বিষ্ণু সরকার
আমার তো কোন অসুখ ছিল না, তবু কেন…।
জানতে চেয়েছিল সে। কোন উত্তর মেলেনি। হয়তো কারুর কাছেই কোন উত্তর ছিল না সেদিন।
সে কিন্তু আরও কিছু বলেছিল। বলেছিল নিজের কথা। বাড়ির কথা। বাবা মা, স্ত্রী, একমাত্র সন্তানের কথা।
জানতে চেয়েছিল ওরা কোথায় আছে, কেমন আছে।
সে প্রশ্নের জবাব পায়নি। আসলে জবাব দেওয়ার কাউকেই খুঁজে পায়নি সে।
দরজা জানালা বন্ধ এই ঘরটাতে আসবার পর থেকেই কত শত শত প্রশ্ন ওর মাথায় ঘুরপাক
খেয়েছে। যেগুলি হয়তো এই চার দেওয়াল ভেদ করে খোলা আকাশের নিচে ছুটে যেতে চাইছে
প্রবলভাবে। কিন্তু পারছে না।
প্রথম প্রথম ওর বুকের ভেতরে ভীষণ যন্ত্রণা হত। এখন ব্যাথাটা বাড়তে বাড়তে যেন বিছানার
সঙ্গে মিশে গেছে। কখনো কখনো ওর এটাও মনে হয়েছে, বুঝি বেঁচে নেই। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই চোখ
খুলে, হাত পা নাড়াতে দেখে বুঝেছে, সে তো বেঁচেই আছে। আর এই ঘরে আছে নির্দিষ্ট বেডটিতে
শুয়ে।
এই ঘরে কোন জানালা নেই। দরজাটাও কতদিন খোলেনি কেউ।
ঠিক কতদিন এই ঘরে রয়েছে সে? দুদিন-তিনদিন। একসপ্তাহ-দুসপ্তাহ। এক মাস-দুমাস। এক বছর-
দু বছর। ভাবনাটা এলেই মাথাটা কেমন ধরে আসে ওর। বমি পায়। মনে হয়, শরীর বুঝি প্রবল
উত্তাপ ছড়িয়ে দেবে।
এক-এক সময় ওর এটাও মনে হয়েছে, সে আসলে কে? কোথা থেকে এসেছে? আদৌ কি সে মানুষ?
নাকি ভিনগ্রহী কোন প্রাণী। নাকি সে পৃথিবীতে নেই। অজানা-অচেনা গোপন কোন গ্রহে কেউ বুঝি
ষড়যন্ত্র করে লুকিয়ে রেখেছে।
কিন্তু কেন? ওর কি কোন শত্রু ছিল? উত্তর দেবে কে। এই ঘরে ও ছাড়া আর তো কেউ নেই। হ্যাঁ,
একজন ডাক্তার এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সে তো কোন উত্তর না দিয়েই চলে গেছে। এখন মনে হচ্ছে,
সে তো কোন কথা বলার অবস্থাতেই ছিল না। ওর সারা শরীর ঢাকা ছিল এক অদ্ভুত পোশাকে। নাক
মুখ জুড়ে ছিল অজস্র নল। যেগুলির কোনটা দিয়ে খাবার নিচ্ছিল, কোনটা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস। আর
পুরো মাথাটাই ঢাকা ছিল কাচের হেলমেটে। ও সবকিছু দেখছিল, সবকিছু বুঝছিল। কিন্তু ওর কথা
কেউ বুঝছিল না। হয়তো শুনতেই পারছিল না কেউ।
ব্যাপারটা এরকম হওয়ার আগে সে কিন্তু বেশ ছিল। অন্তত ঘুরত বেড়াত এদিক-সেদিক। চেনা
অচেনা বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিত। মন খুলে মনের কথা বলত। মাঝে-মধ্যে একটু আধটু
ড্রিঙ্ক। স্ত্রী আর দু’বছরের ফুটফুটে সন্তানকে স্নেহ করত। কত মায়া পড়ে আছে ওদের জন্য।
একটা ভালো অফিসও ছিল ওর। সহকর্মী, বস এমনকি ঢুকতে বেরোতে নিরাপত্তার কর্মী পর্যন্ত।
কত কথা। কত আলাপ। ওখানের টেবিল চেয়ার জুড়েও সেই একই স্পর্শ। বাড়িতে ফিরে আবার
‘বাবা’ ডাক শুনে তৃপ্ত হওয়া। একটার পর একটা ঘটনা, চরিত্রগুলি সে এই বদ্ধ ঘরের বেডে শুয়ে
দিব্বি দেখতে পাচ্ছে। সবটাই স্পষ্ট। শুধু মেলাতে পারছে না, কিভাবে সে এখানে এসেছে। তার পরের
দৃশ্যটাকে।
এই ঘরে একটা ঘড়ি অবশ্য আছে। যদিও দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। সে স্পষ্ট শুনতে পায়
ঘড়ির কাঁটা গুলি ঘুরছে। ঘন্টা মিনিটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেকেন্ডের কাঁটাটা স্পষ্ট নড়ছে। সশব্দে
নড়ছে দমওয়ালা ঘড়ির মতো। কিন্তু সে তো ওদের মত নয়। কিভাবে উঠে বসবে এই নাক মুখে
জড়িয়ে থাকা সমস্ত কিছুকে ছুঁড়ে ফেলে। ওই না খোলা দরজাটা টপকে এক ছুটে বাইরের বিশুদ্ধ
জগতে। বেরিয়ে হয়তো দেখতে পাবে ওর জন্য অপেক্ষা করছে গোটা পরিবার। বন্ধুদের দল।
অফিসের সিকিউরিটির লোকটা। হয়তো মায়ের কোলে বসে ‘বাবা বাবা’ করে ডাকতে থাকা প্রিয়
সন্তানটি পর্যন্ত।
দুই.
তখন কি সে ঘুমিয়ে ছিল? নাকি কিছু ভাবছিল? মনে হল কেউ বুঝি ডাকল কয়েকবার। সেই প্রথম
মনে হল, অনুপম নামটা ওর। খুব কাছ থেকে ওকে এই নামে ডাকছে কেউ।
ও প্রান্ত জানতে চাইল, অনুপম তুমি কেমন আছো?
সে বলল, আছি, হয়তো বেঁচে।
তুমি কি তোমার বাড়িতে ফিরে যেতে চাও অনুপম?
সে নড়েচড়ে ওঠে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু কিভাবে?
তাহলে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো। তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেই বাড়ি ফিরতে পারবে। আমরা
সব ব্যবস্থা করে দেবো।
কতদিন? আর কতদিন আমাকে এভাবে থাকতে হবে বলতে পারেন?
হয়তো দু সপ্তাহ। কিংবা আরও কিছুদিন।
সে দিন, সপ্তাহের হিসেব গুলিয়ে ফেলে। শুধু ওপ্রান্তের অস্পষ্ট মুখটা, তার ভেসে আসা
শব্দগুলিকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করে।
আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
তুমি তো নিজেকেও দেখতে পারছ না অনুপম।
সে নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। সত্যিই তো নিজেকে দেখতে পারছে না!
আমি আমাকে দেখতে পারছি না কেন বলুন তো?
সুস্থ হয়ে উঠলেই পারবে। এখন তোমাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তোমার আইসোলেশন চলছে। শরীরে
অক্সিজেনের মাত্রা খুব কম।
কেন হল এ অসুখ?
এতে তোমার কোন দোষ নেই অনুপম। রোগটা তোমাকে দিয়েছে তোমার বন্ধুরা। তোমার অফিসের
কলিগরা। তারাও পেয়েছে অন্যদের থেকে। এ অসুখ স্পর্শ থেকে ছড়ায়। তুমি যার সঙ্গে মিশেছ,
চলেছ, সবাই তোমাকে অসুখটা দিয়েছে। তুমিও হয়তো অজান্তে অন্য কাউকে…
তাহলে আমার পরিবার? আমার সন্তান? ওদেরও কি…
কিছুই বলা যাচ্ছে না। আপাতত ওরাও পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
আমি কি ওদের সঙ্গে একবার…
তার পারমিশন নেই অনুপম।
আচ্ছা, কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক? যে দিয়ে দ্রুত ভালো হওয়া যায়।
এ অসুখের কোন ওষুধ নেই অনুপম। থাকলে অনেক আগেই তোমাকে, তোমার বন্ধুদের দেওয়া হত।
অদৃশ্য কথারা শূন্যতায় ভেসে যায়। একবার, দুবার, বেশ কয়েকবার ডাকাডাকির পরও আর উত্তর
পাওয়া যায় না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে ওর। সেই সঙ্গে প্রবল একটা শ্বাসকষ্ট। তার
মধ্যেই হাতড়ে বেড়ায় সে। অসুখটাকে, ওর শরীরে দানা বাধা জীবাণুগুলিকে। যেন এক্ষুনি এক-
একটাকে বেছে বেছে গলা টিপে ধরবে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে।
তখনই প্রবল আলো ছড়িয়ে ওদের দিকে ছুটে আসে একটা আম্বুলেন্স। পেছন পেছন কয়েকটা পুলিশ
গাড়ি। ডাক্তার, নার্স, পুলিশের দল ঘিরে ধরে ওদের। জানতে চায়, ওদের মধ্যে অনুপম কে?
মায়ের কোলে সন্তানকে তুলে দিয়ে সামনে দাঁড়ায় অনুপম।
আপনি কি সফটওয়ার সলিউশনে কাজ করেন?
হ্যাঁ। কিন্তু কেন বলুন তো?
আপনি কি জানেন, আপনার অফিসের সবাই রবিবার রাত থেকে আইসোলেশনে? আপনিও তো ওদের
সঙ্গে অফিস করেছেন। শনিবার বিকেল পর্যন্ত একসঙ্গে থেকেছেন।
হ্যাঁ, কিন্তু…
আপনাকে এক্ষুনি আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
কোথায়?
কোরেন্টাইনে। এটা গভরমেন্ট অর্ডার। ওখানে আপনার টেস্ট হবে। নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত
কয়েকদিন থাকতে হবে।
মুহূর্তেই যেন সবকিছু ছিটকে যায় ওর কাছ থেকে। সরে দাঁড়ায় অনেক অনেকটা ব্যবধানে। মনে হয়,
সে হঠাৎ একা, একদম একা। গোটা পৃথিবীটা সরে গেছে অনেক দূরে। একমাত্র সন্তানের ‘বাবা’
ডাকটা শুনতে পায় সে। নার্স-ডাক্তাররা প্রায় জোর করেই তুলে নেয় অ্যাম্বুলেন্সে। পেছনে
সন্তানের হাত। তার পরের দৃশ্যগুলি ক্রমশ ঝাপসা।
সে লাফিয়ে ওঠে। জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে।
অনুপম…
আবারও সেই কন্ঠস্বর।
শান্ত হও অনুপম।
কিভাবে শান্ত হব বলতে পারেন। আমার পরিবার, স্ত্রী-সন্তান কেউ আমাকে দেখতে পারছে না।
আমিও ওদের দেখিনি কতদিন। না জানি ওদের থেকে কত দূরে আমি! আদৌ কি আর ফিরে যেতে
পারব?
ফিরতে তো তোমাকে হবেই।
কিন্তু কিভাবে?
সবাই যেভাবে ফিরে যায়, সেভাবে।
সে আবার উঠে বসতে চায়। এই বাঁধন খুলে, এই চার দেওয়াল পেরিয়ে, অনেক অনেক দূরে ছুটে যেতে
চায়।
ও অনেক কিছু দেখতে পায়। ঠিক ছেলেবেলার মত। সেই দলবেঁধে লুকোচুরি খেলা, সেই ফুটবল,
ডাংগুটি। পাড়ার গাছ থেকে ফল চুরি করে খাওয়া। একদিন সবাই মিলে দলবেঁধে খিচুড়ি, পায়েস রান্না।
আবার শীত এলে হৈ হৈ করে মেলার মাঠে গরুর গাড়ির দৌড় দেখতে যাওয়া।
বারবার সন্তানের মুখটা ফুটে উঠতে চায়। মনে পড়ে যায় মিতার কথা। ওকে প্রথম দেখার কথা।
বিয়ের রাতের কথা। নার্সিংহোমের বেডে ওর পাশে প্রথমবার সন্তানকে শুয়ে থাকতে দেখার কথা।
অনুভূতিগুলি বুকে জড়িয়ে বাঁচতে চায় সে। একদিন দুদিন নয়, একবছর দুবছর নয়, যেন অনন্তকাল।
তিন.
‘আমি ফিরতে চাই, ফিরে যেতে চাই… কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন।’ সে চিৎকার করতে থাকে। ‘আমি
মুক্তি চাই, এই দমবন্ধ ঘর আমাকে মেরে ফেলবে, প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।’
অদৃশ্য কণ্ঠস্বর কখন যে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় তুমি কোথায় ফিরবে অনুপম?
কেন আমার বাড়িতে, আমার পরিবারের কাছে, বন্ধুদের কাছে।
ওরা কি তোমায় আর ফিরিয়ে নেবে?
কি বলছেন আপনি? জানেন ওরা আমাকে কত ভালবাসে, কতটা চায়?
জানি।
তবে?
এই অসুখ পেরিয়ে তোমার মুক্তি যে বড় কঠিন অনুপম।
তাহলে কি আর কোনদিন…
ঘর ভর্তি একরাশ আলো অন্ধকার ভেদ করে একটা তেঁতুল গাছ, তার চারপাশে দলছুট শৈশব
প্রবলভাবে কোলাহল তৈরী করে আবার। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সেই ধ্বনি চারদিকে ছড়িয়ে যায়।
নাড়িয়ে যায় আকাশ-বাতাস। সে একটা ঘ্রাণ পায়। অনেকদিনের হারিয়ে যাওয়া সেই অদ্ভূত ঘ্রাণ।
ঠিক যেন পলিমাটি থেকে উঠে আসা অথবা সদ্য কোদালের মাথায় জড়িয়ে থাকার মত। সে
রোমাঞ্চিত হয়। ইচ্ছে করে বৃষ্টি এলে একবার ভিজতে। মাটির কাছাকাছি যেতে।
কখন যে ডাক্তারটি আবার ফিরে আসে। এসে দাঁড়ায় ওর বেডের কাছে। সে অবাক হয়ে দেখে, ওর
নাক, মুখ, শরীরে জড়িয়ে থাকা সবকিছুকে কিভাবে খুলে ফেলে নিমেষে।
বলে ওঠে, এসবের আর কোন প্রয়োজন নেই। আপনি এখন বিপদমুক্ত। তবে ফাইনাল রিপোর্টটা
হাতে এলেই অফিশিয়ালি ছুটি পাবেন।
ডাক্তারবাবুর কথাগুলি জুড়িয়ে দেয় ওর কান, ওর শরীরকে। এও কি কোন স্বপ্ন? নাকি দুঃস্বপ্ন
পেরিয়ে মুক্তির পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা।
হঠাৎ করেই মনে হয় ধু ধু মরুপ্রান্তর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর গলা শুকিয়ে আসছে। অথচ চারদিকে
কেউ নেই, কিছু নেই। জল দেবে কে? মানব সভ্যতাকে যেন বহু বহু যুগ পিছনে ফেলে এসেছে। হাঁটছে
রাজপথ দিয়ে। এখানে পা ফেলে আরও চমকে যাচ্ছে সে। ওর দুচোখ জুড়ে শুধুই শুন্যতা আর সীমাহীন
হাহাকার। চারদিকে নিশ্চল-নিশ্চুপ জীবনধারা বহুদূর পর্যন্ত শুধুই খাঁ খাঁ করছে। দোকান, বাজার,
অফিসচত্বর সব যেন তালাবন্দি হয়ে গিয়েছে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সময় বুঝি থমকে দাঁড়িয়ে
আছে। কোথায় মানুষ? কোথায় প্রাণ? এ কোন পৃথিবীকাল। শিশুদের কোলাহল নেই। কথা নেই। পথ
জুড়ে মানুষের পদচারণা নেই। ধ্বনি নেই, প্রতিধ্বনি নেই। ভিড় নেই। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসা
চিৎকার নেই। মিটিং নেই। মিছিল নেই। শ্রমিক নেই। কৃষকের গা ভেসে ফুটে ওঠা ঘাম পর্যন্ত
নেই।
সে আবার চিৎকার করে ওঠে। এই নীরবতা, এই জনমানবহীন শূন্যতা, কত যে তীক্ষ্ণ, কত
ধারালো, একটু একটু করে ওর শরীরকে বিদ্ধ করতে চায়। মনে হয়, সে বুঝি কালা বোবা হয়ে যাবে।
অথবা সমস্ত বর্ণ রঙ হারিয়ে অন্ধ। এ যে কি দুর্বিষহ…
কি ভেবে একবার পিছন ফিরে তাকায় সে। ঘুরে দাঁড়ায় ফেলে আসা রাজপথের দিকে।
দেখে, একটা সমুদ্র ঢেউ তুলতে তুলতে ধেয়ে আসছে এদিকে। সে একটা ভেলা খুঁজতে চায়। ভেসে
থাকার জন্য। এই নোনা জল আর ফেনা তোলা বুদবুদ ডিঙিয়ে প্রিয় পরিবার, সন্তানের কাছে
পৌঁছানোর জন্য।