মুম রহমান


একটা দরজা, একটাই জানালা। জানালাটা আবার অনেক উঁচুতে। দেয়ালের রং হয়তো এককালে সাদা ছিল, এখন সেটা আন্দাজ করা যায়, এর বেশি কিছু নয়। কেবল একটা চেয়ার আর একটা টেবিল ছাড়া এ ঘরে আর কিছু নেই।
চেয়ারটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে দরজার বাঁ পাশের দেয়ালে। তার একটা পা নেই, তিন পা দেয়ালের দিকে তির্যকভাবে উল্টিয়ে দিয়ে চিত হয়ে আছে সে। অতি সাধারণ একটা চেয়ার, কোনো কারুকাজ নেই। গায়ের রঙটা বোঝা যায় না, তবে কাঠটা দামী।
টেবিলটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ঠিক উল্টোদিকে। টেবিলটা অবশ্য অলঙ্করণহীন নয়। দুটো ড্রয়ার আছে টেবিলটায়, পাগুলোতে লতাপাতার কারুকাজ। পুরুষ্টু কাঠের তৈরি। একটা পুরনোকালের গন্ধ আছে টেবিলটায়।
তুলনায় চেয়ারটা নবীন ও দুর্বল। সত্যি বলতে কি চেয়ারটার জন্যেই মায়া হবে, কেননা তার একটা পা নেই, কেননা তার রং বিবর্ণ হয়ে গেছে, অথচ তার টেকসই হওয়া উচিত ছিল আরো অনেকদিন। কিন্তু কেউ জানে না, কেন চেয়ারটার এ হাল হলো। টেবিলটার আভিজাত্য আছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু একা একটি টেবিল গম্ভীর মুখে বসে আছে ভাবতেই কেমন মন খারাপ হয়ে যায়। কেননা চেয়ার ছাড়া টেবিলটা বড্ড ন্যাড়া লাগে, কিছুটা হাস্যকরও। অবশ্য পড়ে থাকা চেয়ারটাই যে এ টেবিলের জন্য তার কোনো ঠিক নেই। তবু একবার চেয়ারটাকে টেবিলের পাশে বসিয়ে দেখা যেতো। কিন্তু সেটাই বা কে দেখবে?
কে যাবে চেয়ারটাকে টেবিলের পাশে রেখে আসতে।


হলুদের মধ্যে লাল ও নীলের ছোট ছোট ফুল আঁকা কাভারের কারণে বোঝা যায় না টেবিলটার আসল চেহারাটা। কেবল নীচে পায়ার দিকে তাকালে বোঝা যায় এককালে টেবিলটার জৌলুস ছিল। এখন পর্দার আড়ালে ঢাকা পড়েছে টেবিলের আসল বয়স। টেবিলের উপর বিদেশি চায়ের কাপ, সঙ্গে মানানসই পিরিচ। নীল রঙের কাপের তলানিতে একটু চা পড়ে আছে উচ্ছিষ্ট অবহেলায়। কাপের গলায় লিপিস্টিকের লাল টুকটুকে ছাপ। আরেকটা নীল পিরিচে কয়েকটা বাদামি বিস্কুট এলোমেলো শুয়ে আছে। পিরিচের বাইরেও বিস্কুটের দুয়েকটা ভাঙা টুকরা পড়ে আছে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা।
হঠাৎ কাপ-পিরিচ আর বিস্কুটের এই জমায়েতে একটু প্রাণের ছোঁয়া দেখা যায়। কেননা, এখন আমরা দেখতে পাই— একটা ভাঙা বিস্কুটের টুকরা নিয়ে পিঁপড়াদের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। নিজের শরীরের চেয়ে কয়েকশ গুণ বড় বিস্কুট টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়েরা। টেবিলের একপাশে কিছু পানি জমেছে। গ্লাসের শরীরে জমে থাকা ঘামের মতো ঠান্ডা পানি গড়িয়ে নেমেছে টেবিলে। টেবিলের ভেজা কাভারের ওইটুকু সীমানা এড়িয়ে পিঁপড়েরা সতর্ক হেঁটে যায়। বরফ দেয়া ঠান্ডা পানিতে একটা মৃত মশা পড়ে আছে। গ্লাসের পাশেই এসট্রে ভর্তি ছাই, সিগারেটের টুকরা। এখনও কিছু ধোঁয়া উড়ছে। একটা সিগারেটের ভাঙা টুকরায় ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে এখনও। তাই দেখে মনে হয়, এই ঘরে কিছুক্ষণ আগেও কেউ ছিল। এখন শুধু টেবিলে গ্লাস, কাপ, পিরিচকে ঘিরে লিপিস্টিকের দাগ, চায়ের তলানি, পরিত্যক্ত বিস্কুট আছে। আর আছে পিঁপড়ের ব্যস্ততা।