তানজীনা ইয়াসমিন চৌধুরী
বাবা পাথর মুখে বসে আছেন। বুঝতে পাচ্ছি তাঁর অ্যাজমার টান উঠছে। কিন্তু ইনহেলার নিতেও ভুলে গেছেন। অথবা ইচ্ছা হচ্ছেনা। ঠেলে আসা বিস্ফরিত চোখে বড় বড় শ্বাস টানা দেখে আমি ইনহেলার নিয়ে বাবার সামনে দাড়ালাম। বাবা অপ্রকৃতস্থের মত মাথা নাড়ছেন। ছোট্ট শিশুর সামনে অপছন্দের খাবার ধরার মত। হতবুদ্ধি অবস্থায় মানুষ অনেক অযৌক্তিক কাজ করে যা স্বাভাবিক অবস্থায় সে কল্পনা করতেও ভয় পায়।
জোর করে ইনহেলার দিয়ে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসিয়ে রেখে মায়ের ঘরে গেলাম।
ডাক্তার ডাকার কিছু নাই , আমি নিজেই ডাক্তার। যা প্রয়োজন করেছি। তবু আমার বউ জুঁই অচেতন মায়ের মাথায় পানি দিচ্ছে , এসির ঘরে বাতাস করছে। কাজের বুয়াটা অনেক পুরাতন। পুঁথি পাঠের মত বিলাপ করতে করতে পায়ে তেল মালিশ করছে। আমার হঠাৎ মনে হলো মায়ের জ্ঞানটা যদি না ফেরে? চরম দুষিত ভাবনার আভাস পানিতে ভাসা বরফের মত আমার চেহারায় ভেসে উঠলো । নাহলে জুঁই এমন অদ্ভুতভাবে তাকালো কেন?
আমি আবার বসার ঘরে এসে বাবার পাশে মেঝেতে বিদ্ধস্ত শরীর ছেড়ে দিলাম । তমালের জন্য এই আশঙ্কাটা আমারই সবচেয়ে বেশী ছিল। বাবা আমার দিকে ফিরছেন। আমার কাছ থেকে সান্ত্বনা জাতীয় কিছু শুনতে চাচ্ছেন। আমি এসবে খুবই অদক্ষ। এমন মুহর্তে ঘাড় গুঁজে থাকা ছাড়া আর কি করা যায় তা কখনোই বুঝে উঠতে পারিনা। তবুও বাবা আমার গুঁজে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। দুঃসময়ে মানুষ খড় কুটোও আঁকড়ে ধরে।
আর আমি বাবার বড় ছেলে। এবং দায়িত্ববান ছেলে।
আমার চোখ জ্বালা করছে। তমালের জন্য না। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে ওঠার জন্য। সকালে পেশার দায়ে হাসপাতালে যেতে হবে। রাতেও ফিরতে দেরী হয়েছে। আমি মেডিসিনের ডাক্তার। আমাদের হাসপাতালে করোনা ইউনিট খোলা হয়েছে। তমালের শোকে বাক্যরহিত হলেও কাজ রহিত হবার উপায় নাই।
আমি সত্যিই চাচ্ছি অন্তত সকালে আমি বেড়িয়ে যাবার আগে মায়ের ঘুম না ভাঙ্গুক। মা আকাশ পাতাল করবেন এবং আমাকে পেশার দায় ফেলে সেই আকাশ পাতালে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করবেন।
মায়ের ভালোবাসা সব সন্তানের জন্য সমান— এই কথাটার আমি একটু ভিন্ন ব্যাখ্যা পাই । ভালোবাসা সমানটা এমন, মা তাঁর সব সন্তানকে সমান দেখতে চান। এই সমান করার তাগিদে তিনি ভরপুর সন্তান থেকে নিয়ে অভাবী সন্তানকে পূরণ করে সমান করতে চাইবেন । অন্যদের কাছে অনাদরের যে বাচ্চাটা তাকে আর দশটা সন্তানের চেয়ে বেশী ভালোবেসে ভালোবাসার কোটা সমান করবেন।
এই কোটা পুরনে অন্য সন্তানের কেমন লাগতে পারে মায়েরা কি ভাবেন ? অনেক মায়ের নিজের জীবনেও এমন নিশ্চয়ই ঘটে , এবং গাল ফুলিয়ে ছোট মেয়েটা সেদিন ভাবে সে কোনোদিন এমন কিছু করবেই না। কিন্তু মা হবার বিশাল প্রক্রিয়ায় সব ভুলে যায় !
ঈশ্বরের নির্দেশে আমি ছেলে। মা হবার সুযোগ নাই। ভালো ছেলে হিসেবে স্বীকৃত, জীবনও পরিপূর্ণ। কাজেই মায়ের ভাগ আমার কম। সেই ভাগ পেয়েছে আমার ছোট ভাই। আমি বড় হয়েছি , বাসা ছেড়ে হোস্টেলে, হলে থেকেছি , মায়ের আগলে রাখা ছোট ছেলের প্রতি স্পষ্ট পক্ষপাত দেখে দেখেই । কিন্তু আমার এই পরিপূর্ণতা আমার মুফতে পাওয়া তো না! তেমন ছোট ভাইয়ের অপূর্নতাও আমার দায় না। তমাল ছোট থেকেই ইচ্ছা স্বাধীন, পড়তে কেন হবেই তাকে , বড়দের কথা কেন মানতেই হবে তা সে কোনোদিন বুঝতে চায়নি। শেষে মেশ পড়তে বা ছাই যা কিছু করতে সে যখন নিউইওর্ক যাবার জেদ ধরলো, তখনো আমার ভাগেই টান পড়লো। দেশের জমির পুরোটা বিক্রির পয়সা।
মায়ের যুক্তি, আমি নিজের ফ্ল্যাট গাড়ি নিজেই করে নেবো । দেশের জমির ভাগে কি দরকার?
নাহ আমার কোনো দরকার নাই। কিন্তু আমার মায়ের আদরের মোটামুটি সমান ভাগটা খুবই কাম্য ছিল। মা শুধু একবার মুখেই বলতো,” তোর ভাগেরটুকুও ওকে দিলাম। ও পরে শোধ না দিতে পারলে তুই দাবী রাখিস না” সত্যিই দাবী রাখতাম না। মা কষ্ট পাবেন এমন কিছুই আমি পারব না।
কিন্তু আজকে মাকে কষ্ট দিতে হচ্ছে। আমি অনন্যোপায় ।
ল্যান্ড লাইনের যুগে অসময়ে বিশেষ করে মাঝরাতে ফোন বেজে ওঠা এক বিশেষ সিম্বলিক শট। কেন যেন দুঃসংবাদ মাঝরাতেই আসতে হয়। তমালের দুঃসংবাদ এই যুগেও মাঝরাতে এলো, তবে সেটা আমার মোবাইলে। নিউইওর্ক থেকে ছোট মামা । তমালের নামমাত্র লোকাল গার্জেন।
তমাল ডর্মেই থাকতো । কোভিড সন্দেহে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল তারই ডর্ম মেট । নিউইওর্কে তখন হাসপাতালে ঠাই নাই। কেবল তীব্র শ্বাসকষ্ট ছাড়া ভর্তি নাই । তবু হাসতালের আঙ্গিনা, লনেও রুগীর ভীর। হাসপাতালে তমালকে নো এন্ট্রি জোনে ঢুকিয়ে নিয়ে সেই বন্ধুকে কর্তৃপক্ষ বিদায় করে দিয়েছে। এরপর কেউ তাঁর খোঁজ পায়নি । ২ সপ্তাহ পর খবর এসেছে , তমাল নেই । সম্ভবত ৪/৫ দিন আগেই সে মারা গেছে এবং নিউইওর্ক কোন এক পার্কের পাশে গন কবরে তাকে দাফন করা হয়েছে।
মাকে কথাটা বলা আমার সম্ভব হয়নি। আমার নার্ভ এত শক্ত না। যেদিন তমাল নিউইওর্কে চলে গেল সেদিনই মাকে অর্ধমৃত মনে হচ্ছিল। আর আজ তাঁর সেই ছেলে মরে গেছে! সে জানেও না কবে কোথায়!
মা হাইপারটেনশন, হাই ব্লাড প্রেশারের রুগী। সংবাদ পেয়ে কাটা কলা গাছের মত পড়ে গেলেন।
হলে থাকার সুবাদে যে কোনো সময় চাহিদামাফিক ঘুমিয়ে পড়ার দক্ষতা আমার আছে। দু ঘন্টা ঘুমিয়ে ভোরে সন্তপর্নে হাসপাতালে চলে এলাম। পিপিই পরে রুগী দেখতে গেলাম। ফোন রুমের দেরাজে লক করে রেখে এসেছি। বেলা ১১টায় জুঁই হাসপাতালে হাজির। আমি হতভম্ব। সে কালে ভাদ্রে আমার অফিসে আসে। আজ কিনা লক ডাউনে!
জুঁইয়ের মুখ কাল বৈশাখীর মেঘের মত থমথমে। হিস হিসিয়ে বলল, মাকে ফেলে কাউকে না বলে তুমি কোন আক্কেলে হাসপাতালে চলে এলে?
রুমে এসে জুঁইকে বসতে বললাম । পিপিই খুলতে হচ্ছে। ঘেমে গসুল হয়ে যাই একেক বারে। ফুল স্পিডে পাখা চালালাম। জুঁই কাঠ হয়ে বসেছে । নাক ও ঠোঁটের মাঝখানে ধনুক ভাজে স্বেদবিন্দু জমে আছে। “চিলেকোঠার সেপাই” মনে পড়ে গেল। হাসপাতালে কলীগদের কারো সাথে কিছু শেয়ার করিনি। সহানুভূতি অস্বস্তিদায়ক। আমরা এই ক্ষেত্রেও খুব অশৈল্পিক । খুঁচিয়ে এক কথা হাজার বার জিগেস করে প্রশমিত ক্ষত উন্মোচন করি , এর কোনো সমাধান দিতে পারবনা জেনেও ! চেয়ারে বসে ঠান্ডা গলায় বললাম, আমি বাসায় থেকে কি করতে পারতাম ? বরং এখানে আমার জন্য রুগী পড়ে আছে । সকালে না বলে এলে মা আমাকে আসতে দিতো ?
জুঁই এখনো রাগে কথা বলতে পারছেনা । বড় বড় শ্বাস টেনে রাগের পারদ নামাচ্ছে । থেমে থেমে মুখ খুললো, একটা কোরান খতমের ব্যাপার আছে, দোয়া খায়ের …। আমি জানিও না দূরে এমন করে ঘরের মানুষ মারা গেলে ,তার বডিও আনা না গেলে কি করতে হয়। তুমি এইসময়ে বাবা মায়ের সাথে থাকবে না ? তোমার একটাই ছোট ভাই ! এতোটা পাষাণ হও কিভাবে?
আহা। পাষাণ ! শরতবাবু মনে হয় এমন শব্দ বেশী ব্যবহার করতেন। কারন তাঁর গল্পে ও পাঠকে নারীপ্রাধান্য থাকতো। আজ না এলে যদি আমার দায়িত্বে থাকা রুগী কারোর কিছু হতো তখন সর্বনিম্ন এই গালীটাই শুনতে হতো ! বাকীটা ইতিহাস। তাও ভাগ্যিস প্রাইভেট প্র্যাক্টিস এখন বন্ধ ।
মা আহাজারী মাতম ক্রন্দন যা যা সম্ভব করলেন।
অনশনে চলে গেছেন। এয়ারপোর্ট বন্ধ, বর্ডার লক— কোনো যুক্তি গ্রাহ্যতায় সে নাই। যে করেই হোক তিনি নিউইয়র্ক যাবেন। তাঁর ছেলের কবর খুঁজে দেখবেন। আমি প্রেশার মেপে ওষুধ খাইয়ে আশ্বস্ত করে শুইয়ে দিলাম।
পরদিন হাসপাতালে এনে ভর্তি করালাম। এই বেডে আগে যে রুগী ছিলেন তাঁর মৃত্যু অন্য অসুখে হলেও বর্তমান সময়ের নিয়মামাফিক করোনা টেস্টও দিতে হয়েছে। রিপোর্ট দেরীতে এসেছে । করোনা পজিটিভ। কেউ খেয়াল রাখে নি। আমিই দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম। মাকে খুব যত্ন করেই সেই বেডে রাখলাম।
নার্স ঘন্টায় ঘন্টায় মায়ের রিপোর্ট দিয়ে গেলেন। জর, শ্বাসকষ্ট, শুকনো কাশি…।
আমি মায়ের অতি বাধ্য ছেলে । মায়ের কথা ফেলতে পারি? মা তাঁর প্রিয় ছোট ছেলের কাছে যেতে চান। আমাকে তার জন্য যা কিছু সম্ভব আমার এক পৃথিবী উজার করে, স্নেহের আকাশ কাঙ্গাল করে হলেও করতে হবে।