বাবলু ভট্টাচার্য
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন থেকে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। অনেক ভালো লাগা জিনিসই বড় হয়ে গেলে আর ভালো লাগে না। দুর্গাপূজাও কি সেই ভালো না-লাগার তালিকার একটা! একা আমারই কি পূজার মজাগুলো ম্যাড়মেড়ে, পানসে লাগে ? আর কি মনে ধরে না সেই ছোটবেলার মতো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনেকেই খুঁজে ফেরেন। একা আমি নই, অনেকেই ভোগেন একটা অতৃপ্তিতে। বোঝেন আনন্দ ঠিক কোথা থেকে আসে, বোঝেন আনন্দের উৎস শুধু হুল্লোড় নয়। আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছুই চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। মনে মনে নিজেই তার একটা তালিকা তৈরি করেছি। এই হারিয়ে যাওয়া, ক্ষয়ে যাওয়া, পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া, তলিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কবে থেকে শুরু হলো কে জানে !
অনেকে বলেন, ষাটের দশকের গোড়া থেকে। বিষয়টাকে অর্থনীতির নিরিখে বিচার করে তারা বললেন— এক আনা, দু’আনা, চার আনা, ষোল আনার বদলে নতুন দশমিক পদ্ধতির টাকা-পয়সা যখন ধেয়ে এলো, অচল হয়ে গেল তামার পয়সা, ফুটো পয়সা, তখন থেকেই বাঙালির মানসিকতা পরিবর্তিত দোলা তৈরি করে এখনও? কিন্তু এই পাল্টে যাওয়া তো একমুখী নয়।
পাল্টে গেছে পূজার ফ্যাশন, পূজার ধরণ সবকিছুই। ফ্যাশনে রেডিমেড পোশাকের চল এতটাই বেড়ে গেছে যে পাড়ায় পাড়ায় যেসব দর্জির দোকানগুলো ছিল সেগুলোর অধিকাংশ এখন উঠেই গেছে। আমার ছোটবেলার পূজার ফ্যাশনের স্মৃতি বলতে থান কিনে দর্জির দোকানে দিয়ে বানানো মাপসই সুতির জামা-কাপড়। যেটা একটু একটু করে গ্রাস করে নিয়েছে রেডিমেড পোশাক বিপ্লব।
এভাবেই পাল্টেছে মণ্ডপ-সজ্জা, প্রতিমা-সজ্জা, শৈলী। এমন কি পারিবারিক পূজা থেকে বারোয়ারী পূজার পরিবর্তন। এখন পূজা মানে পৃথিবীর বিভিন্ন বিখ্যাত মনুমেন্টের অনুকরণে তৈরি প্যান্ডেলের জোয়ার। সে আরও বীভৎস!অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন— দেখেছ, সামান্য কারিগর কাপড় আর কাঠ দিয়ে কী অভাবনীয় কাজ করেছে !
আমি কোনোদিনই এগুলোকে দেখে উল্লসিত হইনি। বরং ভেবেছি, যে-শিল্পীরা এমন অনুকরণ করতে পারেন, তাদের দিয়ে কোনো মৌলিক শিল্পিত কাজ করালে ক্ষতি কি হতো!
পূজার ক’টা দিন আনন্দে আর মেতে উঠতে পারি না। ছোটোবেলার সেই মজা, সেই আনন্দ আর পাই না। বিশাল বিশাল মণ্ডপের সামনে লম্বা লম্বা লাইন ঠেলে জৈলুসপূর্ণ প্রাণহীন সেই পূজা দেখা আর ছোটোবেলায় আমার গ্রামের বা মামার বাড়ির গ্রামের সেই ঢাকের সাজের মাতৃগন্ধময় পূজা— এ দুটোর মধ্যে কোনো মিল পাই না আমি।
পূজার দিনগুলোতে তাই আমার কাছে মণ্ডপমুখী হওয়ার চেয়ে লেখাপড়া করে কিংবা শহর থেকে অনেক দূরে গিয়ে নিজের মতো করে সময় কাটানো অনেক বেশি সুখকর, স্বস্তিদায়ক।
ফেলে আসা দিনগুলোর সঙ্গে এখনকার পূজার তুলনা করলে মন খারাপ হয়ে যায়। অনেক কিছুই মেলে না। ‘ঐতিহ্য’ শব্দটাকে নড়বড়ে মনে হয়। আবার এ কথাও ঠিক, দুর্গাপূজা আমাদের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিলে বাঙালির সংস্কৃতি বলে আর কিছুই থাকবে না। আসলে দুর্গাপূজা বাঙালির জীবনে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু যেখানে বাঙালিই পাল্টে গেছে গ্লোবালাইজেশন নামক এক ছায়াময় তত্ত্বকথায় পা মেলাতে, সেখানে তার জীবনের অঙ্গ দুর্গাপূজা পাল্টাবে না— এমন আশা করাটাই তো বোকামি।