নাহার মনিকা
-‘এইটার নাম কলোসিয়াম, বুঝছো। টুরিষ্টদের কাছে বেচি। চায়না মেইড মাল। দেখলে মনে হয় হাতির দাঁত দিয়া বানাইছে, আসলে সোপ ষ্টোন, মানে সাজিমাটি দিয়া বানায়। কলোসিয়াম হইলো বিরাট ইষ্টেডিয়ামের মত একটা জায়গা। চাইরদিকে বসার বন্দোবস্ত, আর মধ্যখানে মঞ্চ। সেইখানে আবার যেই সেই শো না, এইখানে বইসা রাজা বাদশায় খেলা দেখতো। আমরা যেমন ফুটবল, ক্রিকেট দেখি, ওরা দেখতো মাইনষের ফাইট। দাসপ্রথার কথা শুনছো কোনদিন?’
তা মোমেনা দাসপ্রথার কথা কোথথেকে শুনবে? কত মানত আর দোয়া করে করে স্কুলের গণ্ডি কোনমতে পার হলে তারপর আরো জোড়া খাসি কুরবানি, পীরের দরগায় শিন্নি দিয়ে বাপ মা দুই হাজার ঊনিশ সালের ডিসেম্বর মাসের এক তারিখে তার বিয়ে দিলো ইটালী প্রবাসী শাজাহানের সঙ্গে। স্কুলের বইয়ে যদি ক্রীতদাস প্রথার কথা থেকেও থাকে সেসব কি আর তার মনে আছে?
ফর্সা পায়ে রূপার মল, হাতের নখে লাল রঙ্গের নেইলপোলিশ, টিপ লিপষ্টিকে সেজেগুজে বসে থাকা মোমেনার মুখ জানালা দিয়ে আসা সকালের রোদ লেগে চিক চিক করে।
বালিশে আধশোয়া হয়ে থাকা স্বামীর কাছ থেকে দাসপ্রথার বিস্তারিত শুনে তার হৃদয় আদ্র হয়ে আসে।
-‘রাজা আইসা বইসা সেই ক্রীতদাসদেরকে ফাইট করতে কইতো। জীবন-মৃত্যুর লড়াই। জিততে হইলে আরেকজনকে মাইরা ফালাইতে হইবো। যে পারবো সে ই জয়ী’।
-‘ওই দেশের মানুষ এত নিষ্ঠুর আছিল’?
-‘সব দেশের মানুষই নিষ্ঠুর আছিল, মুঘল ইতিহাস তো জান না’
– ‘থাক, আমার জাইনা কাজ নাই’
মোমেনা কথা ঘুরিয়েছে। মানুষ এখনো নিষ্ঠুর, আর সেসবের কিছু কিছু নমুনা যে সে দেখেনি তা তো না। কিন্তু শাজাহানের কাছে এত কিছু খোলাসা করার দরকার কি? বিয়ের বছরপূর্তি হয়নি, এখনো সে নতুন বৌয়ের গয়নাগাটি পরে থাকে। যখন স্বামীর সঙ্গে রোম শহরে থাকতে যাবে তখন সামনাসামনি বসে না হয় তার দেখা মানুষের নিষ্ঠুরতার বিবরণ দেবে। তাদের পাড়ায় তাকে দিনের পর দিন বিরক্ত করা মাস্তান ছেলেটার কথা বলবে। শাজাহানকে, মনে হচ্ছে নরম মনের মানুষ। শুনে মন খারাপ করবে, আর অদেখা সেই মাস্তানের বিরুদ্ধে আস্ফালন করবে। মোমেনার তাতেই চলবে। তার প্রতি একটু সহমর্মী, তার দুঃখে সমব্যথী।
বিয়ের দু’দিনের মাথায় মোমেনা টের পেয়েছিল যে তার স্বামীর ঐতিহাসিক স্থান, পুরানো জায়গা এসব বিষয়ে খুব আগ্রহ। শাশুড়ি বলেছে যে তার ছেলের ওই একটাই নাকি নেশা। পুরানো বই, ঐতিহাসিক সিনেমা। আনার কলি, মুঘল ই আজম, সিরাজদ্দৌলা এসব যে কতবার দেখেছে তার ছেলে! নামের আছর আছে ওর ওপরে।
হ্যা, মোমেনা মাথা নাড়ে। শাহজাহান তো মুঘল সম্রাট ছিল। মনে মনে হাসে- ‘তাজমহল বানাইবেন জাঁহাপনা?’ তবে এরকম ইয়ার্কি এখনো করে উঠতে পারেনি। ফোনে এত কথা বলা যায়? বেশীরভাগ সময় তো শাজাহানই কথা বলে। আসুক, মোমেনার সময় আসুক তখন বলবে। এখন তো সম্রাট সাহেব কলোসিয়ামের কথা বলেই কূল পায় না।
বিয়ের পর শাজাহান তাকে প্রথমে যেখানে ঘুরতে নিয়ে গেল তা হচ্ছে লালবাগের কেল্লা। মোমেনা মনে মনে সিনেমা দেখার শখ করে বসেছিল। সদ্য বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কোন সিনেমা দেখার রোমান্স এবং উত্তেজনা বাদ দিয়ে কাঠখোট্টা পুরানা দালানে ঘোরাঘুরি! তার মুখে সম্ভবত মন ভারের আবছা ছায়া দেখা দিয়ে থাকবে। শাজাহান তখন চট করে মোমেনায় মনযোগী হয়েছিল, বলেছে-‘আসলে পরীবিবির মাজারটা তোমারে সাথে নিয়া আরেকবার দেখতে চাইছি, ভাবতে পারো মোগল রাজবংশের ছেলের বউ এইখানে শুইয়া আছে! এই শানের উপরে দিয়া স্বয়ং শায়েস্তা খাঁ হাইটা গেছে। যার আমলে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যাইতো’।
তা সেসব তো মোমেনাও শুনেছে, স্কুলের ইতিহাস বইয়ের পাতায় পড়েছেও নিশ্চয়ই। সেই বইয়ের পাতা যে শাজাহানের সঙ্গে থাকলে চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে, কল্পনা করতে পারেনি।
-‘দেখো, মেয়ে পরীবিবিরে এত ভালোবাসতো শায়েস্তা খাঁ,যে মারা যাওনের পর আর বাংলায় থাকে নাই। রাজধানী সরায়া মুর্শিদাবাদ নিয়া গেছে, ভাবতে পারো!’
বাক্যের শেষে ‘ভাবতে পারো’তে চোখ বড় করে সরল অভিব্যক্তি শাজাহানকে কেমন শিশুতোষ করে ফেলে, মোমেনার মনে হয় তার স্বামী বুঝি সরেজমিনে সে সময় শায়েস্তা খাঁ’র মেয়ের রোগশয্যায় উপস্থিত ছিল।
পরীবিবির কাহিনী শুনতে শুনতে একটা চিকন অসুয়া নিজের শিরদাড়া বেয়ে নেমে যাওয়া টের পায় মোমেনা। হলোই না হয় মৃত, হলোই না হয় কয়েক’শ বছর আগে, তাও তো অপরূপা কোন শাহজাদী। শাজাহানের আবেগমথিত কণ্ঠে পরীবিবি’র কাহিনী শুনে রাগ হয় মোমেনার। তার স্বামী সম্ভবত রাগের আঁচটা টের পায়।
হঠাৎ করে এক পশলা ধূলিময় বাতাস এসে কেল্লার দেয়ালগুলোতে মাথা ঠুসতে থাকলে
ভ্রমনার্থীদের ভীড় এড়িয়ে মোমেনার হাত ধরে একটা কোনার জায়গা খুঁজে নেয়। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বৌএর মেহেদী রাঙ্গা আঙ্গুলে আঙ্গুল ছোঁয়ায়, চুড়িতে রিন রিন শব্দ তোলে। বাতাস কমলে ফেরীওয়ালার কাছ থেকে কোল্ডড্রিংস কিনে আনে। বিকেল তার হিম হিম হাওয়া দিতে শুরু করলে হাতে হাত রেখে হাঁটতে দু’বার মোমেনাকে গভীর জড়িয়ে ধরে। সিনেমায় না যেতে পারার ক্ষেদ উবে গিয়ে দারুণ সময় কাটানো ফুরফুরে মন নিয়ে বাসায় ফেরে মোমেনা।
শাজাহানের খুব ইচ্ছে ছিল মোমেনাকে নিয়ে ভারতে গিয়ে ইতিহাসের পীঠস্থান আগ্রা, দিল্লী ঘুরে আসে। -‘গয়নাগাটি চাও না বিশ্বভ্রমণ করতে চাও’- ঠাট্টা না, সত্যি সত্যি জানতে চেয়েছে।
স্বামীর স্ফটিক চোখের দিকে চেয়ে মোমেনা মাথা নিচু করে ফেলেছে। মন বলেছে গয়না, মায়ের শেখানো যুক্তি মাথায় ঘুরেছে যে সোনার গয়না বিপদের ভরসা। কিন্তু মুখে উচ্চারণ করেছে- ‘ঘুরতেই তো চাই’।
-চলো, তাইলে শাজাহানাবাদ গিয়া শাহজাদী জেবুন্নিসারে যে তার বাপ সম্রাট আওরঙ্গজেব বন্দী কইরা রাখছিল, সেসব জাগা দেইখা আসবো। ভাবতে পারো, নিজের বাপ যেই দেখলো মেয়ে তার ভাইয়ের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিছে যাতে বাপরে সরায়া ভাই বাদশা হইতে পারে, তখন তারে গ্রেফতার করছে, এক দুইদিন না, মরার আগ পর্যন্ত বন্দী। জেবুন্নিসা এর পরে পঁচিশ বচ্ছর জীবিত আছিল। ত্যাজ্য মেয়ের কথা কোনদিন কারো কাছে উচ্চারণ করে নাই আওরঙ্গজেব, কেউরে ওর কথা লেখতেও দেয় নাই’।
কেউ লেখে নাই, শাজাহান তাইলে জেবুন্নিসা’র কথা কেমন করে জানলো? অবশ্যম্ভাবীভাবে এই প্রশ্ন মোমেনা করতেই পারে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ পালটায়। ইন্ডিয়া গেলে কি কি শপিং করবে মনে মনে তার তালিকা করে। জেবুন্নিসার বিরাট আখ্যান শাজাহান খুলে বসলে যে চিন চিন ব্যথা বুকের ভেতরে শুরু হবে তার সঙ্গে বার বার পরিচিত হতে চায় না মোমেনা।
অচেনা, অদেখা ইতিহাসের ফ্যাসাদ বাদ দিলে শাজাহান অসাধারণ দিলখোলা, হাতখোলা মানুষ। ঠিক যেমনটা মোমেনা চেয়েছিল। বিয়ের পরে শশুরবাড়ি ফিরানী গিয়ে যে বাজার করেছে তা দেখে আত্মীয়স্বজন বিস্মিত। এত বড় বড় মাছ, আর এন্তার মিষ্টি যা আত্মীয় প্রতিবেশীকে বিলিয়ে শেষ করা যায় না। নতুন বৌ মোমেনাও স্বামীকে একা পেয়ে লাজুক অনুযোগ করেছে- ‘এত কিছু কিনার কি দরকার?’
দু’দিনেই তার মনে হয়েছে যে এই লোকটাকে বলার মত অধিকার আছে, অন্তত বাড়তি খরচ করতে নিষেধ করার অধিকার। শাজাহানের চোখে খুশী ঝিকমিক করেছে, বৌয়ের কোমর জড়িয়ে ধরে হেসে বলেছে-‘ এতদিন তো খালি রাজা বাদশার ইতিহাস পড়লাম আর জানলাম। এখন ওদের মতন খরচাপাতি করি একটু, একদিনই তো!’
না, তাদের হিল্লি দিল্লি করার সুযোগ হয়নি। তার আগেই কাজের শহর রোমে ফেরার দিন চলে এসেছে। শাজাহানের বিবাহ উপলক্ষে দেশে আসার ছুটি শেষ। ছুটি না, আসলে হাতের টাকা পয়সা শেষ। একথা মুখফুটে তার স্বামী বলেনি, শাশুড়ি বলেছে।
সবাই কি আর বাদশা শাহজাহান? কিন্তু বাদশার মত খরচাপাতি শুরু করলে হাত তো খালি হবেই। শাজাহান অতএব, জানুয়ারী মাসের শেষে ইটালির প্লেন ধরতে ভোররাত্রে ঘুম থেকে উঠে পড়ে।
শাজাহান ফিরে যাওয়ার পর শাশুড়ি আর বৌ, দুইরুমের বাসায় ঘুরপাক খায় আর শাজাহানের প্রসঙ্গ তুলে গল্প করে, খুশী হয়, বিষণ্ণ হয়। ছেলের খরচের হাত নিয়ে শাশুড়ি গজগজ করে। একটু হিসেব করলে আরো কয়টা দিন সে মা এবং বৌয়ের কাছে কাটিয়ে যেতে পারতো!
মোমেনা শাশুড়ির মাথায় নারকেল তেল ঘষে, আর শাশুড়ি তাকে ছেলের বেড়ে ওঠার গল্প শোনায়। কেমন শান্তশিষ্ট আর ভীতু ছিল ছেলেটা। স্কুলে বন্ধুদের মার খেয়ে বাড়ি এসে মায়ের আঁচলের তলায় বসে কাঁদতো। অন্য বাচ্চাদের বাপ মায়ের সঙ্গে ছেলের হয়ে কতদিন ঝগড়া করেছে মোমেনার শাশুড়ি! কোন আজে বাজে অভ্যাস নাই। ঐ শুধু এক পুরনো জায়গায় ঘোরার নেশা। রাজা রাজড়াদের নাম ধাম, তাদের কীর্তিকান্ড সব মুখস্থ।
সব যে মুখস্থ সে কি আর মোমেনা এই ক’দিনে জানে না?
ফোনে তো সেই এক গল্প। রোম শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ানোর গল্প শুনে শুনে তার নিজেরই প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে এ কয়দিনে। তবে ঘোরার আর সময় পায় কোথায় তার সম্রাট শাজাহান? সপ্তায় সাতদিনই কাজ। ফুটপাতের দোকানে যখন কাষ্টমার কম, সামান্য ফুরসত থাকে তখনই মোমেনাকে ভিডিও কল দিয়ে বসে। মোমেনা তার চারপাশে শুধু বাংকারে ঝোলানো জ্যাকেট- সোয়েটার-হাতব্যাগ, অথবা বিভিন্ন ধরনের স্যুভেনির দেখে।
একদিন জিজ্ঞেস করে বসেছিল-‘কলোসিয়াম দেখাইতে পারো না ভিডিও কলে?’
শাজাহানের মুখের হাসি উবে গিয়ে বেফাঁস এক পোচ কালো ছায়া পরেছিল।– ‘ঐটা ওই পুরানা রোমের দিকে। এখন কাজের খুব চাপ। এর পরে যখন যাবো, তখন তোমারে দেখাবো’।
তারপর দু’এক কথার পরে আবার উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে – ‘আর তুমি যখন আসবা, তখন একবারে মাসখানেকের ছুটি নিয়া রাখবো। খালি ঘুরবো আর ঘুরবো। কতকিছু যে দেখার আছে! এই দেশটায় থরে থরে খালি ইতিহাস, বুঝছো?’
এর মধ্যে এক বন্ধুর কাছে উপহার পাঠিয়েছে শাহজাহান। শ্যাম্পু, হাতব্যাগ, লিপষ্টিক ইত্যাদির সঙ্গে কলোসিয়ামের স্যুভেনিয়র। ঘিয়ে রঙ্গা সাজিমাটি দিয়ে বানানো খোপ কাটা দেয়ালের নিচে সিঁড়ির সার, একদিকে ভাঙ্গা এই স্থাপনা দেখে না কি এর আসল বিশালত্ব আর সৌন্দর্যের কিছুই ঠাহর করা যায় না, তবুও মোমেনা দেখুক। আর ফোনে তো বিশদ বিবরণ দেয়াই যাবে।
বীজগণিতে খারাপ ছাত্র যেমন ফর্মূলা মুখস্থ করে, প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ে পড়ে অংকে ভালো হয়ে ওঠে, মোমেনারও তেমন ইতিহাসের প্রসঙ্গ আর খারাপ লাগে না। বরং সে ঠিকঠাক প্রশ্ন করতে পারে, যে প্রশ্নগুলো শাজাহানের পছন্দ, খুশী হয়ে উত্তর দীর্ঘায়িত করে।
-‘চিন্তা করতে পারো, এই কলোসিয়ামে ষাইট সত্তর হাজার মানুষ গমগম করতেছে, আওয়াজ না যেন বিরাট আসমানের মতন ডেগচির ভিতরে কেউ দৈত্য দানব ছাইড়া দিছে। এর মইধ্যে রাজা রানী সাইজাগুইজা তাদের মন্ত্রী উজির নাজির সাঙ্গপাঙ্গ নিয়া আইসা আসন গ্রহণ করলেন। তারপর দুইদিকের গেইট খুইলা ছাইড়া দেওয়া হইল দুইজন ক্রীতদাস, যাদেরকে বলে গ্ল্যাডিয়েটর। ঢাল তলোয়ার নিয়া, শিরস্ত্রাণ পইরা একজন আরেকজনের দিকে আগায়া আসতেছে। এই দুইজনের নিয়তি নির্ধারণ করাই আছে। যে কোন একজনের মরতে হবে। যে কোন একজনকে আরেকজনের মারতে হবে। মাইরা যে জীবন পাবে সেইটাই তার পুরস্কার। কখনো কখনো একজনরে মারতে পারলে রাজায় আরেকজনের সঙ্গে ফাইট দিতে বলতো। বুঝলা, ওই ব্যাটার তো সব শক্তি শেষ। তখন আরেকজন শক্তিশালী আইসা হাজির হইলে তো হারা ছাড়া উপায় নাই। আর হার মানেই মৃত্যু। আরো কঠিন মৃত্যু দেখতে চাইলে রাজায় আদেশ দিতো- সিংহের সাথে ফাইট দিতে। ক্ষুধার্ত সিংহ ছাইড়া দিতো’।
নেশাগ্রস্থের মত কথায় পায় শাজাহানকে, আর কথার তোড়ে নিজস্ব আঞ্চলিকতা তলিয়ে যেতে থাকে তার শব্দবন্ধের ভেতর। মোমেনা ফোনের এপাশে ভয়ে আতংকে শিউরে উঠলে শাজাহানই আবার আস্বস্ত করে-‘আরে বোকা নাকি? ডরাও ক্যান, এইগুলি এখন আর হয় নিকি? এইসব হাজার বছর আগের কাহিনী। তবে সবাই যে খালি মারতো আর মরতো,তা কিন্তু না। ওরা খেলা দেখাইতো, রাজা বাদশারা মজা পাইতো, সার্কাস আর কি। খেলা দেখায়া কেউ কেউ অনেক পয়সাঅলাও হইয়া যাইতো’।
শাশুড়ি মোমেনাকে পরামর্শ দিয়েছে, স্বামীকে বোঝাতে যে পুরুষ মানুষ এসব ইতিহাস ফিতিহাস নিয়ে মশগুল না থেকে যেন কায়কারবার মন দিয়ে করে। সেইমত একটু কঠোর হতে চেষ্টা করে মোমেনা, বলে-‘ এইসব কথা আর শুনবো না। আমারে তোমার কাছে নেওয়ার কাগজপত্র রেডি করো। তা না হইলে তোমার সঙ্গে কথা নাই’।
মোমেনার কথায় কি রাগ হলো শাজাহান? হলে হোক, এবার একটু শক্ত হবে সে। এরপর শাশুড়ির পরামর্শে দু’দিন শাজাহানের সঙ্গে শুধু কেজো কথা বলে মোমেনা।
তবে তিনদিনের দিন তার মন নরম হয়ে আসে। আহারে, বিদেশ বিভূইঁয়ে গায়ে খাটে, একলা থাকে। কি খায় না খায়। তার একমাত্র আনন্দ হচ্ছে বৌ এর সঙ্গে একটু কথা বলা। সেখানেই যদি বাধা দেয় মোমেনা।
শাশুড়ি ভাতঘুম দিলে সে ফোন নিয়ে একচিলতে ব্যলকনিতে আসে। ম্যাসেঞ্জারে তার স্বামীর নামের পাশে সবুজ চিহ্নটা জ্বলছে না তো! তবু ফোন করে, টুউট টুউট শব্দ হতে থাকে। কিন্তু শাজাহান ফোন তোলে না। হয়তো ব্যস্ত আছে।
কিন্তু সারাদিনে আর কাংখিত ফেরত-কল আসে না মোমেনার কাছে। কাঁধের দু’পাশে ফোনের জন্য অপেক্ষার ভার নিয়ে সারাদিনের কাজকর্ম চালিয়ে যায় সে।
তাদের পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার সঙ্গে শাশুড়ির খুব ভাব, দেখা করতে এসেছে। দু’জনে কি কি নিয়ে কথা বলে হেসে উঠছে। নিজের অস্থিরতা দিয়ে শাশুড়িকে আক্রান্ত করতে চায় না মোমেনা। রান্নাঘরে চা বানাতে বানাতে শাজাহানের ওপর অভিমানের সঙ্গে দুঃশ্চিন্তার স্তর জমে। পাশের বিল্ডিং এর দেয়াল ফুঁড়ে একটা বেয়াক্কেলে লতাগাছ প্রায় রান্নাঘরের জানালায় উঠে এসেছে, যেন ওঠার ইচ্ছে নেই, তবু উঠেছে। মোমেনার নিজেকে ধুলোজমা ওই লতাগাছের কালচে সবুজ পাতার মত ম্রিয়মাণ মনে হয়।
দু’দিন যায়, তিনদিন পার হয়। এবার আর শাশুড়িকে না জানিয়ে পারা যায় না। তারপর দিনের পর দিন আর কোন ফোন আসে না। শাশুড়ি ডাক ছেড়ে কান্না শুরু করে। শাজাহানের বন্ধু বান্ধবদের খোঁজ পড়ে, আত্মীয়দের কেউ কেউ সেখানে থাকে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় খুঁজতে হয়। সবাই ফোন ধরে না, দু’একজন ধরলেও কোন খবর দিতে পারে না। বলে- ‘এখন তো রোমে ভয়াবহ অবস্থা লকডাউন ভাইঙ্গা কেমনে খবর নেই। সে তো আমাদের ফোনও ধরে না।
তারপর একদিন মোমেনাদের স্তব্ধতা চিরে সংবাদ আসে। হাসপাতালে ভর্তি আছে শাজাহান।
দু’দিনের মাথায় হাসপাতাল থেকে ফোন আসে মোমেনার কাছে। কাঁপা কাঁপা ভিডিও কলে ভ্যান্টিলেশনে রাখা শাজাহানের চেহারা ভালো করে বোঝা যায় না। তার ফুর্তিবাজ কণ্ঠস্বরের বদলে একরাশ দূর্বোধ্য ঘরর ঘরর এসে ফোনের দখলদারীত্ব নিয়ে নেয়। নার্সের ভিনদেশী মুখ আর অন্যভাষার কাছে মোমেনা আর তার শাশুড়ি যে কথাবার্তা চালাতে পারে তার নাম শুধু হতভম্ব চোখের আকুল কান্না।
মার্চের শেষ হয়ে গেছে, বৈশাখের চণ্ড সূর্য গোগ্রাসে গিলে নেয় চারপাশের সব নাতিশীতোষ্ণ পেলবতা। মোমেনা চুপ করে বসে থাকে। শাশুড়ি জায়নামাজ থেকে ওঠে না।
আরো সপ্তাখানেক পর খুব ভোরবেলা,তখনো আশপাশের দৈনন্দিন নড়ে চড়ে উঠছে না, মোমেনা অ-ঘুমো রাত ঠেলে রেখে উঠে পরে। জানালা খুলে দেয়, রাস্তার ধূসর আলো তার বিছানায় সাপের মত কুন্ডুলি পাঁকিয়ে বসে। সে শাজাহানের পাঠানো কলোসিয়ামটা এনে বিছানার ওপরে রাখে।
ম্যাসেঞ্জারে শাজাহানের নামের পাশে কোন সবুজ ডট জ্বলজ্বল করে না, তবু সে হাতের তালুতে মোবাইল রেখে হু হু করে কাঁদে -‘ফাইট দিতে পারো না তুমি? মাইরা ফালাইতে পারো না? তারপর জিতো। খুব কইরা ফাইট দেও, ইতিহাস থেইকা কি শিখলা এতদিন?’।
কলোসিয়ামের রেপ্লিকা বুকের কাছে চেপে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদে মোমেনা।