অঞ্জন আচার্য
আমার কাছে স্বর্ণ পদার্থটির আলাদা কোনো মূল্য নেই। লোহা, তামা, কাঁসা, পিতল যেমন, স্বর্ণও আমার কাছে তেমনই। এর বেশি কিছু নয়। আলাদা মর্যাদা পাওয়ার মতো এর কিছু আছে বলে তো মনে হয় না। অন্যান্য ধাতুর মতো করে এটিও অলংকার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। অলংকার বানানোর জন্য স্বর্ণ ব্যবহার না-করে কেউ যদি তামা-কাঁসা ব্যবহার করেন, তাতে কী এমন ক্ষতি হবে শুনি? ইদানীং তো কাঠের, কাচের, মাটির বা শোলার অলংকার দেখি। কই, সেগুলো দেখতে তো খারাপ লাগে না! বরং অনেক বেশি নান্দনিক ও শৈল্পিক মনে হয়। এখন কথা হলো, স্বর্ণকেই এত দামি মনে করতে হবে কেন? এর অপর্যাপ্ততা? এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। স্বর্ণের চেয়েও অনেক বস্তু আছে পৃথিবীতে, যা পর্যাপ্ত নেই। সেগুলোর কথা তো আলোচনায় আসে না। আমরা ভেবে শঙ্কিত হই না, পৃথিবী থেকে কী হারে কমে যাচ্ছে পর্যাপ্ত পানীয় জল কিংবা স্বাস্থ্যকর বায়ু— যা জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বরং ভাবনায় থাকি— ঘরে কতখানি স্বর্ণ আছে, যা অভাবের দিনে বিক্রি করে চলবে। স্বর্ণের দাম পড়ে গেলে ব্যথিত হই। দুষ্প্রাপ্য হলে তো তার দাম পড়ার কথা নয়, বরং দিনকে দিন বাড়ার কথা। বেড়েওছে বহুগুণ। যেমন বাড়ে পুরোনো দিনের সজ্জিত আসবাব কিংবা বাসনপত্রসহ নানা কিছু। তবে সেই বাড়ার পেছনের কারণটা কী, তা অনেকেরই অজানা। আমরা অনেকেই জানি না, স্বর্ণ হলো সাম্রাজ্যবাদী চক্রের একটি বাতাসের তলোয়ার। এটাকে মূল্যবান হিসেবে দেখিয়ে পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করতে চায় তারা।
ইতিহাস থেকে জেনেছি, প্রস্তরযুগ থেকে ধাতু ব্যবহারের যুগে প্রবেশের মধ্য দিয়ে আধুনিক সভ্যতার সূচনা ঘটে। তবে সেই সভ্যতা বিকাশে লোহা, তামা বা ব্রোঞ্জের মতো ধাতুর যে অবদান আছে, স্বর্ণের অবদান তার সিকি ভাগও নেই। মূলত সামন্তযুগে এসে রাজ-রাজারা স্বর্ণকে মূল্যবান বস্তু হিসেবে সমাজের কাছে তুলে ধরেন। তারা স্বর্ণের তৈরি বাহারি অলংকার পরে কিংবা রানি বা রাজকন্যাদের ওই পদার্থের অলংকারে মুড়িয়ে রেখে সমাজের কাছে সেটিকে একটি মিথে পরিণত করেন। ‘তোমাকে রাজরানির মতো লাগছে’, ‘বাহ! তুমি তো দেখতে ঠিক রাজকন্যার মতো’—এসব কথা সমাজে সেই আদিকাল থেকে প্রচলিত। এখন কথা হলো, সেই ‘রাজরানি’ বা ‘রাজকন্যা’ আসলে দেখতে কেমন? এর ডেফিনেশন কী? কীসের মানদণ্ডে এই উপমা বা উপাধির প্রচলন? আসলে ব্যক্তি রাজরানি বা রাজকন্যা সমাজে বিশেষণে পরিণত হয়ে গেছে। নইলে সব রাজরানি বা রাজকন্যাই কি দেখতে সুন্দরী ছিলেন? না, তা নয়। এটা হলো সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া একধরনের মিথ। কেউ কেউ প্রকৃত অর্থেই সুন্দরী ছিলেন হয়ত। তা তো জেলে বা ধোপা পরিবারেও ছিল। তাতে করে কি রাজরানি বা রাজকন্যাকে ওই জেলে বা ধোপার মেয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে? হয়নি। বরং সেটি গালি হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
তুলনা করার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো জড়িত; দৈহিক সৌন্দর্য, আচারিক গুণাবলি নয়। কথা হলো, রাজরানি বা রাজকন্যারা দেখতে যেমনই ছিলেন না কেন, তাদের পোশাক-পরিধান, প্রসাধন বা অলংকার ব্যবহার ছিল দর্শনীয়। এভাবেই সমাজের উঁচু মহল নির্ধারণ করে দিয়েছে কী কী জিনিস দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান হিসেবে ভাবতে হবে। স্বর্ণকেও তারা একটি মিথে পরিণত করেছে। সেটাকে সমাজে ‘অমূল্য সম্পদ’ হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের। মধ্যবিত্তরা সেই স্বর্ণকে সামাজিক মর্যাদা হিসেবে দেখতে শুরু করেন। আর নিম্নবিত্তরা দেখেন অধরা-স্বপ্ন হিসেবে। সামন্তবাদের সময় সাধারণত রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হতো অন্য রাজপরিবারের (ব্যতিক্রম এখানে বিবেচ্য নয়)। সেখানে নিজেদের আভিজাত্যের বর্হিপ্রকাশ হিসেবে দেওয়া হতো সুসজ্জিত উপঢৌকন, বর্তমানে সমাজে যা যৌতুক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কে কার চেয়ে বেশি এই পণ দিতে পারেন, তা নিয়ে রাজপরিবারে চলতো অসুস্থ প্রতিযোগিতা। সেই উপঢৌকনের বহরে স্বর্ণালংকার ছিল একটি অন্যতম বিবেচ্য বস্তু। রাজপরিবারের এই কালচার দেখে ‘জাতে উঠার লক্ষ্যে’ অনুকরণ করতে শেখে মধ্যবিত্ত সমাজ। তারা তাদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে সাধ মেটাতে চায়। এমনকি কে কতখানি স্বর্ণ দিলো তার ওপর নির্ভর করতে শুরু করে ওই পরিবারের সামর্থ্য বা রুচি। একসময় বিয়েতে সেটা বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। বিয়েটা দুই পক্ষের হলেও মূলত এই দায় শোধ করার সকল ভার পড়ে কণেপক্ষের ওপরই। এই অপসংস্কৃতির ফলে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে ওঠে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে। যাদের পেটে একবেলা ভাত জোটে না, তাদের দিতে হয় সমাজের তৈরি করা মূল্যবান বস্তু— স্বর্ণ। তা ভিটেবাড়ি বিক্রি করেও হোক কিংবা অন্য কোনো উপায়েই হোক।
উন্নত দেশে নারী-পুরুষের মধ্যে স্বর্ণের অলংকার পরা নিতান্তই কমে গেছে এখন। তবে সেইসব দেশ স্বর্ণ নিয়ে ব্যবসা করেন। উন্নয়নশীল দেশ বা গরীব দেশের ওপর চলে সেই মাফিয়া ব্যবসা। ঘুরে-ফিরে সেই আগের মতোই। স্বর্ণকে মূল্যবান করে তোলা। যদিও ইতোমধ্যে ধনী দেশগুলো স্বর্ণের মজুদ দিয়ে নয়, বরং জ্বালানি তেল দিয়ে তাদের সম্পদ পরিমাপ করছেন। কারণ জ্বালানি তেলের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে সেই দেশের চালিকাশক্তি, উন্নয়নের চাকা। মাঝেমধ্যেই দেখি, নিতান্ত অযৌক্তিক কারণে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ডাকেন। এর একদিন যেতে না-যেতেই সরকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে হার মেনে তাদের সকল দাবি মেনে নেন। প্রত্যাহার করা হয় ধর্মঘট। আমার কথা হলো, স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান বন্ধ রাখবেন, তাতে আমজনতার তাতে কী এমন এসে যায়? আমার কাছে একটা স্বর্ণের দোকানের চেয়ে পাড়ার মুদির দোকানটি অনেক বেশি গুরুত্ববহ। সেটি বন্ধ থাকলে আমার, এমনকি আপনারও চলে না। স্বর্ণের দাম দশগুণ বাড়লেও আমাদের তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু পেঁয়াজ-আলু-তেল-নুনের দাম খানিকটা বাড়লেই হিমশিম খেতে হয় জীবন চালাতে।
প্রশ্ন হলো, নিত্যদিনের জীবনযাপনে স্বর্ণের উপযোগিতা কী? এটি কতখানি অপরিহার্য? কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই পরিবহন শ্রমিকেরা ধর্মঘট ডেকে বসেন। রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেন। অপরিসীম কষ্টভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষদের। কোনো অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লে সংসার চালাতে গলদঘর্ম হতে হয় আমাদের মতো চাকরির পয়সায় চলা সীমিত আয়ের মানুষদের। স্বর্ণের দোকান দশ বছর বন্ধ থাকলেও আমাদের তাতে কিচ্ছু আসে-যায় না। ওইসব দোকান বা ব্যবসা বন্ধ থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কী কারো কোনো প্রভাব পড়বে? পড়বে না। সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণ দেওয়ার রীতি উঠিয়ে, রুপা-তামা-কাঁসা বা অন্য কিছু দিলেই হলো। চকচকে দেখাতে হলে অনেক পাথর আছে— তা ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশ্ন আসতে পারে, স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের এমন উটকো দাবি সরকার রীতিমতো তড়িঘড়ি করে মেনে নেয় কেন? সেই আগের সূত্র। একসময় স্বর্ণ যেমন উচ্চবিত্তরা মূল্যবান ধাতু হিসেবে সমাজে তুলে ধরেছিলেন, তারাই এখন পরম্পরায় স্বর্ণ-ব্যবসায় রাজত্ব করছেন। সমাজের ওই শ্রেণিটাকে খ্যাপাতে চায় না কোনো সরকারই। কারণ এই স্বর্ণ-কারবারিরা সমাজে প্রভাবশালী, অর্থশালী, ক্ষমতাবান। সামন্তবাদের নতুন রূপান্তর মাত্র।
গত দশ বছরেও আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারো জন্য কোনো স্বর্ণের দোকানে গিয়েছি বলে মনে পড়ে না। কারণ, যে বস্তু আমার জীবনে কোনো প্রভাবই ফেলে না, তা আমার কাছে মূল্যবান হতে যাবে কেন? একসময় স্বর্ণের মুদ্রা প্রচলিত ছিল, এখন নেই। একসময় তো কড়িকেও মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হতো, এখন সেটি মূল্যহীন বস্তু মাত্র। স্বর্ণের এই বৈশ্বিক রাজনীতির ঘেরাটোপে পড়ে এখনো খাবি খাচ্ছে সেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা। স্বর্ণ কোনো মূল্যবান ধাতু নয়, একটি মূল্যবান মিথ, যার উপরের ক্রিমটি শুরু থেকেই খেয়ে যাচ্ছে ধনীরা। যত দিন পর্যন্ত এই মিথ্যে মিথটিকে টিকিয়ে রাখা যাবে, তত দিন সমাজের ওই সুবিধাভোগী শ্রেণি সুবিধা ভোগ করেই যাবে। আর আমরা কেবল তাদের সেবক হিসেবে কাজ করে যাবো দাসের মতো। সেইসঙ্গে আমাদের কাছে মনে হতে থাকবে, ‘স্বর্ণহীন জীবন মূল্যহীন!’