সায়ন্তনী নাগ
মেয়েটার যখন ঘুম ভাঙল, তখন নিশুত রাত। ওর খোলা চোখের পাতার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে একটা নক্ষত্র। বাকি সব নিকষ কালি গোলা অন্ধকার। অথচ এখন আর ওর ভয় করছে না। কিন্তু খানিক আগেই বড্ড ভয় করছিল। লোকগুলোর মুখ দেখে। হাবভাব দেখে। ঘন হয়ে আসা দেখে। ভয়ের চোটে ও ফোন করেছিল বাড়িতে, ‘মাগো, চারদিকে কেমন সব খারাপ লোক!’
তারার রঙ কি নীল? নাকি সাদা? ভূগোল ক্লাসে দিদিমণি কী জানি বলেছিল? তারারা আসলে তারা নয়, গ্যাসের পিণ্ড, জ্বলছে তো জ্বলছেই। আর এত দূরে থাকে ওরা, হয়ত সেই কবে নিভে গেছে। কিন্তু সে খবর এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছয়নি। আমরা এখনো দেখছি আলো!
‘ও মেয়ে, তোর কি শীত করছে?’ তারা শুধোয়। ‘কই, নাতো!’ অথচ একটু আগে খুব শীত করছিল ওর। যখন লোকগুলো ওর গায়ের থেকে একটা একটা করে খুলে ফেলছিল আচ্ছাদন। কুর্তি, সালোয়ার, ব্রা, প্যান্টি, মোজা, জুতো। ও কাঁপছিল। অথচ এখন কই, একটুও তো শীত নেই!
‘ও মেয়ে, তোর কি যন্ত্রণা করছে?’ ‘কই নাহ!’ অথচ একটু আগে কি প্রবল কষ্ট হচ্ছিল! ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল ওর স্তন, ঠোঁট, যোনী। একপাল হিংস্র নরখাদক যেন জ্যান্ত শিকারকে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। ও আর্তনাদ করে উঠেছিল। সে চিৎকার থেমে গেছিল শ্বাসরোধকারী এক থাবায়।
‘তবে তোর এখন কেমন লাগছে মেয়ে?’ তারা, তুমি কি জানো, কোমল পিঠের নিচে কাঁকড়, পাথর, লোহালক্কড়, পেরেক পড়ে থাকলে কেমন লাগে? দুই ভূখণ্ডে প্রসারিত দুই পায়ের ফাঁকে যখন লোহার রড বারবার প্রবেশ করে, কেমন লাগে? কেমন লাগে যখন প্রায় অবশ শরীরটায় শান্তিজলের মতো দাহ্য তরল ছিটিয়ে যায়? আর তারপর বিড়ির শেষ টানটা দিয়ে সেটা সযত্নে সাজিয়ে রাখে বিভাজিকায়?
তারা চুপ করে থাকে। শ্বাস ফেলে। আসলে মেয়েটা এখন একটা কালো পোড়া চ্যালাকাঠের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না। তার আর ভয় নেই, ব্যথা নেই, জ্বালা নেই, খিদে-তেষ্টা-চিন্তা কিচ্ছু নেই। এখন আর এক ফোঁটা জল, এক বিন্দু রক্ত অবশিষ্ট নেই গড়িয়ে পড়ার মতো।
মেয়েটার দুই ভ্রূর কাছে নেমে আসে তারা। ‘হ্যাঁরে মেয়ে, তুই কি ওদের চিনতে পেরেছিলি?’
‘পেরেছিলাম তো! লাখ লাখ তারার মধ্যে যেমন চিনতে পারতাম সপ্তর্ষিমণ্ডল, ক্যাসিওপিয়া, অ্যান্ড্রোমিডা! অথচ সব্বাই তো একই রকম। একই রকম হিংস্র, নিপীড়ক, প্রতিশোধপরায়ণ, কামুক। সকলের একই রকম উদ্ধত নখ, দাঁত, পুরুষাঙ্গ। আমার চোখে সকলেই তো কালপুরুষ!’
লজ্জায় মিটমিট করে নিভে যায় তারা। ধ্রুবতারা। আসলে সেও তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বহু আলোকবর্ষ আগে। এখন আর দিক চিনিয়ে দেবার মতো অবশিষ্ট নেই কেউ!