সত্রাজিৎ গোস্বামী
ছেলেবেলায় ইস্কুলের এক মাস্টারমশাই আমাদের বলেছিলেন, “যতদিন বাঁচবি, প্রশ্ন করে যাবি। প্রশ্ন না করলে কিছুই ভালো করে শিখতে পারবি না। যেখানটায় খটকা লাগবে, সেখানেই জিজ্ঞেস করে ভালো করে বুঝে নিবি।” সেই থেকে হাজার হাজার খটকা আর হাজার হাজার প্রশ্ন গিনিপিগের বংশবৃদ্ধির মতো আমার মাথায় জমা হয়েছে।
মাস্টারমশাইয়ের আশকারা পেয়ে তখন আমাদের ক্লাসে প্রশ্ন করার ধুম লেগে গিয়েছিল। কথায় কথায় এমন প্রশ্ন করতে গেলে অন্য মাস্টারমশাইদের কাছে কানমলা আর গাঁট্টা খেতে হবে বুঝে নিয়ে যত উৎপাত ওই একটা ক্লাসেই আছড়ে পড়ত। দুষ্টু ছেলেদের কাছে ওই প্রশ্ন করাটা ছিল ক্লাস পণ্ড করার একটা অস্ত্র। সেই প্রশ্নের ঠেলা সামলাতে গিয়ে ক্লাসের পড়া আর এগোতে পেত না। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, হেডমাস্টারমশাই ওই ক্লাসে নিয়ে এলেন অন্য মাস্টারমশাইকে। সেই থেকে বেরোনোর পথ না পেয়ে বেয়াড়া প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যেই গজগজ করছে। আজ এতদিন পরে মনে হচ্ছে, উত্তর পাই বা না-পাই, প্রশ্নগুলোর মধ্যে থেকে অন্তত কয়েকটা এলোমেলো প্রশ্ন মানুষের মধ্যে ছুঁড়ে রাখা ভালো। পরের প্রজন্মের কেউ না কেউ এগুলোকে ‘পাগলের প্রলাপ’ না মনে করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবে হয়তো বা।
যেমন ধরা যাক, ছোটোবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের ইতিহাসে শেখানো হয়, ১৭৬৫-তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেছিল। আমরাও ইতিহাসে তা-ই পড়েছি। কিন্তু খট্কা হলো, আঠেরো শতকের ওই সময়ে তো ওড়িশা মারাঠাদের জিম্মায়। ১৮০৩ সালের আগে কোম্পানি সেখানে দাঁত ফোটাতেও পারেনি। তাহলে কোম্পানির সেখানে দেওয়ানির চেহারাটা ঠিক কেমন ছিল? মানলাম, মেদিনীপুরের একটা অংশ তখন ওড়িশারই অন্তর্গত ছিল, আর সেই অংশটা মোগলদের হাতেই ছিল। তাহলে কি কোম্পানি বা কোম্পানির দেশীয় কর্মচারীরা মূল ওড়িশায় কোনো কারবারই চালাতে পারতো না? এই প্রশ্নের উত্তরটা শেষ বেলায় এসে খুব জানতে ইচ্ছে করে।
তারপরে ধরুন, এত বচ্ছর হয়ে গেল, রবিঠাকুরের সেই ‘ছিন্নপত্রাবলী’ বইটা আজও পর্যন্ত ‘ছিন্ন’ই রয়ে গেল কেন, সে রহস্যেরও কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না কোথাও। বিশ্বভারতীর অভিলেখাগারে আজও কেন শোভা পাচ্ছে ইন্দিরা দেবীর টুকে দেওয়া দুটো খাতা, যেখানে আছে কেবল চিঠিগুলোর নির্বাচিত অংশ। তাহলে আসল চিঠিগুলো কোথায় গেল? কত অখ্যাত মানুষ বিশ্বভারতীর সংগ্রহশালায় রবিঠাকুরের কত পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, কত খসড়ার কাগজ জমা দিলেন, অথচ কবির প্রিয় বব্, মানে ইন্দিরা দেবী কেন মূল চিঠিগুলো জমা দিলেন না? কেন কেউ সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টাও করলেন না এপর্যন্ত?
আচ্ছা, আপনি মুকুন্দ চক্কোত্তিকে চেনেন তো? সেই যিনি চণ্ডীমঙ্গল লিখেছিলেন? অনেক বিদগ্ধ গবেষক মুকুন্দ কোথা থেকে কোন্ পথে কোথায় পৌঁছেছিলেন, বহু পরিশ্রমে তার হদিশ দিয়েছেন। এমনকি তোডরমলের নতুন ভূমিরাজস্ব নীতিটাকে কেন সাধারণ প্রজারা ভুল বুঝে পালানোর ফিকির খুঁজেছিল, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন কেউ। কিন্তু, যেখানটায় কালকেতু নতুন নগর পত্তন করেছিল চণ্ডীদেবীর আশীর্বাদে, সেই গুজরাট নগরের হদিশ আজও পেলাম না! তাঁর চেয়েও বড়ো খটকা, কালকেতুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই তো বনের পশুরা দেবী চণ্ডীর শরণাপন্ন হয়েছিল! তাহলে শেষ পর্যন্ত সেই সাধারণ ভক্ত পশুদের বেমালুম ভুলে গিয়ে দেবী কালকেতুর প্রতি এমন উপুড়হস্ত হলেন কেন? নাকি, আধুনিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির এক আগাম সংকেত রেখে গেছেন মুকুন্দ আমাদের কাছে!
বেশি ঘ্যানঘ্যানের সুযোগও নেই, আর লম্বা প্রশ্নপত্র কারো পছন্দও নয়। তাই আর একটা খটকার কথা বলেই আপাতত ইতি টানি। শেষ খটকাটা হলো, বৃহৎ বাংলার বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষগুলো চর্যাপদে যে কথাগুলো বলতে চেয়েছিল, যতই তা সহজিয়া ধর্মমতের কথা বলুক না কেন, বাস্তব পরিস্থিতি সেখানে তেমন আড়ালে পড়েনি। কিন্তু মুনিদত্তের টীকায় সে-সব সোজা কথা এমন ঘোরালো তত্ত্বকথার চেহারা নিয়েছে যে, মাথায় ঢোকানো অসম্ভব। তাহলে কি, এটা উচ্চতর বর্গের একটা কৌশল ছিল? সোজা কথাকে দুরূহ করে তুলে কি বড়ো সমাজবিপ্লবকে রুখে দিতে চেয়েছিলেন মুনিদত্ত? চৈতন্যের ক্ষেত্রেও কি তেমনটাই ঘটেছিল? পরবর্তী গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের জটিল ব্যখ্যার চোটে অনেকটা সেরকমই মনে হয় নাকি?
জীবনের সন্ধেবেলায় অন্তত আপাতত এই ক’টি খটকার উত্তর পেলে আত্মার কিছুটা শান্তি হতো আর কি। সেই ছেলেবেলার মাস্টারমশাইকে অন্তত ডেকে বলে যেতে পারতাম, “মাস্টারমশাই, আপনাকে কিন্তু আমি ভুলিনি কোনোদিনই।”