উৎসবপ্রেমী বাঙালির দুর্গাপূজা
রনি রেজা
বাঙালি জাতিগতভাবেই উৎসবপ্রেমী। যে কোনো উৎসব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-প্রথা ভেদাভেদ ভুলে পালন করতে জাতি হিসেবে বাঙালি এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। কোনো উৎসব সামনে পেলে তাতে মেতে ওঠা বাঙালির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। হোক সেটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশ্বাসের জায়গা আলাদা রেখে সবাই একে অপরের আমন্ত্রণে ছুটে যায় নির্দ্বিধায়। আহার গ্রহণ করে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে, সুখ-দুঃখের কথা বলে এবং প্রীতি বিনিময় করে সাবলীলভাবে। এ চিত্র দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি আমরা। বড় হয়েছি গ্রামে। গ্রামের মানুষগুলো একটু বেশিই সরল। মুক্তমনা, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক শব্দদগুলো হয়তো সেইভাবে জানা নেই তাদের। যেটা জানা আছে তার নাম হৃদ্যতা। এক বাজার থেকে কেনাকাটা করা, এক নদীতে গোসল করা, একই সঙ্গে জীবন লড়াইয়ে টিকে থাকাই হচ্ছে এদের মূল মন্ত্র। ঈদ কি পূজা। সব উৎসবই জমে ওঠে সমান তালে। গ্রামগুলো প্রাণ পায়। ঈদের সময় এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে হিন্দু বন্ধু-বান্ধব এসে খাওয়া-দাওয়া করে না। আবার পূজার সময়ে দলবেঁধে ম-পে যাওয়া মুসলমানদের যেন নিয়মমাফিক কাজ। পূজার দিনগুলোতে মুসলিম বাড়িগুলোতেও থাকে নানা ব্যস্ততা। যে এলাকায় হিন্দু বেশি ওইসব এলাকার মুসলমানদের বাড়িতে দূর-দুরান্ত থেকে মুসলমান নিকটাত্মীয়রা আসে দলবেঁধে। কেবলই পূজা দেখার ছুঁতোয়। মুসলমানেরা তো দুর্গাপূজা করে না, কিন্তু দলে দলে তারা পূজাম-প দেখতে যায়। কেউ কেউ নৃত্যগীতেও লম্ফঝম্প দেয়, কেউ গায়ও। আবার পাশে থেকে নির্বিঘœ করতে পাহারাও দেয় মুসলমানরাই। কোথাও কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলে তা রোধে আগেভাগে তৎপর হয় মুসলমানরাই। শুধু দুর্গাপূজা নয় এ ভ্রতিত্ববোধ জনম জনমের। যা দিন দিন গাঢ় হচ্ছে। রঙ পচ্ছে। সুখ ছড়াচ্ছে। যে দুর্গাপূজা একসময় বারোয়ারি ছিল, এখন তা সর্বজনীন। আরো বাড়িয়ে বললে বাংলাদেশের মুসলমানেরা কেবল দুর্গাপূজার দর্শক নয়, হিন্দুদের সহযোগী বন্ধুও।
বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু শরতের আশি^ন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয় দুর্গাপূজা এবং ঋতুরাজ বসন্তের চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা উদ্যাপনের প্রথা রয়েছে। বছরে দুবার দুর্গোৎসবের প্রথা থাকলেও বাংলাদেশে শরৎকালীন (শারদীয়) দুর্গোৎসবই বেশি উদ্যাপিত হয়ে থাকে। পুজা শুরু হওয়ার মাস দেড়েক আগে থেকেই শুরু হতো আমাদের মূর্তি দর্শন। প্রথম খড় পেঁচানো থেকে শুরু করে মাটি লেপন, রঙ দেয়া সজ্জাকরণ পর্যন্ত সবই হতো আমাদের চোখের সামনে। পুজার ক’দিন স্কুলে যাওয়া-আসার রাস্তা পাল্টে ফেলতাম। মূল রাস্তা দিয়ে না গিয়ে যেতাম হিন্দু পাড়ার ভেতর দিয়ে। মূর্তি দেখে গিয়ে বর্ণনা করতাম এলাকার বন্ধুদের কাছে। এমনও হয়েছে স্কুল থেকে ফিরে খেয়ে-দেয়ে আবার বন্ধুদের নিয়ে যেতাম মূর্তি দেখতে। সে ছিল অন্যরকম ভালোলাগা। এবছর দেবী কিসে চড়ে আসবে তা জেনে নিতাম দাদির থেকে। ধার্মিক, নামাজি দাদি আমার হিন্দু ধর্মের জ্ঞানেও ছিলেন প্রাজ্ঞ। বলতেন- এ বছর দুর্গা দেবী কিভাবে আসবেন বাপের বাড়ি। ঘোড়ায় আরোহী হয়ে আসবেন নাকি নৌকায়। যাবেনই বা কোন বাহনে। রৌদ্রোজ্জ্বল দিন হলে ঘোড়ায় চড়ে আসবেন। বেশি বৃষ্টি হলে আসবেন রথে বা নৌকায়। দেবী কোন বাহনে চড়ে মর্ত্যলোকে আসবেন এবং ফিরে যাবেন- তার ওপরই নির্ভর করে বাঙালির জীবনাচরণ ও প্রকৃতি। দেবালয় থেকে দেবী দুর্গার আগমনের মূলমন্ত্র হচ্ছে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টির পালন। অসুর বিনাশ করে তার ভক্তদের কল্যাণ সাধন করা দেবী দুর্গার কাজ। দেবী দুর্গাকে সবাই মা দুর্গা, পার্বতী, মহামায়া, কৈলাশী, দুর্গতিনাশিনী, চন্ডী, বাসন্তী, পরমা প্রকৃতি, নারায়ণী, ভদ্রকালী, হৈমবতী, ঈশ^রী, বৈষ্ণবী, মাহেশ^রী ইত্যাদি নামে অভিহিত করে। কোনো কোনো মতে বলা হয়, দুর্গা কোনো দেবীর নাম নয়। যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন তাকে দুর্গা নামে পূজা করা হয়ে থাকে। ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, ‘উ’-কার বিঘœ নাশ করে, রেফ-কার, রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে এবং ‘অ’-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ দৈত্য, বিঘœ, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন- তিনিই দেবী দুর্গা।
দেবী দুর্গার ১০ হাত দৃশ্যত। তার অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টাভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বাঙালি পূজারিদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। তার বাহন সিংহ ( কোনো কোনো মতে বাঘ)। মহিষাসুর মর্দিনী-মূর্তিতে তাকে মহিষাসুর নামে এক অনুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। যখনই দুঃখ, ক্লেশ, বিপদ, আপদে স্বর্গের দেবতা ও মর্ত্যের মনুষ্যসমাজ মূহ্যমান হয়েছে, এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে; তখনই পরিত্রাতা রূপে আবির্ভূত হয়েছেন দুর্গতিহারিণী শ্রী শ্রী দুর্গা দেবী। মহালয়ার (আমাবস্যার) পরে ‘জিদ’ পূজার মাধ্যমে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। ঘটের সামনে ফুল, বেলপাতা, ফল দিয়ে মা দুর্গাকে আহ্বান করা হয়। ‘জিদ’ পূজার দিন থেকে শুরু করে সারা রাত উপবাস থেকে পরদিন সকালে উপবাস ভেঙে ‘জিদ’ পূজার সমাপ্তি ঘটে। এরপর মহালয়ার দিন দশভুজা দেবী দুর্গাকে মন্ত্রেও মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রতি পদে ঘট স্থাপন করে দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থা ও পঞ্চমীতে প্রতিদিন দেবীর ঘটে পূজা করা হয়। ষষ্ঠিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে, শঙ্খ বাঁজিয়ে অধিবাস পূজা (আমন্ত্রণ) করে সেই ঘট স্থাপন করা হয় মন্দিরে। এরপর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পার করে দশমীবিহিত পূজা সমাপন করে শেষ হয় দুর্গাপূজার ১০ দিনের আনুষ্ঠানিকতা। দাদি এসব বলতেন রসিয়ে রসিয়ে। আমরা তা আগ্রহ নিয়ে শুনতাম।
দুর্গার বাপের বাড়ি হিমালয়, মেনকা তার মা। কিন্তু পুরাণের দেবী পিত্রালয় বঙ্গে যেদিন আসেন, সেদিন হলো মহালয়া। এটি আসলে দেবীর আগমন বার্তা; আকাশে-বাতাসে, সাদা মেঘের ভেলায়, নদী কিনারে কাশফুলের স্বচ্ছ মেলায়; শিউলি ফুল ও প্রভাতের শিশিরের দ্যুতিতে। দেবী পুত্র-কন্যাদের নিয়ে আসেন; অনেকটা ঘুমের ঘোরে, অনেকটা সুপ্তিতে। এদিকে পূজার্থীরা দেবী বরণে হাজার হাজার পূজাম-প তৈরি করেন। দেবী মূর্তি তখনও চক্ষুমুদিতা, তার চোখ খুলে দিয়ে তাকে জাগ্রত ও জীবন্ত করতে হবে, তার পুত্র-কন্যাদেরও। এই ধর্মীয় কৃত্যটির নাম বোধন; ষষ্ঠী পুজার সন্ধ্যায় এটি করে নিতে হয়। এসবই জেনেছি দাদির থেকে। দাদিও এসব ধর্মীয় পুরাণ পড়ে বা কোনো ঠাকুর পুরুতের থেকে শুনে শিখেননি। তিনি জেনেছেন তার দাদি বা কাকাদের থেকে। বাংলাদেশে যে অনেক আগে থেকেই সম্প্রীতি রয়েছে সেটা বুঝতে এ গল্পই যথেষ্ট বলে মনে করি। এছাড়া একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ম-বর্ণ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করা বিশ্বের ইতিহাসে সম্প্রীতির অন্যন্য উদাহরণ বলে মনে করি। প্রতিবছর শরৎ চরদিকে শুভ্রতা ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ঘরে ঘরে লেগে যায় শারদীয় দুর্গোৎসবের রঙ। বাংলার প্রতিটি ঘরে, পাড়া, মহল্লায় পরিলক্ষিত হয় দুর্গাপূজার আমেজ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা; সবাই মিলে মেতে ওঠে পরমানন্দে। ক্রমাগতভাবে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গোৎসবের আমেজ। প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও দুই বাংলায় জমজমাট পূজার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পূজারিরা। তারকাঁটার সিমানা ভেদ করে মেতে উঠেছে বাঙালি। দুই বাংলার অলিগলি, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, এমনকি বাড়ির উঠানেও তৈরি হচ্ছে পূজার প্যান্ডেল। বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিমা নির্মাণ, বিভিন্ন ধরণের চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা, সুবিশাল প্যান্ডেল, পাশাপাশি তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, দুর্গা দেবীর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, প্রসাদ বিতরণ, অরতি প্রতিযোগিতাসহ বিচিত্র ও বৈচিত্রময় আয়োজন দেখা যায় পূজাম-পগুলোতে।
ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়- প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পাঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুর মহেঞ্জোদারোতে দুর্গাদেবীর পূজা হতো। পঞ্চাদশ শতকে তৎকালীন শ্রীহাট (বর্তমান সিলেট) এলাকার রাজা গণেশ চন্দ্র প্রথম প্রতিমা স্থাপন করে দুর্গাপূজা শুরু করেন। এছাড়া ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহী অঞ্চলের রাজা কংশ নারায়ণ দুর্গাপূজা শুরু করেন। অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র দুর্গাপূজা করেন। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় দীর্ঘদিন ধরেই দুর্গাপূজা ছিল রাজা, জমিদার, জোতদার, মহাজন, প্রতাপশালী ও বিত্তবানদের দখলে। পরবর্তীতে কালক্রমে দুর্গাপূজা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পরম আকুলতায় উচ্চারিত হয় ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’
লেখক: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক