শামীম রুনা

হাজেরা খাতুন মিরপুর এগারোতে একটা ডেনিম জিন্সের কারখানায় সুইং মাস্টারের কাজে করে। থাকে দুয়ারিপাড়া বস্তির শেষ মাথায়। আগে বস্তির প্রথম দিকে থাকলেও পর পর কয়েক দফা আগুন লাগার পর পিছাতে পিছাতে এখন শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। ছোট্ট একটা ঝুপড়ি মতোন টিন শেড ঘর, ঘর না বলে সাত ফুট বাই আট ফুটের টিনের বাক্স বলাই ভালো; এক রুমেই কিশোরী দুই মেয়ে নিয়ে ঘুমানো আর রান্না বান্না চলে। মাঝে মাঝেই হাজেরা খাতুনের মনে হয়, যদি না ঘুমাতে হতো? তাহলে সারা দিন সারারাত টক্ টক্ করে মেশিন চালাত আর ওভার টাইমের পর ওভার টাইম করে টাকা কামানো যেত। কারোরে সে টাকা দিতে হতো না। যদি শরীরে পেটটা না থাকতো? তাহলে এই পৃথিবীতে কত কিছুর সহজ সমাধান হয়ে যেত। মানুষ সবাই নিজেই নিজের রাজা থাকতো, কেউ কারোর গোলাম হতো না।
হাজেরা খাতুনের স্বামী টেম্পো চালাত। তখন দুজনের মিলে ভালোই আয়-রোজগার ছিল সংসারে। মিরপুর এগারোর বাজারের কাছে দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো। মেয়ে বড়োটা তখন স্কুলে যায় আর ছোটটা দাদীর কাছে বাসায় থাকে। একদিন অকস্মাৎ আকাশ ভেঙে পড়ে, তরতাজা লোকটা সকালে টেম্পো নিয়ে বের হলো আর সন্ধ্যায় লাশ হয়ে ঘরে ফিরলো। ওদের কেউ লোকটার মুখ দেখতে দিল না, এমন সে বিভৎস মরণ নিয়ে লোকটা পৃথিবী ছাড়ল আর হাজেরা খাতুনের সরল রেখার জীবনটাও বেঁকে গেল। স্বামীর মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় শাশুড়ীও পুত্র শোকে মারা গেলে হাজেরা খাতুন দুয়ারীপাড়ার বস্তিতে মেয়েদের নিয়ে ওঠে আসে। ত্রিশর্ধো হাজেরা খাতুনের মনে হয়, স্বামী-সন্তান নিয়ে ওই দিনগুলোই তার জীবনের সব চেয়ে ভালো দিন ছিল।
ছয় মাস আগে বড়ো মেয়েটিকে নিজের ফ্যাক্টরিতে সুতা কাটার কাজে চাকুরী জুটিয়ে দিয়েছে, মনে মনে আশা পোষন করেছে, সামনে আবার স্বচ্ছলতার দিন আসছে। ছোট মেয়ের বয়স চৌদ্দ, একটি এনজিও’র স্কুলে পড়ে। এক সময় এই মেয়েকেও একটি চাকুরী পাইয়ে দেবে ফ্যাক্টরিতে, তারপর মা মেয়ের তিনজনে টাকা জমিয়ে বাড়িতে একটা ছোট দালান বানাবে, বুড়ো বয়সে হাজেরা খাতুন নিজের ভিটায় হাঁস-মুরগী পালবে, লাউ-সিমের সব্জী ফলাবে, মেয়েরা স্বামী সন্তান নিয়ে বেড়াতে আসবে-এই তো স্বপ্ন!
সহজ সরল স্বপ্নে গন্ডগোল পাকাতে দেশে (হাজেরা খাতুন শুনেছে সারা দুনিয়ায়) গজব হয়ে আসে করোনা ভাইরাস নামের অসুখ। কয়েকদিনের চলতে থাকা গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর একদিন বাস্তবতা পেয়ে সব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষনা করে দেয়। শুধু কী গার্মেন্টস? স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত কোট-কাচারি, সব; সব আচানক বন্ধ। পুরা শহর যেন হঠাৎ থমকে যায়! বাজারে চালে আগুন, আলু-ডাল-তেল-নুন-মরিচ সব কিছুতে দপদপিয়ে আগুন জ্বলে ওঠে যেন। তখনও মা মেয়ের মাসের বেতন হয়নি, ফ্যাক্টরি থেকে বলছে, সময় হলে বেতন দেয়া হবে। ঘর ভাড়া বাকী, অন্যান্য সব খরচও, হাতে জমানো মাত্র সামান্য কিছু টাকা, চলবে কী করে সামনের দিনগুলো? বাড়ীওয়ালা ভালো মানুষ, বলে; সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। এখানে থাকলে মেয়েদের নিয়ে ক’দিন পর না খেয়ে থাকতে হবে। আমি এই মাসের বাড়ী ভাড়া মাফ করে দিতেছি, গ্রামে চলে যাও। শুনেছি সরকার সেখানে ভালো রিলিফ দেবে।
একদিন সারাদিন মেয়েদের সাথে চিন্তা-ভাবনা করে পরের দিন বাক্স পেটারা নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ওরা তাজ্জব বনে যায়! হায় পুরা ঢাকাই কি বাড়ী যায়!
একদিন আর আধা রাত খরচ করে ওরা মধ্য রাতে বাড়ী পৌঁছায়। তখনও স্বামীর ভিটাতে একটা ভাঙা ঝুপড়ী নিজেদের বাড়ীর নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, দুই দিন যেতে না যেতে হাজেরা খাতুনের ভাসুর দেবরদের উঠতি ছেলেরাই রাত বিরাতে ঝুপড়ীর চারধারে শুয়োরের মতোন গোঁৎ গোঁৎ করতে লাগলো। হাজেরা খাতুনের আঠারো বছর বয়সী আর চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়ে দু’জনে ওদের কাছে “শহরের মাল” ছাড়া কিছুতে বোন মনে হয় না। হাজেরা খাতুন ঢাকা শহরের থাকা পোড় খাওয়া নারী, ও বুঝে যায়; মেয়েদর নিয়ে ওর গ্রামে থাকা হবে না। তার চেয়ে শহরে শ্রমিক নেতার আশ্রয়ে সাত ফুট বাই আট ফুটের ঝুপড়ীতে অনেক বেশি নিরাপদে থাকবে ওরা।

সুপারভাইজারের কাছ থেকে ফ্যাক্টরি খোলার প্রথম এসএমএস পেয়েই হাজেরা খাতুন দুই মেয়ে আর বাক্স- পেটারা নিয়ে নিঃশব্দে ঢাকার উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে ফজরের সময় বেরিয়ে পড়ে। বাড়ী থেকে বের হওয়ার সময় ওর মনে একটা সাহস কাজ করে, ঢাকা পৌঁছালেই নিজের ঘর, চাকুরী, বেতন, আর নিজের হাতে টাকা মানেই তো এক বুক সাহস। নালিতাবাড়ী বাজারে বাস স্ট্যান্ডে এসে দেখে ঢাকার কোন বাস নাই। একটা টেম্পোতে গিজগিজ ভীড়ে মেয়েদের নিয়ে শেরপুর পর্যন্ত এসে আবার দুর্গতিতে পড়া, এখান থেকেও ঢাকা যাবার কোনো যানবাহন কিছু নাই। হাজার হাজার মানুষ উদ্ভ্রান্তের মতো ঢাকার দিকে মুখ করে ছুটছে আর যদি কোনো বাহন পাওয়া যায় এই আশায় এদিক ওদিক খুঁজছিল। সে দলে মেয়ে দু’টিকে নিয়ে হাজেরা খাতুনও সামিল হয়। সন্ধ্যা নাগাদ অতিরিক্ত ভাড়ায় ট্রাকে করে ওরা টঙ্গী এসে পৌঁছায়। সেখান থেকে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা কোনো গাড়ীতে করে ওরা যখন মিরপুর পৌঁছায় তখন আবার সুপারভাইজারের এসএমএস আসে, ফ্যাক্টরি আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ক্ষুদায়, ক্লান্তিতে নাজেহাল হাজেরা খাতুন মেয়েদের মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে কলকলিয়ে বলে ওঠে, ল’ আগে ঘরে যাই। ঘরে গিয়া চালে ডালে ল্যাটকা খিচুড়ি রাইন্ধা খাইয়া একটা লম্বা ঘুম দিমুনে মায়ে ছায়ে। যে ক’দিন গার্মেন্ট খুলবো না খালি ঘরে শুইয়া ঘুম আর ঘুম দিমু। কত ঘুম যে চোখের কানায় জমসে….
নিজেদের বস্তির কাছাকাছি হলে মাঝ রাস্তায় পুলিশ আটকায়, আর যাওয়া যাবে না। বস্তিতে করোনা ভাইরাসের রোগী পাওয়া গেছে। বস্তি লকডাউন করা হয়েছে।
পুলিশ কোনো অনুনয় শোনে না, উল্টা মারতে আসে লাঠি তেড়ে।দুই সমর্থ্য মেয়ে নিয়ে হাজেরা খাতুন ঢাকার শূন্য রাস্তার দিকে তাকায়, রাত অনেক হলো, কোথায় যাবে; চেনা ঢাকা অচেনা লাগে।

শাহেদুল আলম আর নায়লা আলম, ব্যবসায়ী স্বামী স্ত্রী। বাংলাদেশের বড় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কর্ণধার সেই সঙ্গে নায়লা আলম বিজিএমইএ’র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদেও আছে। আজ সারা দিন ওর ওপর দিয়ে অনেক ঝক্কি ঝামেলা গেছে। দেশের এই দুর্দিনে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি টিকিয়ে রাখতে ওদের অনেক কাজ করতে হচ্ছে। আফটার অল, দেশের একচল্লিশ লক্ষ পরিবারের ভরন-পোষনের দায়িত্ব ওদের কাঁধে। এত সব সরকার পক্ষকে বুঝিয়ে, গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য ভর্তুকি আদায় করা মুখের কথা নয়।
শাহেদুল আলম স্ত্রীর কাজে গর্বিত। দিন শেষে এমন কোয়ারেন্টিনের কালে এক বোতল ওয়াইন নিয়ে তাই ওরা বারো তলায় ফ্ল্যাটের ট্যারেসে সেলিব্রেশন করতে বসে। সাদা কুর্তি পায়জামা পরা নায়লা আলম ওয়াইনের গ্লাস হাতে রাজহাঁসের মৃদু ছন্দে হেঁটে হেঁটে ছাদের কিনারায় গ্রিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। নিচে, ঠিক পায়ের নিচ থেকে নীরব বিস্তৃত আলোকউজ্জ্বল ঢাকা শহর। বাতাসে দুষণ নেই, সতেজ বাতাসে নায়লা আলম দীর্ঘশ্বাস টেনে বলে, শহরটা সব সময় এমন কোয়াইট থাকলে দারুণ হতো, তাই না?
তাহলে কী আর আমাদের এমন করে সেলিব্রেশন করার সুযোগ হতো? শাহেদুল আলম হেসে বলে। সে কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে হাসতে গিয়ে হাতের গ্লাস থেকে লাল রঙের ওয়াইন ছলকে নায়লা আলমের সাদা কুর্তিতে পড়ে লাল ছোপ তৈরী করে। সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত কিছু ভেবে এবার সে সশব্দে হেসে ওঠে।