্যেই আমি বৃদ্ধ- বৃদ্ধার বাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমাকে দেখে দু’জনেই খুব খুশী হলেন। আমি আসব শুনে,
বৃদ্ধ নানা রকম মিষ্টি আর বিস্কুট কিনে এনেছিলেন। আর বৃদ্ধা প্লেটে করে সেগুলোর পাশাপাশি নানারকম নাড়ু ও পিঠে
সাজিয়ে দিলেন।
নানা বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম। টিভি কিন্তু চলতেই লাগল। ওরা সাউন্ড কমিয়ে দিলেন। কিন্তু বন্ধ করলেন
না। আর এতে আমি একটু অবাকই হলাম।
খুব নিষ্পাপ ভাবেই জানতে চাইলাম, আপনারা কখনও টিভি বন্ধ করেন না, তাই না?
বৃদ্ধ বললেন, কি করে জানলে?
সবসময় টিভির আওয়াজ শুনি যে…
ঠিক বলেছ। বৃদ্ধ বললেন। অবশ্য ঘুমের সময়টুকু ছাড়া। কেন জানো?
আমি কৌতুহলী হয়ে বৃদ্ধার মুখের দিকে তাকালাম।
টিভির আওয়াজে আমরা ভরসা পাই। মনে হয়, অনেক লোক আমাদের চারপাশে আছে। টিভি বন্ধ হয়ে গেলেই টের
পাই, দু’জনে কতটা একা হয়ে গেছি। সে যে কতটা একা, তোমায় তা বোঝাই কি করে?
সকাল আর রাতে আমাদের টিভিতে শুধু খবরই চলে। আমি আবার বললাম, আর দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সিরিয়াল।
এটা কেন?
শুনে দু’জনেই হেসে উঠল। একে অপরের দিকে তাকালেন। তারপর বৃদ্ধাই বললেন, টিভি দেখা নিয়ে তোমার এই
দাদুর সঙ্গে আমার খুব ঝগড়া। উনি শুধু খবরই শোনেন। আর আমি শুধুই সিরিয়াল দেখি। তাই আমরা সময়টা ভাগাভাগি
করে নিয়েছি।
আমি বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি খবর শোনেন না?
নাঃ। বৃদ্ধা হাসলেন। আমার কোনো আগ্রহই নেই।
আর আপনি? আমি বৃদ্ধর দিকে তাকালাম। সিরিয়াল দেখেন না? একটুও?
বৃদ্ধ বিরক্ত হয়ে বললেন, ধুর। তোমার এই দিদা কেন যে ওসব দেখেন, আমি বুঝতেই পারিনা…
প্রায় ঘন্টাখানেক বসার পর আমি উঠে এলাম। বৃদ্ধ বৃদ্ধার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম, ওঁরা কতটা খুশি হয়েছেন!
বৃদ্ধ বললেন, মাঝে মাঝে এসো না ভাই। কেমন সময় কাটলো বলো তো? এরকম সঙ্গ পেলে সত্যিই সব ভুলে থাকা যায়।
বৃদ্ধা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমরা তোমার অপেক্ষায় থাকব। কেমন? এই বুড়োবুড়িকে ভুলে যেওনা
যেন…
ফিরে আসার পর দিদিমা বললেন, কেমন কাটল?
অপূর্ব। আমি বললাম, ওরা এত ভালো…
দিদিমা বললেন,বলেছিলাম না…
ওদের খুব দুঃখ, তাই না?
হ্যাঁ, রে। ওদের সঙ্গে মিশলেই সেটা বোঝা যায়…
আমি ভেবেছিলাম, কয়েক সপ্তাহ পরেই মামাবাড়িতে আবার আসতে পারব। তখন বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে আবার আমার দেখা
হবে। কিন্তু আমি এলাম প্রায় ছ’মাস পরে।
এবার কিন্তু আমি একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বাড়িতে আগের মতোই সবসময় টিভি চলে, ঘুমের
সময়টুকু ছাড়া। কিন্তু এখন শুধু খবরই চলে। ব্যাপারটা কি?
দিদিমার কাছে আমি জানতে চাইলাম। উনি বললেন, আর বলিস কেন! বৃদ্ধ তো মারা গেছেন…
সেকি! আমি খুবই আহত হলাম। বৃদ্ধের সেই হাসিতে ভরা মুখটা আমার মনে পরে গেল।
কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে তো সবসময় ওদের টিভিতে সিরিয়াল চলার কথা। তার বদলে খবর চলে কেন?
আমার কৌতুহল আরও বেড়ে গেল।
সেদিন বিকেলেই বৃদ্ধার সঙ্গে আমি দেখা করতে গেলাম। আমাকে দেখে উনি ম্লান হাসলেন। তারপর বললেন, উনি তো
চলে গেছেন…
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, টিভিতে খবর চলছে।
আমি জানতে চাইলাম, আপনি এখন আর সিরিয়াল দেখেন না?
নাঃ। বৃদ্ধা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, উনি পছন্দ করতেন না যে…
ও। আমি বললাম। এখন তাহলে সবসময়ই খবর চালিয়ে রাখেন?
হ্যাঁ, বাছা।
কেন? আমি কৌতুহল প্রকাশ করলাম।
উনি পছন্দ করতেন না যে। বৃদ্ধা বললেন। খবর চললেই আমার মনে হয়…
আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
উনি বললেন, তোমার দাদু বোধহয় ঐ চেয়ারটায় বসে আছেন। আর তখন আমার একটুও একা লাগে না।
বৃদ্ধা একটা ফাঁকা চেয়ার দেখালেন।
আগের দিন ঐ চেয়ারেই বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখেছিলাম।
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেদিন আমি ফিরে এলাম।
দিদিমা আমাকে খেতে দেওয়ার সময় জানতে চাইলেন, ওদের বাড়িতে সবসময় কেন এখন খবর চলে, সে ব্যাপারে কিছু
জানতে পারলি?
আমি মিহি, সরু, দুধের মত সাদা ভাত দিয়ে মুগের ডাল মেখে খেতে খেতে বললাম, ওই খবরগুলোই দাদুর স্মৃতি। ভারি
অদ্ভুত উপায়ে দাদুর স্মৃতিকে নিজের কাছে বাঁচিয়ে রেখেছেন ওই দিদা…
তারপর বৃদ্ধার সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সবই আমি খুলে বললাম দিদিমাকে।
ও। দিদিমা বললেন। এবার বুঝেছি, কেন ওই টিভিতে আর সিরিয়াল চলে না।…
সিরিয়াল ওঁকে যে খুব একা করে দেয়, দিদিমা। আর যতক্ষণ খবর চলে, ওই দাদু যে এসে ওঁর পাশে বসে থাকেন…
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন দিদিমা। কিন্তু তাঁর চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল…