শৈলেন সরকার

একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করা উচিত? শুধু তো বয়স্ক নয়, একেবারে একশ’ আট।
একশ’ আট? না, এতে নাকি অবাক হওয়ার কিছু নেই, এই দ্বীপে একশ’র উপরে আরও অন্তত সাত-আট— ।
আশি-নব্বই তাও অন্তত বারো-চৌদ্দ। আলাউদ্দীন ইলেকশান করা ছেলে। পঞ্চায়েত-বিধানসভা করে করে
সবার বয়স, বাবার নাম, পাড়া— । তবে অমল ত্রিপাঠী একেবারে হায়েস্ট। আর একটা কথা, এই দ্বীপে সবাই
কিন্তু মেদিনীপুরের। সেই তেতাল্লিশের মন্বন্তরে মেদিনীপুর থেকে আসা।
মন্বন্তরের কথা অবিনাশ জানে। পড়েছে বই-পত্রে। হাজার-হাজার মানুষ মরেছে, হারিয়েছে আর হ্যাঁ,
বিক্রিও হয়েছে। দাদুর কথা মনে পড়ে অবিনাশের। বাবার বাবা। এক দিদির কথা ভেবে কাঁদত খুব।
মানুষ কখনও বিক্রি হতে পারে? অবিনাশ ভয় পেত। ওকেও কি কেউ বিক্রি করে দিতে পারে? সেই
দিদি নাকি আগলে রাখত দাদুকে। সেই ছোটবেলায়। এক্কা-দোক্কা খেলত ভাইকে নিয়ে। আম বা জামরুল
পেলে গুঁজে দিত ভাইয়ের হাতে। সেই বাড়িটার কথাও বলত দাদু। উঠোনের সেই এক্কা-দোক্কার কোট,
নিমগাছ, চালতা। গাছভরা আমের মুকুল, ঘ্রাণ। পুকুর, পুকুরে মাছরাঙার ঝুপ। দাদু যেন তখনও সেই
উঠোনেই। নিমের ছায়া মাথায় নিয়ে এক-পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে একটা করে কোট পার হওয়া। ঝোপের
আড়াল থেকে একটা কোনও পাখি তখন কুব—কুব—কুব ডেকেই যাচ্ছে। মা বলত, ‘তোর দাদুর সেই
দিদি তো বিক্রি হয়েছিল খিদের জ্বালায়। অনেকগুলি পেটের খিদে। না খেতে পেয়ে তখন তো মরছে
সবাই, মরেছে তোর সেই দাদুর এক ভাইও। শেষমেশ তোর দাদুর বাবা কোনও উপায় না পেয়ে— ।’
দাদুর কাছে জানতে চাইত অবিনাশ, ‘দেখা হয়নি আর?’ এক একদিন রাতে বিছানায় শুয়ে দাদুর সেই
দিদিকে দেখতেও পেত যেন। যেন উঠোনের সেই এক্কা-দোক্কার কোট, নিমগাছ, চালতা। আমের মুকুলের
ঘ্রাণ। পুকুর, পুকুরে মাছরাঙার ঝুপ। কোন ঝোপের আড়াল থেকে একটা কোনও পাখি তখন ডেকেই
যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেও কত দিন সেই ডাক শুনেছে অবিনাশ। কুব-কুব-কুব।
দাদু যেমন আগলে রাখত অবিনাশকে, অবিনাশও। দাদুর গল্প শুনত হাঁ করে, বলত, ‘বড় হয়ে একদিন
ঠিক তোমার দিদিকে খঁজে আনব দেখো।’ দাদুর লাঠি হাতে নিয়ে অবিনাশ বলত, ‘এটা দিয়ে তোমার
বাবাকে— ।’ দাদুর মৃত্যুর এখন কত বছর যেন? কিন্তু এত সব কথা এতদিন কীভাবে ভুলে থাকল
সে? দাদুর সেই দিদি নাকি বুঝতেই পারেনি কিছু। বিয়ের নাম করে। মায়ের কথায়, তখন তো আট-
নয় বয়সেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সব মেয়ের। দশ-বারো হলে তো বদনামে পাড়া মাথায় উঠত। দাদুর সেই
দিদির নামটা কী যেন? স্কুলে পড়ার দিনগুলি ছাড়িয়ে আসার পর সব কেন ভুলে গেল অবিনাশ? মা
মনে রেখেছে? মনে থাকবে? জিজ্ঞেস করবে মাকে? কিন্তু এখন কী দিয়ে কথা শুরু করব? বাড়ি
কোথায় ছিল? গ্রাম, থানা। বা বাবার নাম, মা, স্কুল। অমল ত্রিপাঠীকে ঘিরে তাঁর নাতি-নাতবউ-
ছেলে। একেবারে ছোটরা নিশ্চিত নাতিদের ছেলেপিলেই হবে। ভদ্রলোক বললেন, কাল রাতে তো আপনার
সঙ্গেই— ? ঘাড় নাড়ল অবিনাশ। বলল, মেলার মাইকে আপনার কথা শুনে আপনাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল
খুব। হাসলেন ভদ্রলোক। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কোন বাড়িতে উঠলেন? কোলকাতা থেকে এসেছেন তো?
আলাউদ্দীনকে দেখাল অবিনাশ।
কোন বাড়ি আপনাদের?

আলাউদ্দীনকে চিনতে পারছেন না ভদ্রলোক। এখানে অবিনাশ বা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা সবাইই ওঁর
বয়সের অর্ধেকেরও কম হওয়া সত্ত্বেও উনি কিন্তু তুই বা তুমি ব্যবহার করছেন না একবারও। আপনি।
আলাউদ্দীন ওর আব্বার নাম বললে ঘাড় নাড়লেন ত্রিপাঠীবাবু।
ওরা বলছে একশ’ আট, বা ভোটার লিস্টেও একশ’ আট, আমার বয়স কিন্তু আরও বেশিও হতে পারে।
বেশি মানে কত?
অবিনাশ এই এতক্ষণে কথা বলার সুযোগ পেল। জিজ্ঞেস করল, ‘বড় ছেলের বয়স?
ঘরের মধ্য থেকে একজন কেউ বলে উঠল, ‘আমার এটা পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন।’ অর্থাৎ ওঁর বড়ছেলেই।
বাইরে বাতাসের শব্দ উঠল তালগাছে। যেন গা-মোড়ামুড়ি করছে কেউ। যেন এই কেউ গড়িয়ে পড়বে।
উত্তরের বাতাস। ত্রিপাঠিবাবু বললেন, ‘শীত যেতে যেতেও যাচ্ছেনা কিছুতেই।’ হঠাত করেই মনে হল,
বড় ছেলে পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হলে ভদ্রলোকের একশ’ আট কেমন অস্বাভাবিক না? বিশেষ করে সে যুগে
যেখানে ছেলেদের আঠারো-উনিশেই— । একটা বয়স পর্যন্ত লোকে কেমন বয়স কমায়, আর শেষ বয়সে
এসে কেমন বাড়াবার নেশা দেখ? তার উপর বলছে, ওঁর সত্যিকারের বয়স নাকি আরও— । লোকটার
দেশ বলল, মেদিনীপুর। গ্রাম ভগবানপুর। থানাও। বয়স নিয়ে লোকটার নিজের বা ওঁর পরিবারেরও গর্ব
আছে খুব। এমনকী আলাউদ্দীনদেরও, বা এই দ্বীপের সবারই। এই বয়সেও লোকটা হেঁটে সেই মেলার
মাঠে যেতে চায়। এমনকী হাঁটে রোজই। কিন্তু একটি লোকের বড় ছেলের বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হলে
লোকটার বয়স কত আর হতে পারে? আশি—পঁচাশি—নব্বই। কিন্তু সেটা ছিল কম বয়সেই বিয়ের যুগ।
তখনকার হিসেবে খুব বেশি বয়সে বা পঁচিশে বিয়ে হলেও লোকটার বয়স জোর হলে আশি। তেতাল্লিশের
মন্বন্তর মানে আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগেকার ঘটনা, আর এটা মনে রাখলে লোকটার সবে জন্ম
হয়েছে মাত্র। মন্বন্তরের কথা মনে থাকার কথাই নয়। বড়জোর পরে শুনেছে কিছু বাবা-কাকাদের কাছ
থেকে।
ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আলাউদ্দীনের কাছে পরদিনের প্ল্যানটা জানতে চাইল অবিনাশ। মানে
কোথায় যাবে, বা। আলাউদ্দীনের কথায়, চাইলে কলস ক্যাম্প যেতে পারেন, আবার ওদিকে আছে
কুমীর প্রকল্পের ভাগবতপুর। কলস ক্যাম্প বলতে গেলে মোহনাতেই, এই টাইমে ঢেউ হবে। ওর কথায়,
শহরের লোক হওয়ায় অবিনাশ ঘাবড়ে যেতে পারে। বলল, চারপাশে জঙ্গল আর নদীতে ঢেউ— দুইয়ে
মিলে বেশ আতঙ্কই তৈরি হয় অনেকের মনে। ‘আপনি বরং— ।’ বলে ও পাথরপ্রতিমা হয়ে ভাগবতপুরের
কথাই বলল। ওদিকে একটা জায়গায় সাত-সাতটা নদী মিলেছে। বলল, স্পষ্ট দেখতে পাবেন আপনি, তা
ছাড়া নদীর পাড়ে কুমীরও। অবিনাশ এবার সেই অমল ত্রিপাঠীর কথা তুলল। কার্তিক এর মধ্যেই স্টার্ট
দিয়েছে ওর মোটর ভ্যানে। সামনে মসজিদ।
ফাইভ পর্যন্ত পড়া একটা মানুষ কী সুন্দর কথা বলল না? এখনকার বিএ পাশ একটি ছেলেও— ।
অমল ত্রিপাঠী মোড়ল ছিল এ গ্রামের। এ গ্রাম বলতে পূর্ব শ্রীপতিনগরের। একেবারে মোহনার খুবই ছোট
এই দ্বীপ ‘কে’-প্লটের গ্রাম দুটোমাত্রই। পূর্ব আর পশ্চিম শ্রীপতিনগর। মাঝখান দিয়ে খাল গেছে একটা।
আলাউদ্দীনের কথায়, ওটা আসলে নদীই, জোয়ার-ভাটা খেলত ওর ছোটবেলায়। পরে বাঁধা হয়েছে
লকগেট দিয়ে। ভরা কোটালে আশপাশ ভাসিয়ে দিত। কুমীর উঠে আসত। বলল, ‘কাল ভোরে আমরা
ওই লকগেটের পাশ দিয়েই যাব। যাব একেবারে বাঁধের উপর দিয়েই, পূর্ণিমার এখনও দিন তিনেক বাকি,
তবু জোয়ারের জল দেখবেন কেমন শোঁ-শোঁ শব্দ তুলে আছড়ে পড়বে আমাদের গায়ে।’

কী মনে হল, অবিনাশ বলল, ‘তোদের গ্রামে এই বয়স্ক লোকেরা কি নিজেদের মতো করেই হিসেব করে
বয়সের? মানে, যার যা মনে হল।
তার মানে ত্রিপাঠীবাবুর বয়সটা আপনি বানানো ভাবছেন?
মেলার মাইকে একশ’ আট শুনে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। আর তুইও বললি, এখানে সবাই
সেই মেদিনীপুরের, এসেছে আকালের যুগে। লোকটার কাছ থেকে সেই সব দিনগুলির কথা শোনার ইচ্ছে
হল। লোকটাকে দেখে দাদুর কথা মনে পড়ল। ভালবাসত খুব আমাকে। এর বড় ছেলের বয়স পঞ্চান্ন-
ছাপ্পান্ন হলে, ত্রিপাঠীবাবুর তো বড়জোর জন্ম হয়েছে তখন, মন্বন্তরের কথা মনে থাকার কথাই নয়। আছে
তোদের এখানে আর কেউ, মানে সেই পঁচাত্তর বছর আগেকার দুর্ভিক্ষের কথা বলতে পারবে যাঁরা— ।
আপনি জিজ্ঞেস করতে পারতেন তো ত্রিপাঠীবাবুকে, হয়ত বলতে পারত।
অন্যের মুখে শোনা কথাই বলত, তা দিয়ে দরকার নেই তো আমার। আমি চাই যারা একেবারে নিজের
চোখে। আমার দাদুর মতো।
ভ্যানের কার্তিক বলল, চা খাবেন তো? বাজারে থামি তাহলে— ।
আলাউদ্দীনের অসন্তোষের কারণ আমি বুঝি। লোকটার বয়স এদের সবার কাছেই খুব গর্বের। বললাম,
যার বড় ছেলের বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন তাঁর বয়স একশ’ আট হওয়াটা কেমন বাড়াবাড়ি না? পঁচাত্তর কি
আশি হোক, তাই বলে একশ’ আট? চা বানানোর লোকটি, মালিকই হবে দোকানের, কেউ একজন এক
প্যাকেট বিড়ি চেয়ে তাড়া দেওয়ায় ধমকে উঠে বলল, ‘দুটোই হাত তো আমার, না কী’। লোকটাকে
কেউ মনিদা বলে ডেকে পান দিতে বলল একটা। বিড়ির প্যাকেট বের করতে করতে আলাউদ্দীনের দিকে
তাকিয়ে বলল, ‘দুধ না লিকার?’ অবিনাশ কিছু বলার আগেই কার্তিক বলে দিল, ‘লিকার, লিকার—
চিনি কম।’ ছোট্ট একটু জায়গায় আড়াআড়ি দুটো বেঞ্চ। আট-দশ জন বসে। বিড়ির ধোঁয়া। সোলার
লাইট। পাশে বসা দাড়িওয়ালা একজন জিজ্ঞেস করল, ‘অমল ত্রিপাঠী?’
সেই দাড়িওয়ালা লোকটা, প্রথমে বুঝতে পারেনি অবিনাশ, নিজেও বয়স্ক লোকই একজন। বলল, অমল
ত্রিপাঠীর প্রথম বউ তো সুইসাইড করেছিল। না, লোকটা নিজে দেখেনি, দেখার কথাও নয়, তাঁর বয়স
আশিতে পড়বে সামনের বর্ষায়। তবে সে জানে অনেক কিছুই ত্রিপাঠীবাবুকে নিয়ে। ত্রিপাঠীবাবু নাকি
ভিক্ষে করত প্রথম জীবনে। দুই বিয়ে। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে ভগবানপুর থানা ভাঙতে গিয়েছিল
কংগ্রেসিদের সঙ্গে। বড়লোক হল তো অধিকারীদের দয়ায়। তেতাল্লিশের আকালে।
চায়ের দোকানের সেই মনিদাও বলল, ‘আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে আমাদের ছোটবেলাতেও কী
দাপটই না দেখেছি মানুষটার। মোড়ল ছিলেন তো পূর্ব শ্রীপতিনগরের, ওঁর কথা মানত সবাই। ওঁর মুখের
ওপর কথা বলবে কে?’ দাড়িওয়ালা সেই লোকটার কথায় ত্রিপাঠীবাবুর সেই প্রথম বউয়ের বেশি বয়স
হওয়ার কথা নয় তো! তখন তো মেয়েদের আট-নয় না হতেই বিয়ে। বউটা মরল যখন, তখন
বড়জোর এগারো-বারো, সন্তান ধারণের ক্ষমতাই আসেনি হয়ত। ত্রিপাঠীবাবুর সব সন্তানই দ্বিতীয় পক্ষের,
সবাই বেঁচেও নেই অবশ্য। ওঁর বড় মেয়ে নাকি মরেছে কলেরায়, আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে,
কুড়ি-বাইশ বছর বয়সে।
পূর্ণিমার আর দিন তিনেক বাকি মাত্র। রাত এখানে রাতের মতোই। আলাউদ্দীন বলে দিয়েছে বাইরে বের
হলে বাঁধের দিকটাতে সাবধানে যাবেন। না, বাঘের ভয় নেই, তবে শেয়াল খুব বাঁধের জঙ্গলে। শেয়াল,

বাঘরোল। রাতের দিকে এখানে কুয়াশা পড়ে খুব। বলেছিল, দু’ হাত দূরের কিছুও কিন্তু দেখতে পাবেন
না। দিন দুয়েক পরে পূর্ণিমা। চাঁদের থালা এখন প্রায় পুরোটাই গোল। আকাশ একেবারে ঢেলে আলো
দিচ্ছে। আলো আর কুয়াশা এখন মাখামাখি। ডাল-পাতার নড়ে ওঠাকে তুমি কারও চলে যাওয়া বলে
ভাববে। আবার সত্যিকারের কারও হেঁটে যাওয়াকেও তুমি হয়ত বিভ্রম বলে হয়ত ওড়াবে। রহমানদের
বাড়ির দিক থেকে শব্দ আসছে না কীসের? কচকচ-কচকচ। তবে কি গোয়ালের গোরুগুলির কিছু?
হয়ত না ঘুমিয়ে জাবর কাটছে বিকেলের খাবারের। বাড়ির বা পাড়ার কেউই জেগে নেই এখন। বাঁধের
ওপারের নদীতে ভটভট শব্দ। কোনও ট্রলার হবে। হয়ত সাগরে যাচ্ছে। যাচ্ছে, না কি দাঁড়িয়েই আছে।
যেন এই রাতে কুয়াশায় ডুবে অপেক্ষা করছে অবিনাশের জন্য। যেন তাকে বলবে কিছু। ইটের রাস্তার
গায়ে হলুদের উপর ডালপাতার হালকা কালো নকশা। একটা মেয়ে না? হালকা, রোগা-পাতলা। পরনে
ফ্রক একটা, মাথায় ফিতে। চেনা লাগছে না? কী নাম যেন? অ্যাসবেসটাসের ছাদওয়ালা ঘর। এক্কা-
দোক্কা খেলছে মেয়েটি। এক-পায়ে এক-একটা লাফের সঙ্গে ফ্রকটি উড়ছে হাওয়ায়। সঙ্গে আর দু’জন।
একটি ছেলেও। খালি গা, ডুরি ভরা প্যান্ট। এটা কী পাখি ডাকল যেন? কুবকুব-কুবকুব। ঝপ শব্দ হল
কোথায়, নির্ঘাত মাছরাঙা। পেছনে পুকুর। ডানদিকে ওটা চালতা গাছই। চালতা গাছ ছাড়িয়ে খড়ের
চালা একটা, বাইরে উনুন। এ সময় ধোঁয়া হয় খুব। নির্ঘাত কাঁচা কাঠ। আর সেই ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে।
জল বেরিয়ে আসে। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ চোখ খুলতে পারে না অবিনাশ।
প্ল্যান পাল্টে দিল অবিনাশ। আলাউদ্দীনকে বলল, ‘সেই অমল ত্রিপাঠীর বাড়িতেই চল তো আর একবার।’
অন্য কোথাও কিন্তু যাওয়া যাবে না আর। ভেবেছিলাম সপ্তমুখী হয়ে ভাগবতপুর— ।
সে না হয় পরে আর একদিন।
আলাউদ্দীন বলল, ‘ত্রিপাঠীবাবুদের ঘরের সামনের রাস্তায় কাদা হবে কিন্তু! কাল রাতে বৃষ্টি হল যে টের
পাননি? ওঠেননি একবারও? বাইরে যাননি?’
ত্রিপাঠীবাবু আজ একাই। ঘরে নয়, বাইরে বাঁধানো পুকুরঘাটে। আলাউদ্দীন বলল, ‘কী দাদু ঘরের
লোকজন গেল কোথায় সবাই?’ ভদ্রলোক যেন শুনতেই পাননি কিছু। হয়ত বয়সের জন্যই। অবিনাশ
বলল, ‘আবার আসতে হল, বুঝলেন?’
আসলে এত কিছু নিজের চোখে দেখেছেন আপনি। সবচেয়ে বড় কথা ভোলেননি কিছুই, আপনার চোখ,
কান, মন। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে আপনি নাকি কংগ্রেসিদের সঙ্গে থানা ভাঙতে।
এবার আলাউদ্দীন বলে উঠল, ‘ও দাদু তোমার নাকি দুই বিয়ে?’ আলাউদ্দীনের কথা শেষ হতে না হতেই
দুই নাতবউ, এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে, বাড়ি ঢুকল। আর আমাদের দেখেই সটান পুকুরপাড়ে।
ওদের একজন বলে উঠল, ‘ও দাদু তোমার চম্পার কথা বল?’

আলাউদ্দীন বলল, ‘কিছুই তো দেখাতে পারলাম না আপনাকে, আপনি শুধু ওই ত্রিপাঠীবাবু আর মেলা
করেই গেলেন।’ অবিনাশ ওর স্কুলের চাকরির কথা তুলল। নিয়মকানুন খুবই কড়া এখন। পরে আবার
আসার কথা জানিয়ে নৌকার কথা জানতে চাইল। নৌকা মানে ভটভটি। ‘— ভোর ক’টায় ছাড়ে যেন?’
দ্বীপ এলাকায় আসার এই এক ঝামেলা। ভোর ভোর বেরোতে না পারলে বসে থাক পরের দিনের জন্য।

আলাউদ্দীন বলল, ‘ভোর কোথায়, এটা আপনাদের শহর নয় কিন্তু, এখানে দিন শুরু হয় রোদ ওঠার
আগেই।‘ ভটভটির টাইম বলল সকাল সাড়ে ছ’টা আর সাতটা।
বিয়াল্লিশের আন্দোলনের কিন্তু খুব ভালই বর্ণনা দিলেন ভদ্রলোক। অমল ত্রিপাঠী। এই বয়সে এত টাটকা
স্মৃতি। থানার ছাদে ক’টা পুলিশ বসে ছিল, বা তখনকার কংগ্রেসি নেতার নাম, বা আন্দোলনের নেতা
সুশীল ধাড়া— । তারপর দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের কথাও বললেন নিঁখুত বর্ণনা করে। কীভাবে মানুষ খিদের
জন্য শাক-পাতা-লতা— । কীভাবে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বা ঘরে শুয়ে বসে থেকে না খেতে পেয়ে
শুকিয়ে, কীভাবে মরে যাচ্ছিল মানুষ। বা নিজের ঘরের বউ-মেয়েদের। অবিনাশ এ সময় জানতে
চেয়েছিল, ‘তখন কি চম্পার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে আপনার?’
তখন মানে আকালের বছরের কথা বলছেন?
বুড়ো মানুষের বকবকানিতে কারওই খুব একটা আগ্রহ থাকে না। আলাউদ্দীন কখন কোথায় চলে গেছে
কে জানে? নাতবউরাও আজ আর চায়ের কথা জানতে চায়নি। ভদ্রলোকের বিয়ে হয়েছিল সেই আকালের
গায়ে গায়েই। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে থানা দখলের পালা চলছে তখনও। কংগ্রেসিরা সবাইকে ঘর-বাড়ি
ছাড়তে বারণ করছে। টেলিগ্রাফের পোস্ট উপরে ফেলা হয়েছে। রাস্তাঘাট বন্ধ। মাঝিদের নৌকা জল থেকে
ডাঙায় উঠিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। কাউকে নদী পার করানো চলবে না। মোট কথা কেউ যেন
ইংরেজদের ভয়ে এলাকা না ছাড়ে। লোকজন ভাবছে সৈন্য আসবে এবার, গুলিগোলা হবে। যে যে ভাবে
পারছে তখন দেশ ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার তালে। এর মধ্যেই আশ্বিনের ঝড় আর বন্যা।
লোকটার কথায়, বাড়িতে তখন ওঁর বাবা-মা-পাঁচ ভাইবোন ছাড়াও কাকা, কাকার পরিবার। লোকটা
তখন মন্দিরের কাজ করছে অধিকারীবাড়িতে। পুজো-আচ্চা। এ ছাড়া রান্না। সেই অধিকারীবাবুর কথায়
তখন ওঁর বিয়ে করা। বাবা এল একদিন। ওঁর কাকা আর তাঁর দুই ছেলে নাকি মরেছে ঝড়ে ঘর চাপা
পড়ে। এক দানা চাল নেই। লোকে শাকপাতা খাচ্ছে। শাকপাতা মানে যা পাচ্ছে হাতের কাছে। লোকটার
বাবা নাকি পা জড়িয়ে ধরল অধিকারীবাবুর। বাঁচান গরীব ব্রাহ্মণকে।
ত্রিপাঠীবাবুর তখন এই ত্রিশ-বত্রিশ। অধিকারীবাবু বললেন, বিয়ে কর একটা। গোরু-লাঙল দিচ্ছি, এ
ছাড়া সুন্দরবনের জমি। চম্পা নামের মেয়েটির বয়স তখন মেরেকেটে এগারো। উপর-নিচ করে একটা
গামছার মতো কিছু দিয়ে জড়ানো শরীর। বাবাকে নিয়েই মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে অধিকারীবাবু।
গরীব ব্রাহ্মনের জাত রক্ষা করতে হবে। মেয়ের বয়স এগারো। খাওয়াতেই পারছে না, বিয়ে আর দেবে
কীভাবে? অধিকারীবাবুর কথায়, অমল ত্রিপাঠী ওঁর ছেলের মতো, একেবারে ঘরের লোক। ছেলে-
ছেলেবউয়ের শুধু নয়, ত্রিপাঠীর পুরো পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব তাঁর। গোরু-লাঙল দিলেন, এছাড়া
সুন্দরবনের জমি। জমির কাজ তো আর সারা বছরের নয়, যখন থাকবে না তখন এক অফিসে
পঙ্খাপুলারের চাকরি। তো চম্পার ভাগ্যে সুখ সইল না, জেদি মেয়ে ছিল খুব। যা করবে বলে ভাবত তা
না করে ছাড়ত না, বা যা করবে না বলে ঠিক করত তা ওকে দিয়ে। খিদের দিনে এত মেজাজ রাখলে
চলে? খিদের জ্বালায় মানুষ তখন গলায় দড়ি দিচ্ছে। মেয়েরা মরছে করবী ফল খেয়ে বমি করতে
করতে।

কার্তিককে বলে রেখেছে আলাউদ্দীন, সেকেন্ড ভটভটি ধরিয়ে দিতে হবে অবিনাশকে। সেকেন্ড ভটভটি
মানে সকাল সাতটা। এত সকালে ওঠার অভ্যাস নেই অবিনাশের। তা ছাড়া রওয়ানা হওয়ার আগে মুখ-

হাত ধোয়া বা বাথরুমের কথা ধরলে ওঠা উচিত কিন্তু ছ’টার আগেই। রাতে কুয়াশা একেবারে ঢেকেই
ফেলল যেন পৃথিবীটাকে। আকাশের গোটা চাঁদটাই অদৃশ্য। শুধু ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে আসা হালকা
আভার মতো কিছু। বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে একেবারে বামুনঘাট অব্দি গেলে কেমন হয়? সেই পঁচাত্তর
বছর আগে লোকটা ওখানেই লাগিয়েছিল নাকি ওর নৌকা। লাঙল, গোরু, কাজের লোক। সেই অধিকারী
জীবনটাই পাল্টে দিয়েছিল লোকটার। একটা শব্দ হল না? কেউ ডাকল যেন কাকে। দ্বীপের কুয়াশা বাঁধ
টপকে গড়িয়ে নদীর বুক বেয়ে কতদূর ছড়িয়ে গেছে কে জানে? হ্যাঁ, একটা শব্দই। কোনও নৌকা
নোঙর করছে। দাওয়ালি দিয়ে বাঁধের জঙ্গল কোপাচ্ছে কেউ। বাঁধে ওঠার রাস্তা তৈরি করছে। কিছু
মানুষ যেন কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। অবিনাশ হাঁটতে থাকে। অন্তত চার-পাঁচজনের দল একটা। চেনা
লাগছে না একটা গলা? হ্যাঁ, চেনাই তো! এবার খটখট-খটখট শব্দ, একেবারে একটানা। সঙ্গে টুং-টাং।
অবিকল গোরুর গলার ঘন্টাই। হ্যাঁ, গোরুই তো একজোড়া। অস্পষ্ট শরীরের দু’টি লোক একটা লাঙল
কাঁধে পেছনেই পড়ে গেছে কিছু। কিন্তু চম্পা কোথায়? ‘চম্পা—’। মেয়েটির নাম ধরেই এবার ডেকে
উঠল অবিনাশ।
শালা, চম্পা কোথায় বল? কোথায় ফেলে এসেছিস তুই ওকে? বিয়ের নাম করে কার কাছে তুই—?
এক্ষুনি দাদুর লাঠিটা হাতে পাবে অবিনাশ, এক্ষুনি— , শুধু মা-র কাছ থেকে নামটা জেনে নিতে হবে
একবার। ‘চম্পা, চম্পাই তো? মা, দাদুর সেই দিদি, সেই যে এক্কা-দোক্কা খেলা, সেই যে চালতা আর
নিমের ছায়া, সেই যে এক-পায়ে ভর দিয়ে দিয়ে কিতকিত-কিতকিত, সেই যে ঝোপের আড়াল থেকে
কোন এক পাখির কুবকুব ডাক, পুকুরের জলে ঝুপ শব্দ, মা মনে পড়ছে তোমার? চম্পা, চম্পাই তো?’
বল, অধিকারীর ঘরে কেন বডি ঝুলে রইল ওর, বলবি তো?
কাউকে ডাকতে হয়নি। নিজের থেকেই ঘুম ভেঙে গেল অবিনাশের। হাতমুখ ধুয়ে বাথরুমের কাজ সেরে
সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে অবিনাশ, অমনি কার্তিকের মোটরভ্যানের ভটভট-ভটভট। কুয়াশায় কিছু
দেখতে না পাওয়া গেলেও শব্দ বেশ আগের থেকেই জানান দেয় কিন্তু। ঘাটে গিয়ে আলাউদ্দীন শুনল
ফার্স্ট ভটভটি ছাড়ল মাত্র। কুয়াশায় দেখাই যাচ্ছে না কিছু। আর ফার্স্ট ভটভটি না ছাড়লে সেকেন্ডের
কথা আসবেই বা কীভাবে? তার মানে আরও একটা সিগারেট, আর এক কাপ চা। নতুন কোনও গল্প।
আর সত্যই গল্প আসে। আলাউদ্দীন সেই ত্রিপাঠীবাবুর খবর আনে একটা। মারা গেছে লোকটা। কাল
রাতে কেন বাঁধের দিকে গিয়েছিল কে জানে, হয়ত পেচ্ছাব করতে বেরিয়ে কুয়াশায়। স্ট্রোকই হবে। বা
হার্ট অ্যাটাক। ওর নাতিরা নাকি অন্য কিছু বলছে। বলছে, ডেডবডির পাশে পড়ে থাকা লাঠিটা নাকি
ওদের দাদুর নয়। সে লাঠি ত্রিপাঠীবাবুর হোক আর নাই হোক একশ’ আট বছরের একটা বুড়োকে তো
কেউ আর মার্ডার করতে আসবে না? পড়ে গিয়ে আঘাত লাগায় রক্তও বেরিয়েছে মাথা থেকে। ওই
বটগাছের বাঁদিকে লকগেট যাওয়ার রাস্তার পাশে যেখানে একটা ভাঙা লাঙলের ফাল পড়ে আছে,
ওখানেই। কার লাঙল কে জানে, কাঠের লাঙল কে আর ব্যবহার করছে এখন? জয়দেব ডাক্তারের কাছ
থেকে এইমাত্র শুনে এল আলাউদ্দীন। জয়দেব ডাক্তারকেই ডাক করিয়েছিল ত্রিপাঠীবাবুর নাতিরা।
আলাউদ্দীন বলল, ‘ভাগ্য ভাল, যা জানার আপনি জেনে নিয়েছেন কাল, একদিন দেরি হলেই আর।’
নৌকা ছাড়ার সময় অবিনাশ হাত নাড়াল আলাউদ্দীন আর কার্তিককে উদ্দেশ্য করে। জেটিতে দাঁড়িয়ে
ওরা দুজনেও নাড়িয়েছে নিশ্চিত। কুয়াশার জন্য কেউই অবশ্য কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। ভটভটি স্টার্ট
দিয়েছে মাত্র। ‘আবার আসবেন কিন্তু।’ বা এই রকম কিছুই। বা অবিনাশও যেন এই রকম কোনও

কথাই। সে যে যাই বলুক, নৌকার ভটভট-ভটভট ধ্বনী থেকে কোনও কথা বা অন্য কোনও শব্দকেই
তখন আর আলাদা করার যাচ্ছে না।